মজুমদার, রায়বাহাদুর যদুনাথ
মজুমদার, রায়বাহাদুর যদুনাথ (১৮৫৯-১৯৩২) ১৮৫৯ সালের ২৩ অক্টোবর বর্তমান নড়াইল জেলার লোহাগড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। পিতা প্রসন্নকুমার মজুমদার যশোরের দেওয়ানি আদালতে চাকরি করতেন। যদুনাথ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে এম.এ পাস করেন। প্রথম জীবনে তিনি কিছুকাল শিক্ষকতা করেন। ১৮৮৩ সালে ডা. যোগেন্দ্রনাথ স্মার্তশিরোমণির সাথে যৌথভাবে ইউনাইটেড ইন্ডিয়া নামক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র সম্পাদনা করেন। একই সাথে তিনি নিজ পত্রিকাসহ স্টেটসম্যান, হিন্দু পেট্রিয়ট ও অমৃতবাজার পত্রিকায় নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতে থাকেন। পরে ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদক হয়ে তিনি লাহোর চলে যান। পরবর্তীকালে নেপালের তৎকালীন মন্ত্রী স্যার মহারাজা রণদীপ সিংহ জঙ্গি বাহাদুর তাঁকে নেপালের দরবার স্কুলে প্রধান শিক্ষকের পদে নিযুক্ত করেন। কিছুদিন পরে নেপালে নানাপ্রকার রাজনৈতিক গোলযোগ দেখা দিলে তিনি পুনরায় লাহোরে ট্রিবিউন পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালনে রত হন। পরে কাশ্মীরের তৎকালীন মন্ত্রী নীলাম্বর মুখোপাধ্যায়ের বিশেষ আহবানে তিনি কাশ্মীরের রাজস্ব সচিবের পদ গ্রহণ করেন। অতঃপর তিনি বি.এল পরীক্ষা দেন এবং প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন। পরে তিনি কাশ্মীরের রাজস্ব সচিবের চাকরি ছেড়ে দিয়ে যশোর এসে ওকালতি শুরু করেন। নীলকর সাহেবদের দায়েরকৃত নানা হয়রানিমূলক মামলায় জড়িত হয়ে প্রতিবাদী কৃষককুল যখন জেল-জরিমানার শিকার হতো তখন যদুনাথ আইনজীবী হিসেবে তাদের পক্ষ অবলম্বন করতেন। তিনি সংবাদপত্রে লেখনীর মাধ্যমেও সরকারের অত্যাচারের চিত্র তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি তিনি গভর্নমেন্টের উচ্চতর মহলে প্রজাসাধারণের পক্ষে দরখাস্ত করেন এবং ব্রাড্ল সাহেবের দ্বারা নীলকরদের অত্যাচার ও প্রজাদের দুর্দশার কাহিনী ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উত্থাপন করান। তাঁর এসব কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে নীলকরদের অত্যাচার প্রশমনের সহায়ক হয়।
যদুনাথ মজুমদার ১৬ সেপ্টেম্বর ১৯০৪ থেকে ২৩ নভেম্বর ১৯০৭ সাল পর্যন্ত যশোর জেলা বোর্ড ও যশোর মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এ সময় তিনি অনেক জনহিতকর কাজ করেন। তখন ম্যালেরিয়া, কলেরা, বসন্ত, ইনফ্লুয়েঞ্জা প্রভৃতির আক্রমণ থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য তিনি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পুস্তিকা প্রচার করেছিলেন। তাঁর সময়ে জনসাধারণের মধ্যে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য যশোর জলকল স্থাপিত হয়। যশোর টাউন হল প্রতিষ্ঠায় তাঁর অবদানই সর্বাধিক।
যদুনাথ জনগণের হিতার্থে নানাদিক আলোচনার জন্য সম্মিলনী নামক একটি সংবাদপত্র প্রকাশ করেন। তিনি হিন্দু পত্রিকা প্রকাশ করে তাতে হিন্দু শাস্ত্রের মর্ম ব্যাখ্যা করেন এবং শাস্ত্রের প্রতি হিন্দু শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। তিনি ইংরেজিতেও ব্রহ্মচারী পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি বৈশ্যবারুজীবী নামক আরও একখানি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। বাংলা ভাষায় তিনি দর্শন, ধর্মতত্ত্ব, রাজনীতি, সমাজতত্ত্ব, স্বাস্থ্যতত্ত্ব প্রভৃতি বিষয়ে গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর লিখিত আমিত্বের প্রসার, ব্রহ্মসূত্র, পরিব্রাজক সূক্তমালা, সাংখ্যকারিকা, শান্ডিল্য সূত্র, নরগাথা, শ্রেয় ও প্রেয় গ্রন্থাবলি তৎকালীন পন্ডিতমন্ডলীর মধ্যে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। ইংরেজি ভাষাতেও তিনি কয়েকখানি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। তাঁর শান্ডিল্যসূত্র-এর ইংরেজি টীকা গ্রন্থখানি পাশ্চাত্য পন্ডিত সমাজে সমাদর লাভ করে। ইংরেজি, বাংলা ছাড়াও সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, গুর্খা, গুরুমুখী, ওড়িয়া প্রভৃতি ভাষায় তাঁর বিশেষ জ্ঞান ছিল। বেদবেদান্তাদিতেও যে তিনি একজন সুপন্ডিত ছিলেন, তাঁর প্রমাণ বহন করে তার লিখিত গ্রন্থগুলি। তাঁর শাস্ত্রজ্ঞানের পরিচয় পেয়ে বঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যার পন্ডিতমন্ডলী কলকাতার সংস্কৃত কলেজে বর্ধমানাধিপতির সভাপতিত্বে তাঁকে ‘বেদান্ত বাচস্পতি’ উপাধি প্রদান করেন। অসামান্য পান্ডিত্যের জন্য তিনি ‘বিদ্যাবারিধি’ উপাধিও লাভ করেন।
তিনি ১৮৮৯ সালে সম্মিলনী ইনস্টিটিউশন যশোর নামক উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি লোহাগড়া উচ্চ বিদ্যালয়েরও প্রতিষ্ঠাতা। পরবর্তীকালে তাঁর লোহাগড়া বাড়িতে লোহাগড়া আদর্শ মহাবিদ্যালয় এবং তাঁর যশোর শহরস্থ বাড়িতে আদর্শ উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হয়। যশোরের সুফলাকাঠি হাইস্কুল, রাজঘাট হাইস্কুল, বরিশালের কদমতলা হাইস্কুল তাঁরই প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠিত হয়। যশোর জেলা বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে তিনি বহু প্রাইমারি, এম.ই.ও হাইস্কুল এবং কয়েকটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে সাহায্য করেন। ১৯০২ সালে তিনি রায়বাহাদুর উপাধি লাভ করেন। ১৯৩২ সালের ২৪ অক্টোবর ৭৪ বছর বয়সে বর্তমান মাগুরা জেলার ধয়ালপুর নামক স্থানে যদুনাথ মজুমদার মৃত্যুবরণ করেন। [বেনজিন খান]