মল্লিক, কে
মল্লিক, কে (১৮৮৮-১৯৫৯) কণ্ঠশিল্পী। ১২৯৫ বঙ্গাব্দের (১৮৮৮) ১২ জ্যৈষ্ঠ পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কুসুম গ্রামে এক দরিদ্র মুসলিম পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর প্রকৃত নাম মুন্সী মহাম্মদ কাসেম, কিন্তু তৎকালীন সমাজবাস্তবতার কারণে সঙ্গীতজগতে প্রতিষ্ঠালাভের উদ্দেশ্যে তিনি ‘কে মল্লিক’ ছদ্মনাম ধারণ করেন। ১৯০২ সালে তিনি জীবিকার উদ্দেশ্যে কলকাতা আসেন এবং এক মাড়োয়ারির দোকানে কাজ নেন। পরে চামড়ার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ‘র্যালি ব্রাদার্স কোম্পানি’-র চাকরি নিয়ে তিনি কানপুর চলে যান।
কে মল্লিক ছিলেন বিশ শতকের গোড়ার দিকের আধুনিক বাংলা সঙ্গীতের একজন জনপ্রিয় শিল্পী। বাল্যকালে তাঁর সঙ্গীতশিক্ষা কীভাবে হয়েছিল তা জানা যায় না। র্যালি ব্রাদার্সের চাকরিতে কানপুরে অবস্থানকালে তিনি সেখানকার সঙ্গীতজ্ঞ আবদুল হাই হাকিমের নিকট গান শেখেন। ওই সময়ে তিনি বাইজি-গানেও তালিম নেন। তাঁর গানের গলা ও প্রতিভা দুই ছিল সমান। কলকাতায় ফিরে তিনি ছোট-ছোট আসরে গান গেয়ে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং শ্রুতিমধুর কণ্ঠের সুবাদে রেকর্ড কোম্পানিতে গান গাওয়ার সুযোগ লাভ করেন।
সর্বপ্রথম জার্মানির ‘বেকার রেকর্ড কোম্পানি’ কে মল্লিকের কণ্ঠে ১২টি শ্যামাসঙ্গীত রেকর্ড করে। কিন্তু মুসলমান গায়কের কণ্ঠে শ্যামাসঙ্গীতের রেকর্ড বাজারে বিক্রি হবে না এই আশঙ্কায় ‘কে মল্লিক’ ছদ্মনামে তাঁর রেকর্ড প্রকাশ করা হয়। পরে তিনি ‘পন্ডিত শঙ্কর মিশ্র’ নামে হিন্দি গান এবং ‘মুন্সী মহাম্মদ কাসেম’ নামে ইসলামি গান রেকর্ড করেন। সঙ্গীতজগতে প্রতিষ্ঠা লাভের পর ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েজ’ও তাঁর অনেক গান রেকর্ড করে।
কে মল্লিক শ্যামাসঙ্গীত ছাড়াও রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রজনীকান্ত ও অতুলপ্রসাদের গান রেকর্ড করেও খ্যাতি অর্জন করেন। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার মাথা নত করে দাও হে’, অতুলপ্রসাদের ‘বঁধু এমন বাদলে তুমি কোথায়’ এবং নজরুলের ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুলশাখাতে দিসনে আজি দোল’ গানগুলি রেকর্ড হলে সুধীমহলে প্রচন্ড আলোড়নের সৃষ্টি হয়। তিনি নজরুলের আরও যেসব গান রেকর্ড করেন সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: ‘আজ এলো খুশীর ঈদ’, ‘আনন্দিনী উমা আজো আমার আনন্দিনী উমা’, ‘আমার উমা কই গিরিরাজ’, ‘আমার নয়নে নয়ন রাখি’, ‘আসিছেন হাবিবে খোদা মোদের নবী কমলীওয়ালা’ ইত্যাদি। শেষের গানটি আববাসউদ্দীনের সঙ্গে দ্বৈতকণ্ঠে গাওয়া।
কে মল্লিক ১৯০৯ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত বিভিন্ন সুরে বিচিত্র ধরনের গান গেয়েছেন। তাঁর রেকর্ড এতই জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল যে, অধিকাংশ রেকর্ডের প্রায় ৩০/৪০ হাজার কপি বিক্রি হতো। ফলে তিনি লাখ লাখ টাকা উপার্জন করেছিলেন বটে, কিন্তু দারিদ্র্য তাঁর সঙ্গ ছাড়েনি। তাই তাঁর শেষজীবন অত্যন্ত অর্থকষ্টে অতিবাহিত হয়।
প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী আঙ্গুরবালা ছিলেন কে মল্লিকের সমসাময়িক এবং নজরুল ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। কে মল্লিক এক সময় ঝরিয়ার রাজবাড়ির সভাগায়ক ছিলেন। ওই সময় কমলা ঝরিয়া তাঁর অনুপ্রেরণায় কলকাতা আসেন এবং কণ্ঠশিল্পী হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেন। শেষজীবনে কে মল্লিক নিজ গ্রামে বসবাস করেন এবং সঙ্গীতশিক্ষার্থী চাষীদের সঙ্গীত শেখান। ১৯৫৯ সালে তিনি স্বগ্রামে মৃত্যুবরণ করেন এবং সেখানেই সমাহিত হন। [ওয়াকিল আহমদ]