ভেড়িবাঁধ

ভেড়িবাঁধ (Embankment)  মাটি অথবা শিলা দ্বারা নির্মিত উচুঁ পৃষ্ঠবিশিষ্ট প্রাচীর সদৃশ স্থাপনা। বন্যার পানি ধারণ ও প্রতিরোধ করা অথবা সড়ক, রেলপথ, খাল ইত্যাদি নির্মাণে এরূপ স্থাপনার প্রয়োজন হয়। প্রচলিত বাংলায় এটিকে কখনও কখনও বেড়িবাঁধও বলা হয়ে থাকে। অবস্থাভেদে ভেড়িবাঁধের প্রকৃতি এবং গঠন বিভিন্ন প্রকারের হয়ে থাকে। বিভিন্ন ধরনের ভেড়িবাঁধের মধ্যে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ একটি, যা বন্যা নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রতিরোধের লক্ষ্যে নির্মাণ করা হয়। নিম্নভূমি অঞ্চলে বন্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে নদীতীর এবং তীরভূমি থেকে কিছুটা দূরে বন্যার পানি ধরে রাখার জন্য নির্মিত ভেড়িবাঁধকে কান্দা বা জলস্রোত প্রতিরোধী বাঁধও বলা হয়, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলা হয় লেভি (levee) বা ডাইক (dyke)। এই ধরনের বাঁধের অভ্যন্তরে পানি প্রবেশ এবং নির্গমের ব্যবস্থা থাকতে পারে আবার নাও পারে। এই উপমহাদেশে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন ভেড়িবাঁধ নির্মাণের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সুলতানি শাসনামলে (১২১৩-১৫১৯ খ্রিষ্টাব্দ)। সুলতান গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ খিলজী তাঁর রাজধানী লখনৌতিকে বন্যার কবল থেকে রক্ষার জন্য কয়েকটি ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করেন। তাঁর সময়েই প্রায় ১৫০ মাইল দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট গ্রান্ড ট্রাঙ্ক সড়ক নির্মিত হয়, যা একই সঙ্গে বন্যা প্রতিরোধে ভেড়িবাঁধ হিসেবেও কাজ করত। মুগল সম্রাটগণও বিভিন্ন বড় বড় নদ-নদীর গতিপথে ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করেছিলেন।

বাংলাদেশে সমুদ্র উপকূলবর্তী ভেড়িবাঁধসমূহ নির্মাণ শুরু হয় সপ্তদশ শতকের শুরুতেই। জমিদারদের কর্তৃত্বাধীন এসব উদ্যোগ ছিল মূলত বেসরকারি। ব্যাপক পরিসরে বন্যা নিয়ন্ত্রণ ভেড়িবাঁধ নির্মাণের ক্ষেত্রে পরিকল্পনা মাফিক উন্নয়ন কর্মকান্ডের সূত্রপাত ঘটে ১৯৬০- এর দশকে। সে সময় থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এবং নদী তীরবর্তী অঞ্চলে বহু কিলোমিটার ভেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে। এই বাঁধগুলি কৃষি ও অন্যান্য অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে উপযুক্ত পরিবেশ রক্ষায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে।

