মিত্র, রাজা দিগম্বর
মিত্র, রাজা দিগম্বর (১৮১৭-১৮৭৯) ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, দেশহিতৈষী ও লেখক। ১৮১৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের হুগলি জেলার কোন্নগরে তাঁর জন্ম। উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বাংলার যে ক’জন ব্যক্তিত্ব বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, দিগম্বর মিত্র ছিলেন তাঁদের অগ্রগণ্য। তিনি ছিলেন মুক্তমনের অধিকারী এবং মানুষের রাজনৈতিক অধিকারে বিশ্বাসী। ডিরোজিওর শিষ্যদের অন্যতম দিগম্বর মিত্র কলকাতার প্রথম বাঙালি শেরিফ বা বিচারক (১৮৭৪) ছিলেন।
দিগম্বরের শিক্ষাজীবন শুরু হয় ১৮২৭ সালে হেয়ার স্কুলে। সেখানে তিনি ১৮৩০ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। পরে ১৮৩৪ সাল পর্যন্ত ছিলেন হিন্দু কলেজে অধ্যয়ন করেন। এখানেই তাঁর পরিচয় ঘটে ইয়ং বেঙ্গল গ্রুপ এবং পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবীদের চিন্তা-চেতনার সঙ্গে, যার ফলে তাঁর চিন্তার প্রসারতা বৃদ্ধি পায়। কর্মজীবনে তিনি শিক্ষক, কেরানি, তহসিলদার, জমিদারি এস্টেটের ম্যানেজার প্রভৃতি পদে কাজ করেন। তাঁর কর্মজীবন শুরু হয় মুর্শিদাবাদের নিজামত স্কুলে শিক্ষকতার মাধ্যমে। ১৮৩৭ সালে তিনি কাসিম বাজারের রাজা কৃষ্ণনাথ রায়ের গৃহশিক্ষক এবং পরে ম্যানেজার নিযুক্ত হন। এটি তাঁর কর্মজীবনের অত্যন্ত স্মরণীয় দিক। তাঁর কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে রাজা তাঁকে লক্ষাধিক টাকা দেন। এ থেকেই তাঁর সৌভাগ্যের সূচনা হয়। এ টাকা দিয়ে তিনি রেশম ও নীলের ব্যবসা করে ধনশালী হয়ে ওঠেন। শেয়ার ব্যবসায়ে প্রভূত অর্থ উপার্জন করে তিনি একজন ধনী জমিদারে পরিণত হন; এমনকি ১৮৫০ সালে তিনি ‘ওয়াটসন অ্যান্ড কোম্পানি’-র সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্যবসায় সফল হন এবং বিশাল সম্পদের অধিকারী হন। তিনি দেশীয় পণ্যোৎপাদনের জন্য শিল্প স্থাপন করে নিজেদেরকে বিশ্বের দরবারে পরিচিত করান এবং এতে মানুষের মনে দেশপ্রেম জাগ্রত হয়। তবে বিত্তবান হওয়া সত্ত্বেও তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী ও হূদয়বান। কর্মচারীদের কাছে গিয়ে তিনি তাদের সমস্যা শুনতেন এবং আন্তরিকতার সঙ্গে তা সমাধান করতেন। গ্রামীণ কৃষকদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুর মতো।
ইউনিয়ন ব্যাংকের সঙ্গে কর্মসূত্রে দ্বারকানাথ ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। তিনিই প্রথম দিগম্বরকে রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করেন। কৃষক তথা দরিদ্র জনসাধারণের সমস্যা দূরীকরণের জন্য দিগম্বর ১৮৫১ সালের ৩১ অক্টোবর ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন নামে একটি সংগঠন তৈরি করেন। তিনি ছিলেন এর সহকারী সেক্রেটারি। পরে ১৮৬৯ সালে এর ভাইস-প্রেসিডেন্ট এবং ১৮৭৩ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় এটি জনসাধারণের একটি প্রতিবাদী প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তাঁরই নেতৃত্বে ১৮৫৩ সালে এর সঙ্গে সরকারের বিখ্যাত ‘রাজকীয় সনদ’ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
দিগম্বর মিত্র ১৮৫৭ সালের কালাকানুন এবং ইংরেজদের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠেন। তাঁর এই দৃষ্টিভঙ্গি বিভিন্ন মহল কর্তৃক প্রশংসিত হয়। তাঁর লেখনী ছিল সর্বদা সরকারের সমালোচনায় দুর্বার। তিনি নিজে জমিদার হলেও কৃষকদের অধিকারের পক্ষে তিনি মতামত প্রকাশ করেন। তিনি ‘ভারত সভা’র সহসম্পাদক ও সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। উডের রাজ্যশাসন পরিকল্পনার বিরোধিতা করে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৫৭ সালের ৬ এপ্রিল টাউন হলের সভায় ভারতীয় বিচারক কর্তৃক ইংরেজদের বিচার করার অধিকার সংক্রান্ত আইন বিষয়ে তিনি বক্তৃতা দেন। তিনি ১৮৬২ সালে আয়কর সম্মেলনে ভারত সভার প্রতিনিধি এবং অবৈতনিক শান্তি বিচারক নির্বাচিত হন। ১৮৬৪ সালে তিনি এপিডেমিক ফিভার কমিশনের একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি এবং একই বছর ননঅফিসিয়াল বাংলার আইন পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি তিনবার ব্যবস্থাপক সভারও সদস্য ছিলেন।
দিগম্বর মিত্র পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের অনুকরনে এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার প্রবর্তনের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবধর্মকে সবার ওপরে স্থান দেবার পক্ষপাতী। তবে নারী অধিকারের ব্যাপারে তিনি অনেকটা রক্ষণশীল ছিলেন। তিনি বহুবিবাহ রদ আইন প্রবর্তন ও বিধবাবিবাহ আইন প্রচলনের বিরোধিতা করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে তিনি সমর্থন করতেন। তিনি জেলাভিত্তিক দাতব্য সমাজের অবৈতনিক সেক্রেটারি ছিলেন এবং সেখানে প্রতি মাসে ২০জন লোকের বৃত্তির ব্যবস্থা করেছিলেন। এছাড়া তিনি কমপক্ষে ৮০জন দরিদ্র ছাত্রের প্রয়োজনীয় সবকিছুর ব্যবস্থা করেছিলেন। এভাবে দেশব্যাপী জনকল্যাণমূলক কাজে নিবেদিত থাকার জন্য সরকার তাঁকে ১৮৭৬ সালে ‘সি.এস.আই’ এবং ১৮৭৭ সালে ‘রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করে। মাইকেল মধুসূদন দত্ত তাঁর মেঘনাদবধ কাব্য তাঁকে উৎসর্গ করেন। পরবর্তী জীবনে দিগম্বর আধ্যাত্মিক জীবনধারা গ্রহন করেন। ১৮৭৯ সালের ২০ এপ্রিল তাঁর মৃত্যু হয়। [মোঃ মাসুদ পারভেজ]