ভুলুয়া

ভুলুয়া পূর্ববঙ্গের একটি প্রাচীন জনপদ ও ত্রিপুরারাজদের করদরাজ্য। বৃহত্তর নোয়াখালী জেলাই এক সময় এ নামে পরিচিত ছিল। ইতিহাসসমৃদ্ধ সেই জনপদ ভুলুয়া এখন নোয়াখালী শহরের কয়েক মাইল পশ্চিমে লক্ষ্মীপুর সড়কসংলগ্ন একটি গ্রামমাত্র। জনশ্রুতি অনুসারে, মিথিলার রাজা আদিশূরের জনৈক বংশধর কর্তৃক তেরো শতকে এ রাজ্যের পত্তন হয়। মেঘনা নদীর সান্নিধ্যহেতু বলা হয়ে থাকে যে, ফখরুদ্দীন মুবারক শাহ সোনারগাঁও থেকে ভুলুয়া আক্রমণ করেছিলেন।

ত্রিপুরারাজের অনুগত স্থানীয় শাসকরা একটি বিশাল এলাকা শাসন করতেন, যা নিয়ে বর্তমানের বৃহত্তর নোয়াখালী জেলা গঠিত। আরাকানের শক্তিশালী রাজার অধীনস্ত চট্টগ্রামে যাওয়ার পথকে নিয়ন্ত্রণ করত বলেই এ অঞ্চলটির একটি কৌশলগত গুরুত্ব ছিল। সতেরো শতকে  মগ ও  ফিরিঙ্গি জলদস্যুদেরসহ আরাকানরাজ মুগল সাম্রাজ্যের বিস্তারের ক্ষেত্রে এক বড় বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। পরে অবশ্য মুগলরা ভুলুয়া জয় করে এবং সেখানে সোনারগাঁও সরকারের অধীনে ভুলুয়া পরগনার প্রশাসনিক কেন্দ্র স্থাপিত হয়।

আঠারো শতকে ইংরেজদের লবণ বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ভুলুয়া বিশেষ পরিচিতি লাভ করে। ভুলুয়া প্রথমে নবপ্রতিষ্ঠিত ত্রিপুরা জেলার (১৭৯৯) অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু নানা রকম অসুবিধা এবং ভুলুয়ায় লবণ ব্যবসায়ীদের অবস্থানগত কারণে উদ্ভূত প্রশাসনিক সমস্যার জন্য ১৮২২ সালে তা ত্রিপুরা থেকে বিযুক্ত হয় এবং পার্শ্ববর্তী জেলাসমূহের সন্নিহিত অঞ্চল নিয়ে একটি নতুন জেলা গঠিত হয়। পরবর্তীকালে এর প্রশাসনিক কেন্দ্র ভুলুয়া থেকে নোয়াখালীতে স্থানান্তর করা হয়।

নোয়াখালী জেলার বৃহত্তম পরগনা ভুলুয়ার আয়তন ছিল ৬৩৫.৮৫ বর্গ কিমি এবং সেখান থেকে রাজস্ব আদায় হতো মোট ১,২৩,৯২৯ টাকা। ১৭২৮ সালের সেটেলমেন্টে রাজা কীর্তিনারায়ণের নামে ভুলুয়া রেকর্ড করা হয়। ১৭৮৮ সালে রাজ্যের চার-আনা অংশ পাইকপাড়া পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা গঙ্গাগোবিন্দ সিং-এর নিকট বিক্রি করা হয়। ১৮৩৩ সালে বকেয়া রাজস্ব পরিশোধের জন্য সমগ্র ভুলুয়া রাজ্য বিক্রয় করা হয়।  দ্বারকানাথ ঠাকুর রাজ্যটি ক্রয় করেন। পরিশেষে তিনিও তিন লক্ষ টাকা মূল্যে পাইকপাড়া পরিবারের রানী কাত্যায়নীর নিকট তা বিক্রি করে দেন। ১৯২০ সালের মধ্যে রাজ্যের অধিকাংশ পত্তন দেওয়া হয়। এভাবে সতেরো শতকে নির্মিত একটি মুগল দুর্গের ধ্বংসাবশেষ ব্যতীত ভুলুয়া তার ভূ-রাজনৈতিক অস্তিত্বের শেষ ঐতিহ্য-চিহ্নটুকুও হারায়। ১৮৪৫ সালের দিকে পৃথক রাজ্য হিসেবে ভুলুয়ার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হয়।  [শিরীন আখতার]