গত কয়েক দশক জুড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কর্মকান্ডের আওতায় সম্পাদিত হয়েছে মোট ৭,৫৫৫ কিমি দীর্ঘ ভেড়িবাঁধ (এর মধ্যে সমুদ্র তীরবর্তী ভেড়িবাঁধের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪,০০০ কিমি) নির্মাণ। মোট ৭,৯০৭টি জল কাঠামো বা জল স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে যা পানির প্রবাহ কাজে লাগানোর জন্য ব্যবহূত হয় (এর মধ্যে স্লুইস বা জলকপাট ব্যবস্থাও অন্তর্ভুক্ত) এবং প্রায় এক হাজার পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রক বা রেগুলেটর স্থাপিত হয়েছে। সারাদেশে ১,০৮২টি নদীর প্রবাহ রোধকারী বাঁধ নির্মাণ এবং ৩,২০৪ কিমি দীর্ঘ নিষ্কাশন খাল খনন করা হয়েছে। সর্বমোট ৩৩২টি প্রকল্পাধীন এই কর্মসূচির মাধ্যমে ৩৫ লক্ষ হেক্টর ভূমিকে বন্যামুক্ত করা গেছে। এই প্রক্রিয়ায় দেশের মোট ভূমির ২৪ শতাংশ এবং চাষযোগ্য জমির ৩৯ শতাংশকে বন্যা কবলমুক্ত রাখা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া এই কর্মসূচির আওতায় রয়েছে প্রাকৃতিক অববাহিকার জলাবদ্ধতা দূরীকরণ, নদীর স্রোতধারাকে বেগবান করা, নদীর গতিধারার পরিবর্তন, তীর রক্ষা এবং নদীভাঙন প্রতিরোধমূলক কর্মকান্ড। প্লাবনভূমিতে নির্মিত ভেড়িবাঁধ ছাড়াও ঔপনিবেশিক আমলে নির্মিত রেলপথ, উঁচু ও দীর্ঘ সড়কগুলো বন্যার প্রকোপ এবং বিস্তৃতি নিরোধে সহায়ক ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের প্রধান ভেড়িবাঁধগুলোর সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত হলো:

ব্রহ্মপুত্রের ডান তীরস্থ ভেড়িবাঁধ  ১৯৬০-এর দশকে প্রথম পর্যায়ের নির্মিত ভেড়িবাঁধগুলোর একটি। ব্রহ্মপুত্র, যমুনা এবং তিস্তা নদীর পশ্চিম প্রান্ত জুড়ে প্রায় ১,৩০,০০০ হেক্টর বিস্তৃত ভূমির বন্যা প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়। এর দৈর্ঘ্য ২১৭ কিমি, উত্তরে রংপুর জেলার কাউনিয়া থেকে দক্ষিণে সিরাজগঞ্জ জেলার বেড়া পর্যন্ত এই বাঁধ বিস্তৃত। এই বাঁধটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ১৯৬৩ সালে এবং ১৯৬৮ সালে এর কাজ সমাপ্ত হয়, নির্মাণ ব্যয় ছিল প্রায় ৮ কোটি টাকা। বাঁধটির গড় উচ্চতা ৪.৫ মিটার, উচ্চপৃষ্ঠের প্রশস্ততা ৬ মিটার এবং উভয় পার্শ্বে ঢালের অনুপাত ১:৩। এই ভেড়িবাঁধটি বর্তমানে যমুনার ব্যাপক ভাঙনের ফলে হুমকির সম্মুখীন। নদীতীর থেকে আরও কিছুদূরে নতুন স্থান নির্বাচন করে বাঁধটির পুনর্নির্মাণ জরুরি।

গোমতি বাঁধ  কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত এই ভেড়িবাঁধ কটকবাজার থেকে গোমতি নদীর বাম তীরে ৬৭ কিমি দীর্ঘ এবং নদীর ডান তীরে গোলাবাড়ি থেকে দাউদকান্দির গৌরীপুর পর্যন্ত প্রলম্বিত, ৬৪ কিমি দীর্ঘ। গোমতি বাঁধ প্রায় ৩৭,৪৪০ হেক্টর ভূমিকে বন্যা থেকে রক্ষা করছে। ভেড়িবাঁধটির গড় উচ্চতা ৪.৫ মিটার এবং উচ্চপৃষ্ঠের প্রশস্ততা ৪.২৭ মিটার। নদীর দিকে পার্শ্বঢালের অনুপাত ১:৩ এবং তীরভূমির দিকে পার্শ্বঢালের অনুপাত ১:২। এই বাঁধটি সর্বপ্রথম মুর্শিদকুলী খাঁর শাসনামলে (১৭০৪-১৭২৭) নির্মিত হয়, কিন্তু ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক এবং পাকিস্তানি শাসনামলে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বাঁধটির প্রভূত ক্ষতি সাধিত হয়। অবশ্য ১৯৮৬-৮৭ অর্থ বৎসরে গোমতি বাঁধের পুনর্নির্মাণের কাজ আরম্ভ হয় এবং তা ১৯৯১-৯২ অর্থ বৎসরে শেষ হয়। বাঁধটির পুনর্নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১২৩ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা।

