মঙ্গলকোট২

মঙ্গলকোট২  পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহকুমাধীন কুনুর নদীর ডান তীরে অবস্থিত। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নস্থল। অজয় নদের সঙ্গে কুনুর নদীর মিলনস্থল পর্যন্ত এর ধ্বংসাবশেষ বিস্তৃত। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ১৯৮৬-৯০ সালের মধ্যে এই প্রত্নস্থলটিতে উৎখনন কার্য পরিচালনা করে।

মঙ্গলকোটে পাঁচটি প্রধান সাংস্কৃতিক স্তর বা পর্বের সন্ধান পাওয়া গেছে। প্রথম স্তরে তাম্র-প্রস্তর যুগীয় সংস্কৃতির নিদর্শন হিসেবে কালো ও লাল রঙের বৈশিষ্ট্যমন্ডিত মৃৎপাত্রের সন্ধান মিলেছে। অন্যান্য নিদর্শনাদির মধ্যে রয়েছে লাল মৃৎপাত্রের টুকরা বা ফালি; সঙ্গে তামাটে, কমলা, গাঢ় বাদামি এবং দীপ্তিমান লোহিত মৃন্ময়। তবে কালো মসৃণ ও অমসৃণ মৃৎপাত্রের টুকরার সংখ্যাই অধিক। কিছু মাটির পাত্র সাদা বা কালো রঙের চিত্র দ্বারা অলঙ্কৃত। সাধারণভাবে ব্যবহূত হাতিয়ারগুলি ছিল হাড়ের তৈরী। একেবারে নিম্নস্তর থেকে লোহা ব্যবহারের প্রমাণ এ সাংস্কৃতিক পর্বের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। রেডিওকার্বন পদ্ধতির ভিত্তিতে এ পর্বের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছে ১০০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ। প্রথম ও দ্বিতীয় স্তরের অন্তর্বর্তীকালীন সময়ে মৃৎশিল্প জাতীয় নিদর্শন হিসেবে লাল, বাদামি, ধূসর ও কালো রঙের সাধারণ মানের মৃৎপাত্রের টুকরা; কালো ও লাল রঙের অপকৃষ্ট শ্রেণির মৃৎপাত্রের টুকরা এবং পূর্ববর্তী স্তরের মৃৎপাত্রের নিদর্শন পাওয়া গেছে। দ্বিতীয় স্তরের প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে লৌহ নির্মিত বিপুল সংখ্যক তীরের অগ্রভাগ, বাটালি ও ছুরির ফলা ইত্যাদি। এ সামগ্রীগুলি থেকে লোহা ব্যবহারের ক্রমবৃদ্ধি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। অবশ্য এ সময় হাড়ের সামগ্রী ব্যবহারেরও প্রচলন ছিল।

