মার্গ

মার্গ ভারতীয় ধর্মদর্শনের মোক্ষ লাভের পথ। মোক্ষকে পরমপুরুষার্থ নামে অভিহিত করা হয়। এই মোক্ষলাভের জন্য দার্শনিকগণ ৩টি মার্গ বা পথ রয়েছে: কর্মমার্গ, ভক্তিমার্গ ও জ্ঞানমার্গ। জ্ঞান-কর্মসমুচ্চয়বাদ অনুসারে জ্ঞান ও কর্ম উভয়ই মোক্ষলাভের জন্য অপরিহার্য। ভক্তিমার্গ অনুসারে একমাত্র ভক্তির মাধ্যমেই মানুষের মুক্তি তথা পরমপুরুষার্থ লাভ হয়। জ্ঞানমার্গ অনুসারে কর্ম বা ভক্তি নয়, জ্ঞানই মানবমুক্তির একমাত্র পথ।

কর্মমার্গ মানুষের জীবনধারণের জন্য কর্ম একান্ত আবশ্যক। ভারতীয় দর্শনে কর্মকে সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম- এই দুইভাগে ভাগ করে বলা হয়েছে যে, মানুষের পক্ষে শুধু নিষ্কাম কর্ম সম্পাদন করা সম্ভরপর নয়। তবে যোগের আলোকে কর্ম সম্পাদনের ওপর ভারতীয় দর্শনে গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ফলাকাঙ্ক্ষা ত্যাগ করে ‘চিত্তের সমত্ব ’ অর্জন হচ্ছে যোগের নীতি। যোগী প্রজ্ঞা দ্বারা পরিচালিত বলে কর্মফল দ্বারা বিচলিত বোধ করেন না। তাঁর লক্ষ্য কর্তৃত্বাভিমান ত্যাগ করে আত্মার শুদ্ধতা অর্জন। একমাত্র নিষ্কাম কর্মের দ্বারাই আত্মশুদ্ধি ও আত্মোপলব্ধি এবং সমত্ববুদ্ধি অর্জিত হয়। আর এভাবেই মানুষের মোক্ষলাভ হয়।

ভক্তিমার্গ প্রেম মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। প্রেমের দ্বারা মানুষ অতি সহজেই ঈশ্বরের সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন মন থেকে সকল প্রকার মালিন্য দূর করে  একান্ত শ্রদ্ধা, সেবা, ত্যাগ ও আন্তরিকতা। ভক্তকে ঈশ্বরে অবিচল আস্থা রেখে নানা কল্পনায় তাঁর সঙ্গে একাত্ম হবার চেষ্টা করতে হবে, তাঁকে সব কিছু সর্মপণ করতে হবে। আর তাহলেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হবে। ভারতীয় দর্শনে ভক্তিসাধনার বিশেষ কতগুলো পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে: ‘শান্তভাবের সাধনা’, ‘সাম্যভাবের সাধনা’, ‘সখ্যভাবের সাধনা’, ‘পিতৃভাব/ মাতৃভাবের সাধনা ’এবং ‘মধুরভাবের সাধনা’। এই সাধন-পথের যেকোনো একটি অবলম্বন করে ভক্ত ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করে বদ্ধাবস্থা থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেন। বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজ ভক্তিমার্গের অনুসারী ছিলেন।

জ্ঞানমার্গ ভারতীয় দর্শনে ৩টি মার্গের মধ্যে জ্ঞানমার্গকে সর্বশ্রেষ্ঠ মার্গ হিসেবে গণ্য করা হয়। কারণ কর্মমার্গ ও ভক্তিমার্গের সফল পরিণতি জ্ঞানমার্গ। জ্ঞানমার্গের ব্যক্তি প্রজ্ঞা, যুক্তি ও দার্শনিক জ্ঞানের অধিকারী। তাঁর জ্ঞান এক অখন্ড জ্ঞান- জগৎ, জীবন, পরমাত্মা ইত্যাদি সমগ্র বিষয়ে তাঁর রয়েছে এক অখন্ড ও সামগ্রিক উপলব্ধি। ফলে জ্ঞানমার্গের ব্যক্তিকে কর্ম ও ভক্তিমার্গের অনুশীলন করে অগ্রসর হতে হয়। জ্ঞানমার্গ অনুসারে সাধকের মনে একান্তভাবে ব্রহ্মজ্ঞানলাভের বাসনা জাগ্রত হতে হবে। এরূপ অবস্থায় সাধকের মনে ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা শুরু হয়। এই ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা কতগুলো শর্তের ওপর নির্ভরশীল: ‘বিবেক’, ‘শমদমাদি’, ‘উপরতি’, ‘তিতিক্ষা’, ‘সমাধি’, ‘শ্রদ্ধা’, ‘বিরাগ’, ও ‘মুমুক্ষুত্ব’।

উপর্যুক্ত শর্তাদি পূরণ করে জ্ঞানমার্গী সাধক তত্ত্বজ্ঞানী গুরুর নিকট জগৎ, জীবন, আত্মা, পরমাত্মা ইত্যাদি সম্পর্কে সত্য জ্ঞানলাভের জন্য একান্তভাবে অধ্যয়ন করেন। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘শ্রবণ’। গুরুর নিকট সত্য কথা শ্রবণের পর তিনি নিজ যুক্তি-বুদ্ধিদ্বারা এ সব বিষয়ের যথার্থতা ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। এর নাম ‘মনন’। এই জ্ঞানলাভের পর সাধক এসব ‘আধ্যাত্মিক সত্য’ সম্পর্কে নিরন্তর ধ্যান করবেন। এর নাম ‘নিদিধ্যাসন’। এই প্রক্রিয়ায় সাধকের মন থেকে সর্ব প্রকার অজ্ঞানতা দূর হয়ে ভেদাভেদ জ্ঞান রহিত হয় এবং আত্মা ও ব্রহ্মের অভিন্নতা উপলব্ধি হয়। এই অবস্থায় সাধক মোক্ষলাভ করেন। জ্ঞানমার্গীর নিকট একমাত্র ব্রহ্মই পরমতত্ত্ব, সচ্চিদানন্দ, নির্গুণ ও অদ্বয়তত্ত্ব। ন্যায়-বৈশেষিক ও অদ্বৈতবাদী বেদান্ত দর্শন জ্ঞানমার্গেরও অনুসারী। ভারতীয় দর্শনে কর্মমার্গ, ভক্তিমার্গ ও জ্ঞানমার্গের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। প্রবৃত্তি অনুসারে স্বস্ব পথ অবলম্বন করে সাধক মোক্ষলাভ করতে পারেন। [প্রদীপ কুমার রায়]