খোয়াই বাঁধ  হবিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত এই ভেড়িবাঁধটি এলাকার ২৫,৭৯০ হেক্টর ভূমিকে বন্যা থেকে রক্ষা করছে। খোয়াই নদীর ডান তীর জুড়ে হবিগঞ্জ থেকে চুনারুঘাট পর্যন্ত বিস্তৃত বাঁধটি ৪০ কিমি দীর্ঘ এবং বাম তীরের বাঁধটি হবিগঞ্জ থেকে রাজাবাজার পর্যন্ত ৪৭ কিমি দীর্ঘ।

অনেক ক্ষেত্রে ভেড়িবাঁধসমূহ বিভিন্ন সেচ প্রকল্পের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবেও নির্মিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ- চাঁদপুর সেচ প্রকল্পের আওতায় মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর তীর জুড়ে ১০০ কিমি দীর্ঘ ভেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে, মেঘনা-ধনাগদা সেচ প্রকল্পের আওতায় মেঘনা নদীতে ৬৫ কিমি, মনু নদী প্রকল্পের আওতায় মনু ও কুশিয়ারা নদীতে ৫০ কিমি এবং তিস্তা ব্যারেজ প্রকল্পের আওতায় তিস্তা নদীতে ৮০ কিমি দীর্ঘ ভেড়িবাঁধ নির্মিত হয়েছে।

সমুদ্র উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্প (সিইপি)  বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় জেলাসমূহ এই প্রকল্পভুক্ত। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ভোলা, বরিশাল, পটুয়াখালি, ঝালকাঠি, বরগুনা, পিরোজপুর, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট জেলার বিস্তৃত এলাকা জুড়ে সমুদ্র উপকূলীয় ভেড়িবাঁধ প্রকল্প বা সিইপি।

বাঁধনির্মাণ এবং পানি নিষ্কাশনে আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর জটিল কার্যক্রম ভিত্তিক এই প্রকল্পে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয় স্লুইস গেইট বা জলকপাট দ্বারা। সেই সঙ্গে পানি অপসারণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাও এখানে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় বন্যা এবং লবণাক্ত পানির অবাঞ্ছিত অনুপ্রবেশ প্রতিরোধে এটি প্রথম একটি ব্যাপক ও কার্যকর পরিকল্পনা হিসেবে চিহ্নিত। প্রকল্পটি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক পরিচালিত। ১৯৬১ থেকে ১৯৭৮ সালের মধ্যে দুই পর্বে এটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রথম পর্বে প্রকল্পভুক্ত ছিল ৯২টি পোল্ডার নির্মাণ, যার মাধ্যমে ১০ লক্ষ হেক্টর ভূমি প্রকল্প সুবিধার আওতায় আসে। পোল্ডার (Polder) একটি ডাচ (Dutch) শব্দ, যার অর্থ বন্যা নিরোধের জন্য নির্মিত মাটির দীর্ঘ বাঁধ (ডাইক) দ্বারা বেষ্টিত এলাকা। দ্বিতীয় পর্বে ১৬টি পোল্ডারে আরও চার লক্ষ হেক্টর ভূমি উদ্ধার সম্ভব হয়। সিইপির আওতায় এ পর্যন্ত ৪,০০০ কিমি-এর অধিক দীর্ঘ ভেড়িবাঁধ এবং ১,০৩৯টি নিষ্কাশন জলকপাট বা স্লুইস গেইট নির্মিত হয়েছে। সব ধরনের ডাইককে ভেড়িবাঁধ শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমুদ্র ডাইকগুলো মূলত বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী এলাকায় সমুদ্রের মুখে অথবা প্রশস্ত নদীগুলির তীরে অবস্থিত। এসব স্থানে উঁচু ঢেউরাজি মোকাবেলায় এই বাঁধগুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। উপকূলীয় এলাকার অভ্যন্তরভাগে নদীর তীরভূমিতে, যেখানে সাধারণত বিশাল ঢেউরাজির সৃষ্টি হয় না এমন স্থানে, নির্মিত হয় অভ্যন্তরীণ ডাইক এবং প্রান্তবর্তী ডাইক নির্মাণ করা হয় স্রোতধারাগুলোর সেসব অঞ্চলে যেখানে স্রোত ও ঢেউ অত্যন্ত কম থাকে। নিম্নে এই তিন ধরনের চিরায়ত প্রকৃতির ভেড়িবাঁধ সম্পর্কে কিছু তথ্য উল্লেখ করা হলো:

