ভগবদ্গীতা

ভগবদ্গীতা  হিন্দুদের অন্যতম প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এটি  সংস্কৃত মহাভারতের ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত এবং  উপনিষদ শ্রেণীর গ্রন্থ। দ্বাপর যুগে কুরু-পান্ডবের মধ্যে সংঘটিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রাক্কালে অর্জুন প্রতিপক্ষে উপস্থিত আত্মীয়-স্বজনদের দেখে স্নেহমমতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন এবং যুদ্ধ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তখন সারথি শ্রীকৃষ্ণ  ক্ষত্রিয় বীরের কর্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অন্যায়-অত্যাচার থেকে পৃথিবীকে মুক্ত করা এবং ধর্ম সংস্থাপনের জন্য অর্জুনকে যে উপদেশ দেন, তাই শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, সংক্ষেপে ভগবদ্গীতা বা শুধু গীতা নামে পরিচিত। ভীষ্মপর্বের অন্তর্গত আঠারোটি অধ্যায় নিয়ে গীতার কলেবর রচিত। এখানে রয়েছে সাতশ শ্লোক; এজন্য গীতাকে সপ্তশতীও বলা হয়। গীতার প্রবক্তা শ্রীকৃষ্ণ, আর শ্রোতা অর্জুন।

গীতা একাধারে ধর্ম,  দর্শন ও কাব্যগ্রন্থ। ভারতীয় দর্শনের অন্যতম ভিত্তি ভগবদ্গীতা। এতে  বেদবেদান্ত, উপনিষদ প্রভৃতি গ্রন্থে বর্ণিত দার্শনিক তত্ত্বের সার সংগৃহীত হয়েছে। এছাড়া ধর্মতত্ত্ব, জ্ঞানতত্ত্ব, সমাজতত্ত্ব, রাজনীতি, গার্হস্থ্যনীতি ইত্যাদি সম্পর্কেও আলোচনা রয়েছে। তাই একে সকল ধর্মগ্রন্থের সারগ্রন্থও বলা হয়। কর্ম-জ্ঞান-ভক্তি-যোগ প্রভৃতি অনুশীলনের মাধ্যমে মানুষ যাতে অভীষ্ট ঈশ্বর বা মুক্তি লাভ করতে পারে তার দিকনির্দেশনা রয়েছে এই গীতা গ্রন্থে।

গীতায় ক্ষত্রিয় অর্থাৎ যোদ্ধার কর্তব্য এবং আত্মার অবিনাশিতা ধর্ম সম্পর্কে  কৃষ্ণ অর্জুনকে যে উপদেশ দিয়েছেন তার দ্বারা বিশ শতকে ভারতীয় বিপ্লবী ও স্বাধীনতাকামীরা প্রবলভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের হাতেই একখানা করে গীতা থাকত। গীতাপাঠে তাঁরা দেশের স্বাধীনতার জন্য আত্মোৎসর্গে শক্তি সঞ্চয় করতেন; মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করে মাতৃভূমির শৃঙ্খল মুক্ত করতে আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ হতেন।

গীতার শিক্ষা হচ্ছে ধর্মে উদারতা, কর্মে নিষ্কামতা, জ্ঞানে ব্রহ্মভাব ও সর্বভূতে ভগবদ্ভাব, যোগে বা ধ্যানে ভগবানে চিত্তসংযোগ, ভক্তিতে ভগবদ্শরণাগতি, নীতিতে সাম্যদৃষ্টি, উপাসনায় ভগবদ্কর্ম, জীবসেবা ও স্বধর্ম পালন এবং সাধনায় ত্যাগানুশীলন।

গীতা হিন্দুদের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নিত্য গীতাপাঠ, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে গীতাপাঠ ও ব্রাহ্মণকে গীতাদান হিন্দুসমাজে পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হয়। এছাড়া নিয়মিত বেতার-টেলিভিশনে এবং জাতীয় অনুষ্ঠানমালায়ও গীতা পাঠ করা হয়।  [পরেশচন্দ্র মন্ডল]