মল্লিক, পঙ্কজকুমার
মল্লিক, পঙ্কজকুমার (১৯০৫-১৯৭৮) রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক। ১৯০৫ সালের ১০ মে কলকাতার এক বৈষ্ণব পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই সঙ্গীতের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ায় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা খুব বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। ১৯২১ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করার পর তিনি বঙ্গবাসী কলেজে ভর্তি হন, কিন্তু এখানেই তাঁর পড়াশোনার সমাপ্তি ঘটে।
জনৈক আত্মীয়ের নিকট শৈশবেই পঙ্কজকুমারের সঙ্গীতশিক্ষা শুরু হয়। পরে কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি পুরোপুরি সঙ্গীতের প্রতি মনোনিবেশ করেন এবং বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করতে থাকেন। এমনি এক অনুষ্ঠানে তাঁর পরিচয় হয় তৎকালীন বিখ্যাত গায়ক দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। তিনি পঙ্কজকুমারের মধ্যে সঙ্গীতের অফুরন্ত সম্ভাবনা দেখতে পান এবং তাঁকে রাগসঙ্গীতে তালিম দিতে শুরু করেন। এভাবেই তাঁর পদ্ধতিগত সঙ্গীতশিক্ষার শুরু। পঙ্কজকুমার বঙ্গবাসীতে অধ্যয়নকালেই রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রতি ঝুঁকে পড়েন এবং রবীন্দ্রনাথের কবিতায় সুরারোপ করে গাইতে থাকেন। পরবর্তীকালে তিনি দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিকট রবীন্দ্রসঙ্গীত শিক্ষা করেন।
পঙ্কজকুমার শুধু একজন শ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীই ছিলেন না, রবীন্দ্রসঙ্গীতে তিনি অনেক নতুন মাত্রাও যোগ করেন, যার ফলে রবীন্দ্রসঙ্গীত ঐশ্বর্যমন্ডিত হয়। পূর্বে রবীন্দ্রসঙ্গীতে তবলা ব্যবহার করা হতো না, পঙ্কজকুমারই প্রথম এতে তবলা সঙ্গত করেন। তাঁর আগে রবীন্দ্রসঙ্গীত বিশেষ একটি গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। পঙ্কজকুমার তাঁর ওজস্বী কণ্ঠ, পৌরুষদীপ্ত গায়নরীতি এবং হূদয়ের আবেগ দিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীতে নতুন প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন।
পঙ্কজকুমার ১৯২৭ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে কলকাতা বেতারের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এ সময় তিনি বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন। ১৯২৯ সালে কলকাতা বেতারে সঙ্গীত শিক্ষার আসর প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি তার পরিচালক ও শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘকাল যুক্ত ছিলেন। এই আসরের মাধ্যমেই তিনি মূলত রবীন্দ্রসঙ্গীতকে জনসাধারণের নিকট জনপ্রিয় করে তোলেন। এই আসরে তিনি নজরুলের গানও শেখাতেন। ১৯৩২ সাল থেকে কলকাতা বেতার থেকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ নামে যে সঙ্গীতালেখ্য প্রচারিত হতে থাকে, পঙ্কজকুমার ছিলেন তার অন্যতম উদ্যোক্তা। এ অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনা এক মহতী কীর্তি হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।
রবীন্দ্রনাথের অনেক কবিতায় সুরারোপ করে পঙ্কজকুমার অসাধারণ খ্যাতি অর্জন করেন এবং রবীন্দ্রনাথের গানের পাশাপাশি সুরারোপিত এই কবিতাগুলিও তিনি গান হিসেবে রেকর্ড করেন। তাঁর রেকর্ডকৃত গানের সংখ্যা চার শতাধিক। ১৯২৬ সালে ভিয়েলোফোন কোম্পানি থেকে তাঁর প্রথম গানের রেকর্ড প্রকাশিত হয়। পরে আরও অনেক রেকর্ড কোম্পানি থেকে তাঁর রেকর্ড বের হয়। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে তিনি শেষ রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন। তাঁর জীবনের শেষ রেকর্ড ১৯৭০ সালে সংস্কৃত স্তোত্রপাঠ।
