ভক্তিবাদ

ভক্তিবাদ  সংস্কৃত ‘ভজ্’ ধাতু থেকে ভক্তি শব্দের ব্যুৎপত্তি। ভক্তির মূল কথা ঈশ্বরের প্রতি অশেষ অনুরাগ। বাউল কবি সেজন্য বলেন, ‘জ্ঞানের অগম্য তিনি প্রেমের ভিখারী।’ অপরদিকে ‘নিত্য তোমারে চিত্ত ভরিয়া স্মরণ করি’ সম্ভবত ভক্তির চরম কথা। হিন্দু ধর্মে ভক্ত কর্তৃক আপন দেবতাকে পুজা অর্চনার বদলে  বিনত-ভালবাসার মাধ্যমে দেবতার নিকট আত্মোৎসর্গই ভক্তি। ভগবদ্ভক্তির মাধ্যমে মুক্তি লাভ মতবাদের প্রথম উদ্ভব দক্ষিণ ভারতে এবং এর মূল সুর অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের বিপরীত অর্থাৎ মুক্তি লাভের উপায় পূজা-অর্চনা নয়। এর উপায় আত্মোৎসর্গ ও ভগবদ্ভক্তি। ভক্তিবাদমতে ভগবান ও ভক্তি অভিন্ন, ভক্ত ও ভগবান অভিন্ন সত্তা। ভক্তি-মার্গের অনুসারীরা মুক্তি লাভের অন্যান্য মার্গও স্বীকার করেন, যেমন জ্ঞান-মার্গ (জ্ঞানের মাধ্যমে মুক্তি), কর্ম-মার্গ (পুজা-অর্চনা ও ভাল কাজের মাধ্যমে মুক্তি) ও যোগসাধনার মাধ্যমে শরীরকে রিপুমুক্ত করার মাধ্যমে মুক্তি ইত্যাদি। ভক্তিবাদের অনুসারীরা মনে করেন সব মার্গের সেরা মার্গ ভক্তি-মার্গ। ভক্তিবাদে জাতি, শ্রেণি ও বর্ণভেদ নেই। সকল জাতি, শ্রেণি ও বর্ণ, সকল পুরুষ ও স্ত্রী ভক্তিবাদ মন্দিরে অবারিত।

হিন্দু ধর্মের বিষ্ণু, শিব ও শক্তি এ ত্রি-ঈশ্বর পূজাপদ্ধতির মধ্যেই কমবেশি ভক্তি উপাদান সন্নিহিত। তবে ভক্তিবাদ-উৎসারিত হয়েছে মূলত বিষ্ণু থেকে প্রধানত বিষ্ণরু দুই পার্থিব অবতার রাম ও কৃষ্ণকে কেন্দ্র করে। জনপ্রিয় দুই মহাকাব্য মহাভারত ও রামায়ণ এবং পুরাণ হিন্দু ধর্মে অসংখ্য মতবাদের সৃষ্টি করেছে। এর অন্যতম হলো ভক্তিবাদ যার কেন্দ্রবিন্দু রাম ও কৃষ্ণ। মনুষ্যরূপে এ দুই ভগবানকে ভালবাসা ও ভক্তির মাধ্যমে লাভ করাই ভগবদ্ভক্তি বা ভক্তিবাদ। সপ্তম ও দশম খ্রিস্টাব্দের মধ্যে দাক্ষিণাত্য থেকে ভক্তিবাদ আন্দোলন উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। ভক্তিবাদকে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয় অসংখ্য চমৎকার সাহিত্য ও শিল্পকর্ম। এসব সাহিত্য ও শিল্পকর্মের প্রভাব পড়ে বিভিন্ন শ্রেণীর ধর্মচর্চায়। সাহিত্যে ভগবানের প্রতি বিমূর্ত ভক্তি-ভালবাসাকে মূর্তরূপ দেবার জন্য অনুরূপ বা সাদৃশ্যমূলক উপমা টানা হয়। যেমন, মনিবের প্রতি ভৃত্যের ভক্তি, বন্ধুর প্রতি বন্ধুর ভালবাসা, মা-বাবার প্রতি শিশুর ভালবাসা বা শিশুর প্রতি মা-বাবার ভালবাসা, প্রেমিক-প্রেমিকার ভালবাসা প্রভৃতি পার্থিব গুণ উন্নীত করে ভগবানের প্রতি ভক্তের অনুরূপ ভালবাসা চর্চা সম্পর্কে নানা মতবাদ গড়ে ওঠে। বাংলায় নরনারীর ভালবাসাকে অভিব্যক্তি করে ভক্তিবাদ প্রচার করেন চৈতন্য। বৈষ্ণববাদ প্রচারে চৈতন্য প্রেমিকের প্রতি প্রেমিকার প্রবল আবেগের অনুরূপ কৃষ্ণের প্রতি মানবের প্রেমভক্তি সঞ্চার করার চেষ্টা করেন। কৃষ্ণ  প্রেমে তন্ময় চৈতন্য কৃষ্ণলীলা সঙ্গীতের সঙ্গে যুক্ত করেন নৃত্যকলা। হিন্দু ভক্তি মতবাদের সঙ্গে মুসলিম সুফি মতবাদের সমন্বয় ঘটাবার চেষ্টা করেন কবির। রাজনৈতিক কারণে ভক্তি ও সুফি উভয় মতবাদ সরকারের আনুকূল্য পায়। ফলে সুলতানি আমলে বাংলায় দুটি মতবাদ ভক্তিবাদ ও  সুফিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। [সিরাজুল ইসলাম]