ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭৮৭-১৮৪৮) লেখক, সাংবাদিক, কলকাতার রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের অন্যতম নেতা। কলকাতার নিকট একটি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। স্বশিক্ষিত ভবানীচরণ ফার্সী, সংস্কৃত ও ইংরেজিসহ বেশ কয়েকটি ভাষা আয়ত্ব করেছিলেন। ইংরেজি জানার কারণে বিশপ হেবার, বিশপ মিডলটন এবং প্রধান বিচারপতি পুলারসহ বেশ কয়েকজন নামী ইংরেজের অধীনে তিনি কাজ করার সুযোগ লাভ করেন।
রামমোহন রায়-সম্পাদিত সম্বাদ-কৌমুদী পত্রিকায় ১৮২১ সালের ডিসেম্বর মাস সাংবাদিকতার কাজ আরম্ভ করেন। এ কাজের দ্বারা পরে তিনি কলকাতার একজন বিশিষ্ট নাগরিক হিসেবে নিজেকে যোগ্য করে তোলেন। রামমোহন সতীদাহ প্রথা নিষিদ্ধ করার পক্ষে আন্দোলন পরিচালনা করলেও, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন সতীদাহ প্রথার একজন কট্টর সমর্থক। ফলে দুজন মাস দুয়েকের বেশি একত্রে কাজ করতে পারেননি। তখন ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একটি ছাপাখানা কিনে ১৮২২ সালের মার্চ মাসে সমাচার চন্দ্রিকা নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং এ পত্রিকা রক্ষণশীল হিন্দুদের মুখপত্রে পরিণত হয়। বস্ত্তত, তিনি একই সঙ্গে শ্রীরামপুরের ব্যাপটিস্ট মিশনারিদের সমাচার-দর্পণএবং রামমোহনের সংস্কারপন্থি সম্বাদ-কৌমুদী পত্রিকা, উভয়ের বিরুদ্ধে প্রচার আরম্ভ করেন।
ইংরেজ কর্মকর্তা এবং পাশ্চাত্য সংসর্গের মাধ্যমে ধনী হলেও তিনি ছিলেন প্রচন্ড রক্ষণশীল। হিন্দু কলেজের পশ্চিমা-প্রভাবিত ছাত্রদের এবং তাদের লোকাচার-বিরোধী জীবনযাত্রার তীব্র সমালোচনামুখর ছিল তাঁর পত্রিকা। তবে ইউরোপীয়দের সংস্পর্শে আসা যে নব্যধনী শ্রেণি অপরিমিত বিলাসিতা এবং ইন্দ্রিয়পরায়ণতার জীবন যাপন করত, তিনি তাদেরও কঠোর সমালোচনা করেন।
ভবনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম গ্রন্থ কলিকাতা কমলালয় প্রকাশিত হয় ১৮২৩ সালে। এ গ্রন্থে তিনি কলকাতার জীবনযাত্রার পরিচয় তুলে ধরেন বিশেষ করে নব্য ধনীদের উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রা। ১৮২৫ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর নববাবুবিলাস এবং ১৮৩১ সালে নববিবিবিলাস। নববাবুবিলাস গ্রন্থে তিনি নব্যধনীদের অসংযমী জীবনযাত্রাকে বিদ্রূপবাণে বিদ্ধ করেন। পরে প্যারীচাঁদ মিত্র আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৪-৫৮) নামে যে প্রথম বাংলা উপন্যাস প্রকাশ করেন, নববাবুবিলাস তার পথ দেখিয়েছিল। ভবনীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস রচনা না করলেও, তিনি বাংলা ভাষায় প্রথম সৃজনশীল গদ্য লেখেন। তাঁর অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে দূতীবিলাস (১৮২৫), শ্রীশ্রী গয়াতীর্থ (১৮৩১) এবং আশ্চর্য্য উপাখ্যান (১৮৩৫) উল্লেখযোগ্য। তার রচনার তীব্র বিদ্রূপ এবং রঙ্গব্যঙ্গ পাঠকদের আকৃষ্ট করে।
ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় কেবল লেখক এবং সাংবাদিক হিসেবেই নয়, রক্ষণশীল হিন্দু সমাজের একজন প্রধান নেতা হিসেবেও তিনি পরিচিত ও খ্যাতিমান ছিলেন। সদ্য নিষিদ্ধ ঘোষিত সতীদাহ প্রথা চালু রাখার উদ্দেশে ১৮৩০ সালে রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ধর্মসভা স্থাপিত হলে, ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্পাদক মনোনীত হন। পরবর্তী জীবন তিনি এ পদেই অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৮৪৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। [গোলাম মুরশিদ]