ডাইকের ধরন পার্শ্বঢাল উচ্চপৃষ্ঠে প্রশস্ততা মি ফ্রি বোর্ড মি তীর থেকে দূরত্ব মি
মালভৃমির দিকে সমুদ্র.নদীর দিকে
সমুদ্র ডাইক ২:১ ৭:১ ৪.২ ১.৫ ৭৫
অভ্যন্তরীণ ডাইক ২:১ ৩:১ ৪.২ ৯.৯ ৫০
প্রান্তীয় ডাইক ১:১ ২:১ ২.৪ ০.৯ ৪০

উল্লিখিত ভেড়িবাঁধ জোয়ার প্লাবন থেকে ভূমিকে রক্ষা করতে কার্যকর, কিন্তু বাঁধের উচ্চতা ছাড়িয়ে যাওয়া ঘূর্ণিবাত্যামূলক জলোচ্ছ্বাস ও জোয়ার জলোচ্ছ্বাসের ক্ষয়ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে পারে না। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধিতে ইতিবাচক ভূমিকার পাশাপাশি এ সকল বাঁধ সড়ক যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, যা উপকূলীয় অঞ্চলের সার্বিক আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নে গতিশীলতার সঞ্চার করেছে।

ভেড়িবাঁধসমূহ নদীর স্বাভাবিক গতিপথের পরিবর্তন ঘটায়। এই নদীশাসন, জোয়ার ভাটার স্রোতধারায় এবং বাঁধের জলকপাটসমূহের নির্গম পথে পলি জমার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। এ ধরনের নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সর্বাপেক্ষা মারাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছে খুলনা অঞ্চলে। সেখানে উচ্চভূমি অঞ্চল থেকে নদীবাহিত পলি অধিক মাত্রায় সঞ্চিত হচ্ছে। ফলে এ এলাকার নিম্নভূমি বা বিভিন্ন পোল্ডারে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। পলি সঞ্চয়নের ফলে নদীর নাব্য কমে যাচ্ছে এবং প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এর কারণসমূহ চিহ্নিত করার জন্য এপর্যন্ত বেশ কিছু গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। এসব গবেষণা কর্মের ওপর ভিত্তি করে সিইপি ১৯৮৮ সাল থেকে দুর্বল পানি নিষ্কাশণ ব্যবস্থা এবং জলাবদ্ধতা দূরীকরণের লক্ষ্যে সংস্কার মূলক কর্মসূচি বাস্তবায়ন শুরু করেছে। সেক্ষেত্রে চিহ্নিত নদীগুলির নাব্য বৃদ্ধির জন্য খননকার্য এবং জীর্ণ ও অকার্যকর জলকপাটগুলোর মেরামত, প্রয়োজনে নতুন করে স্থাপনসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। [এম আমিনুল ইসলাম এবং মোঃ ফজলুল বারী]