ভোক্তা আইন
ভোক্তা আইন ক্রেতাসাধারণের অধিকার সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে প্রণীত আইনবিধান। ক্রেতাদের সকল অধিকার আজ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। জাতিসংঘের নির্দেশ মোতাবেক সকল উন্নত দেশে ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে কনজুমার্স ল’ নামে বিবিধ আইন প্রণীত হয়েছে। তবে অনেক অনুন্নত দেশেই ক্রেতাদের অধিকার সংরক্ষণের আইনগত ব্যবস্থা এখনও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। এসব দেশে ক্রেতা-অধিকার সংরক্ষণের জন্য কঠোর আইন প্রণয়নের দাবিতে ক্রমান্বয়ে আন্দোলন গড়ে উঠছে। ক্রেতাদের অধিকার শুধু ন্যায্যমূল্যে সঠিক ও ভাল মানের পণ্য ক্রয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাস, ট্রেন অথবা বিমানে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যে ভ্রমণ করাও যেকোন যাত্রীর মৌলিক অধিকার। অর্থের বিনিময়ে যেকোন সময় ডাক্তারের নির্ভুল ও সঠিক প্রয়োজনীয় সেবা লাভও প্রতিটি রোগীর অধিকার। প্রকৃতপক্ষে প্রত্যেক ব্যক্তিই একজন ক্রেতা।
ক্রেতা-সমাজকে সুসংগঠিত করার জন্যই ১৯৬০ সালের এপ্রিল মাসে হল্যান্ডের হেগ নগরে অনুষ্ঠিত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম প্রভৃতি দেশের ক্রেতা সংগঠনের উদ্যোক্তাদের এক সম্মেলন। এ সম্মেলনেই গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ক্রেতা সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব কনজ্যুমার্স ইউনিয়ন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, পঞ্চাশের দশকে খোদ আমেরিকার কোনো কোনো ব্যবসায়ী পণ্য বিপণনের ক্ষেত্রে নানা ধরনের প্রতারণা ও ছলচাতুরির আশ্রয় গ্রহণ করত। কখনওবা একচেটিয়া ব্যবসার সুযোগে মাত্রাতিরিক্ত মূল্য দাবি করত, ওজনে কম দিত এবং ভেজাল পণ্য বিক্রি করে ক্রেতা সাধারণের সঙ্গে প্রতারণা করত। ফলে সাধারণ লোকের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি এ ক্ষোভ ও সঙ্কট উপলব্ধি করেই ১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ এক ঐতিহাসিক ঘোষণার মাধ্যমে ক্রেতাদের চারটি অধিকার সম্বলিত একটি বিল মার্কিন কংগ্রেসে অনুমোদন করেন। এরপর ধীরে ধীরে সারা পৃথিবীতে ক্রেতা সম্প্রদায়ের এ অধিকার স্বীকৃতি লাভ করে।
১৯৮৫ সালের ১৬ এপ্রিল জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে গৃহীত এক প্রস্তাবে ক্রেতা স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য সাতটি মূলনীতি গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে জাতিসংঘের সকল সদস্য-রাষ্ট্র ও সংগঠনকে উক্ত মূলনীতি বাস্তবায়নের নির্দেশ দেওয়া হয়। এভাবে সারা পৃথিবীতে ক্রেতা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এরপর বিভিন্ন সময়ে আরও আইন প্রণয়নের মাধ্যমে ক্রেতাদের অধিকার সুদৃঢ় করা হয়েছে। ক্রেতাদের এ স্বীকৃত সাতটি অধিকার হলো: (ক) নিরাপত্তার অধিকার অর্থাৎ যে পণ্য জনস্বাস্থ্য ও জীবনের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে তা বিপণন করা যাবে না; (খ) তথ্য লাভ বা জানার অধিকার অর্থাৎ যেকোন পণ্যের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে ক্রেতাকে অবশ্যই তথ্য সরবরাহ করতে হবে; আর এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানার অধিকার রয়েছে প্রত্যেক ক্রেতার; (গ) অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার অর্থাৎ ক্রেতাস্বার্থ পরিপন্থী যেকোন বিষয়ে অভিযোগ উত্থাপন করার অধিকার রয়েছে প্রতিটি ক্রেতার; (ঘ) ন্যায্যমূল্যে পছন্দমাফিক ও প্রয়োজনানুগ পণ্য ক্রয়ের অধিকার; (ঙ) ক্ষতিপূরণ লাভের অধিকার; (চ) পণ্য সম্পর্কে বিস্তারিত জানার অধিকার; এবং (ছ) স্বাস্থ্যকর পরিবেশ লাভের অধিকার।
বাংলাদেশে বেশ কিছু সচেতন শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক, সমাজসেবী, চিকিৎসক ও এনজিও বিশেষজ্ঞ ১৯৭৮ সালে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নামে একটি ক্রেতা সংগঠন গড়ে তোলেন। ১৯৯৭ সালে ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অব কনজ্যুমার্স ইউনিয়নের যে বিশ্বকংগ্রেস ফ্রান্সের মঁপলিয়ে শহরে অনুষ্ঠিত হয়, তাতেও এই সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এরপর পেনাংয়ে অনুষ্ঠিত সম্মেলনেও ক্যাবের ভূমিকার জন্য বাংলাদেশের সুনাম ও খ্যাতি বৃদ্ধি পায়। এ সংগঠনের উদ্যোগেই ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় দক্ষিণ এশীয় দেশগুলির প্রথম কনজ্যুমার্স সম্মেলন।
এ অঞ্চলে অর্থাৎ ভারত উপমহাদেশে ক্রেতা অধিকার আন্দোলনের ইতিহাস দীর্ঘদিনের নয়। শ্রীলংকা, নেপাল, ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার সকল দেশে ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য আইন রয়েছে, রয়েছে পৃথক আদালত। ভারতে কনজ্যুমার্স ল’ প্রণীত হলেও পাকিস্তান বা বাংলাদেশে এ ধরনের কোনো আইন এখনও প্রণীত হয় নি। বাংলাদেশে ক্রেতাদের স্বার্থ সংরক্ষণের ক্ষেত্রে সামগ্রিকভাবে আজ পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোনো আইন প্রণীত হয় নি। পাকিস্তান আমলে এমনকি ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইন আজও বহাল রয়েছে। এ আইন যেমন যুগোপযোগী নয়, তেমনি কার্যকরও নয়। আইনগুলি হলো: ১৯৪০ সালের ট্রেড মার্ক আইন; ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশ; ১৯৬১ সালের ওজন ও পরিমাপের মান অধ্যাদেশ; ১৯৮২ সালের ঔষধ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ; ১৯৮৪ সালের মায়ের দুধের বিকল্প শিশুখাদ্য অধ্যাদেশ।
বাংলাদেশে ক্রেতা ও ভোক্তা সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে দীর্ঘকাল ধরে বৈঠক ও আলোচনার পর কনজ্যুমার্স ল’ প্রণয়নের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। বাণিজ্য ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি এবং ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, পেশাজীবী ও ক্রেতা সংগঠনের প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত এই কমিটি আইনের একটি খসড়াও প্রণয়ন করে। এটি এখনও আইনে পরিণত হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। [বোরহান আহমদ]