১৯৫৩ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ‘লোকরঞ্জন শাখা’ গঠন করলে মুখ্যমন্ত্রী ডাক্তার বিধানচন্দ্র রায়ের অনুরোধে তিনি তার উপদেষ্টা নিযুক্ত হন এবং ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত কৃতিত্বের সঙ্গে এ দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৩ ও ১৯৫৬ সালে তিনি নিখিল ভারত বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনে সঙ্গীত শাখার সভাপতিত্ব করেন।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী পঙ্কজকুমার সঙ্গীত পরিবেশনের পাশাপাশি সঙ্গীত পরিচালনায়ও দক্ষতার পরিচয় দেন। তিনি প্রায় অর্ধশত বাংলা ও হিন্দি চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা এবং শতাধিক ছবিতে কণ্ঠ দান করেন। ভারতীয় চলচ্চিত্রে নেপথ্য সঙ্গীত প্রচলনের পশ্চাতেও তাঁর উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। নির্বাক চলচ্চিত্রের যুগে চাষার মেয়ে ছায়াছবির নেপথ্যে অর্কেস্ট্রা দলের সঙ্গে বাজনা বাজিয়ে তিনি সুনাম অর্জন করেন। পঙ্কজকুমার চলচ্চিত্রের পাশাপাশি মঞ্চনাটকেও সঙ্গীত পরিচালনা করেন, যার শুরু ১৯৩০ সালে সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের স্বয়ম্বর নাটকের মাধ্যমে। তিনি মুক্তি নামক চলচ্চিত্রে অভিনেতা হিসেবেও অংশগ্রহণ করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তি উপলক্ষে কলকাতা বেতার থেকে যে বিশেষ সঙ্গীতানুষ্ঠান প্রচারিত হয় তাতে সুরারোপ করেন পঙ্কজকুমার।
পঙ্কজকুমার কেবল সঙ্গীতের প্রায়োগিক দিক নিয়েই চর্চা করেননি, এর তাত্ত্বিক ও গবেষণার ক্ষেত্রেও তিনি অসামান্য অবদান রেখেছেন। সঙ্গীতবিষয়ক বিভিন্ন সেমিনারে এ বিষয়ে তিনি বহু মূল্যবান বক্তৃতাও দিয়েছেন। দিল্লির সঙ্গীত নাটক একাডেমী আয়োজিত সেমিনারে তাঁর উল্লেখযোগ্য তিনটি বক্তৃতা হলো: Influence of North Indian Music in the evolution of Music in Bengali motion Picture (১৯৫০), Wealth of Indian Classical and Folk Music and its place in Films (১৯৫৪) এবং Aesthetics the value of Rasa শীর্ষক সেমিনারে উপস্থাপিত Is Popular Music devoid of Classical Music (১৯৫৬)। এসব বক্তৃতায় সঙ্গীত বিষয়ে তাঁর গভীর জ্ঞানের পরিচয় পাওয়া যায়। এছাড়া ১৯৫৭ সালে দিল্লির আকাশবাণী কেন্দ্রের ত্রিশবর্ষ পূর্তি উপলক্ষে আমন্ত্রিত হয়ে তিনি A short account of my experience with AIR since its inception in Calcutta in 1927 বিষয়ে বক্তৃতা দেন। একই বছর ভাগলপুরে আয়োজিত বঙ্গ সাহিত্য সম্মেলনে সঙ্গীতের তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক রূপ সম্পর্কে জ্ঞানগর্ভ বক্তৃতা দেন।
পঙ্কজকুমার সঙ্গীতের নানা শাখায় (কীর্তন, ভজন, পল্লীগীতি, দেশাত্নবোধক গান, শ্যামাসঙ্গীত, হিন্দিগান ইত্যাদি) অসামান্য অবদান রাখলেও তাঁর শ্রেষ্ঠ খ্যাতি রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবেই। নিরলস সাধনা, আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং বলিষ্ঠ পদক্ষেপের মাধ্যমে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ক্ষেত্রে তিনি একটি যুগ ও প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা লাভ করেন। সঙ্গীতে অসাধারণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৩২ সালে সারস্বত মহামন্ডল কর্তৃক ‘সুরসাগর’, ১৯৫৬ সালে ‘সঙ্গীতরত্নাকর’, ১৯৭০ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘পদ্মশ্রী’, ১৯৭৩ সালে ‘দাদা সাহেব ফালকে’ এবং ১৯৭৪ সালে টেগোর রিসার্চ ইনস্টিটিউিট কর্তৃক ‘রবীন্দ্রতত্ত্বাচার্য’ উপাধিতে ভূষিত হন।
সঙ্গীতজ্ঞ পঙ্কজকুমার মানুষের রাজনৈতিক স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। তাই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আর্থিক সাহায্য দানের মাধ্যমে তিনি বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন এবং ১৯৭৪ সালে সরকারি আমন্ত্রণে বাংলাদেশ ভ্রমণ করেন। তিনি আমার যুগ আমার গান শীর্ষক একটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থও রচনা করেন। ১৯৭৮ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় তাঁর মৃত্যু হয়। [মোবারক হোসেন খান]