একদিকে কালো ও লাল মৃৎপাত্রের অনুপস্থিতি এবং অন্যদিকে কয়েক ধরনের নতুন মৃৎশিল্পের উদ্ভব তৃতীয় সাংস্কৃতিক স্তরকে (মৌর্য-শূঙ্গ আমল: আনুমানিক ৩০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১ম খ্রিস্টপূর্বাব্দের শেষ পর্যন্ত) বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। নতুন মৃৎ সামগ্রীর মধ্যে নকশাবিহীন ও নকশাঙ্কিত উভয় প্রকারের লাল, ধূসর ও কালো মৃৎপাত্রের টুকরা এবং উত্তর ভারতীয় কালো মসৃণ মৃৎপাত্রের (Northern Black Polished Ware) অপকৃষ্ট ধরনের অল্প কিছু নমুনা রয়েছে। এ স্তরের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য সামগ্রীর মধ্যে রয়েছে একটি ছাপাঙ্কিত তাম্র মুদ্রা, লেখবিহীন তাম্র মুদ্রা এবং মৌর্য-শূঙ্গ শিল্পরীতির বেশ কিছু পোড়া মাটির মূর্তি। চতুর্থ স্তরটি কুষাণ সাংস্কৃতিক পর্বের একটি সমৃদ্ধিসূচক সময়কে তুলে ধরে। এ স্তরে মঙ্গলকোট প্রত্নস্থলে সম্ভবত সর্বপ্রথম ইটের রৈখিক বা লম্বালম্বি কাঠামো দৃষ্টিগোচর হয়। ফুল ও জ্যামিতিক অলঙ্করণের সুস্পষ্ট ছাপ সম্বলিত শক্ত লাল মৃৎপাত্র হচ্ছে এ যুগের অন্যতম বৈশিষ্ট্যসূচক মৃৎ-সামগ্রী। এ পর্বের প্রাপ্ত আকর্ষণীয় প্রত্নসামগ্রীর মধ্যে বেশ কিছু সিলমোহর, নির্ধারিত ছাঁচে নির্মিত পোড়ামাটির মূর্তি (কোন কোন মূর্তি স্বচ্ছ বস্ত্র পরিহিত) রয়েছে। হাতে গড়া পুরুষ ও মহিলা উভয়েরই বেশ কিছু মূর্তি এই স্তরে পাওয়া যায়। পঞ্চম স্তরটি গুপ্তদের সমসাময়িক এবং একটি সমৃদ্ধ বস্ত্তগত জীবনের চিত্র তুলে ধরে। পূর্ববর্তী সময়ের মতো এ পর্বেও ব্যাপক নির্মাণ কর্মকান্ড দেখা যায়। লালচে বাদামি রঙের অলঙ্কৃত পাতলা মৃৎসামগ্রী এ যুগের বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করে। এ স্তরে নানা ধরনের প্রতীক সম্বলিত বহুসংখ্যক সিল পাওয়া গেছে। সিলে উৎকীর্ণ প্রতীকগুলির মধ্যে রয়েছে রেলিং ঘেরা বৃক্ষ, অর্ধ-শায়িত ষাঁড়, পূর্ণ কুম্ভ, স্তূপ, কটিদেশে হাত রেখে দন্ডায়মান রমণী; তাম্র ও ব্রোঞ্জের আংটি, কংকন বা চুঁড়ি, খাদযুক্ত দন্ড বা ছুড়ি, গোলাকার গর্তযুক্ত অসম্পূর্ণ বাটি ইত্যাদি।

পোড়ামাটি, কাঁচ, তাম্র ও বিভিন্ন ধরনের কম মূল্যবান পাথরের (Semi-precious stone) বিভিন্ন আকৃতি ও সাইজের অসংখ্য গুটিকা (beads) এ স্তরকে বৈশিষ্ট্যমন্ডিত করেছে। এ যুগে প্রাপ্ত পোড়ামাটির নিদর্শনাদি সংখ্যায় বেশি না হলেও গুপ্ত আমলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যসূচক গুণাবলি, যেমন নমনীয়তা, মসৃণতা এবং মানবদেহের কমনীয় উপস্থাপনা এগুলির মধ্যে পরিলক্ষিত হয়। মঙ্গলকোট প্রত্নক্ষেত্রে পরবর্তী (ষষ্ঠ স্তর) স্তরের পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। গুপ্ত-পরবর্তীকাল থেকে আরম্ভ করে এ পর্বটি মধ্যযুগের শেষ পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।

প্রত্নস্থলটি শনাক্তীকরণের কোন নির্দেশনা পাওয়া যায়নি। অথচ এ স্থানে উৎখনন কার্য থেকে প্রাপ্ত বিপুল মূল্যবান প্রত্নসামগ্রী প্রমাণ করে যে, মৌর্য আমল থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে এ প্রত্নস্থলটি সম্ভবত একটি পরিপূর্ণ নগরকেন্দ্র হিসেবে বিকাশ লাভ করেছিল।  [অমিতা রায়]