ব্রায়োফাইট
ব্রায়োফাইট (Broyphyte) আদিমতম ভূমিজ সবুজ উদ্ভিদের একটি বিভাগ, যার প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ২৪,০০০। এটি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত: Hepaticae বা Hepaticopsida (লিভারওয়ার্ট ও স্কেল মস), Anthocerotae বা Anthocerotopsida (হর্নওয়ার্ট) এবং Musci বা Bryopsida (মস)। বর্তমানে এই শ্রেণিগুলিকে প্রায়ই আলাদা বিভাগ (Division) বিবেচনা করা হয়।
মেরু অঞ্চল থেকে উষ্ণমন্ডলসহ পৃথিবীর সর্বত্রই ব্রায়োফাইট জন্মে; আর্দ্র পরিবেশে পর্যাপ্ত ভিজা মাটি ও ছায়াঢাকা জায়গা এসব উদ্ভিদের বেশি পছন্দ। কয়েকটি প্রজাতি শুষ্ক আবাস ও পানির বাসিন্দা, কিন্তু একটিও সাগরে নেই। অধিকাংশই আকারে ছোটখাটো, সাধারণত লম্বায় ২-৫ সেমি, বাংলাদেশের ক্ষুদ্রতম নমুনাটি প্রায় ৪ মিমি, কয়েকটি ৩০ সেমি-এর বেশি লম্বা।
ব্রায়োফাইটে সুস্পষ্ট যৌন ও অযৌন জনুক্রম বিদ্যমান। এখানে একপ্রস্থ (haploid) ক্রোমোজোম সংখ্যাধর যৌনজনু (gametophyte) দ্বিপ্রস্থ (diploid) অযৌনজনুর (sporophyte) তুলনায় সুন্দর, দীর্ঘজীবী ও অধিকতর বৈচিত্র্যপূর্ণ। অযৌনজনু এক্ষেত্রে খর্বিত, স্বল্পায়ু ও যৌনজনুর সঙ্গে আঙ্গিকভাবে যুক্ত এবং আংশিক বা সম্পূর্ণভাবে সেটির ওপর নির্ভরশীল।
গ্যামেটোফাইট অবস্থার দেহকাঠামো চ্যাপ্টা থ্যালাস বা পাতাভরা কান্ড। শেষোক্ত ক্ষেত্রে মুখ্য কান্ডে পার্শ্বিক চওড়া পাতা থাকে। পাতা ও কান্ডের গঠন সাধারণত সরল। ব্রায়োফাইটের যৌনজনিতে শিকড় নেই, আছে এককোষী বা বহুকোষী, শাখায়িত বা শাখাবিহীন রাইজোয়েড, যা দ্বারা নিজেকে বাস্ত্তভিতের সঙ্গে আটকে রাখে। রাইজোয়েড কিছু শোষণ করে না, কিন্তু পানি ও খনিজ গ্রহণ প্রভাবিত করতে পারে। এতে সংবহন কোষকলা (vascular tissue) সম্পূর্ণ অনুপস্থিত কিংবা সামান্যই থাকে, কোষগুলি সম্পূর্ণ লিগনীনবিহীন (not lignified)। অন্যান্য ভূমিজ উদ্ভিদের তুলনায় ব্রায়োফাইট অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বহীন, ব্যতিক্রম শুধু একটি, পিট-মস Sphagnum, যা উদ্যানে লাগানো হয়। এছাড়া শক্তির উৎস এবং কিছু রাসায়নিক পদার্থ ও অ্যান্টিবায়োটিক হিসেবে এটি ব্যবহার্য। কোন কোনটি সাজসজ্জার উপকরণ হিসেবে কাজে লাগে। মাটি ও শিলা গঠনে এবং ভূমি সংরক্ষণে সরাসরি জড়িত উদ্ভিদ পর্যায়ক্রমে এগুলি অগ্রণী অবস্থানে থাকে।
উপ-উষ্ণমন্ডলীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশের গ্রীষ্মকাল উষ্ণ, আর্দ্র ও বৃষ্টিবহুল এবং শীতকাল নমনীয় ও শুষ্ক থাকায় এখানে ব্রায়োফাইটের প্রাচুর্য বেশি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষত পাহাড় ও বনে সারা বছরই এই জাতীয় উদ্ভিদ জন্মে। বাংলাদেশের ব্রায়োফাইট ৩ শ্রেণি, ১৪ বর্গ, ৩৪ গোত্র, ৯২ গণ এবং ৪ ভ্যারাইটিসহ প্রায় ২৪৭ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। এদের মধ্যে মসেরই প্রাধান্য।
বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার তথ্যাদি থেকে জানা যায় যে, এদেশে পর্যাপ্ত ব্রায়োফাইট রয়েছে এবং সেগুলি নানা আবাসে অভিযোজিত, এদের বিস্তারের ধরনও বিবিধ। পাহাড় ও বনের ছায়াঘেরা স্থানে, পাহাড়ের ঢালুতে, নদী ও খাল পারের ভিজা ও ছায়াচ্ছন্ন মাটিতে এগুলি অজস্র জন্মে। পূর্ব, উত্তর-পূর্ব ও উত্তরের এলাকায়, বিশেষত কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, সিলেট, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ ও শেরপুর জেলায় ব্রায়োফাইটের আধিক্য দেখা যায়। দক্ষিণে, প্রধানত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে ডাঙ্গায় মসের প্রাচুর্য না থাকলেও কিছু প্রজাতি ভিজা ইট, দেয়াল ও ছাদে যথেষ্টই জন্মে; এদের কয়েকটি পত্রাশ্রয়ী অথবা পরাশ্রয়ী। বাংলাদেশের মধ্য ও পশ্চিম অংশে এই জাতীয় উদ্ভিদের সংখ্যা কিছুটা কম। এদেশে দুটি জলজ প্রজাতির কথা জানা গেলেও কোনটিই সামুদ্রিক নয়।
মাটিতে, পুরানো ভিজা ইটে ও দেয়ালে যেসব ব্রায়োফাইট জন্মে তার মধ্যে Riccia, Marchantia, Cyathodium, Dumortiera, Pallavicinia, Plagiochasma, ও Chiloschyphus উল্লেখযোগ্য। পরাশ্রয়ীদের মধ্যে সহজেই চোখে পড়ে Lejeunea, Frullania ও Jungermania। বাংলাদেশে জলজ প্রজাতি দুটি Ricciocarpus natans ও Raccia fluitans।
বাংলাদেশে Anthocerotopsida শ্রেণির প্রতিনিধি Anthoceros ও Notothylas নদী-নালা ও খাল-বিলের পারে বা অত্যন্ত ভিজা ও ছায়াঢাকা জমিতে জন্মে। এদেশের সচরাচর দৃষ্ট মসের মধ্যে Semibarbula orientalis ও Hyophila involuta দেয়াল ও ইটের উপর এবং Calymperes, Taxithelium ও Erpodium গাছের বাকলে জন্মে। অন্যান্য সাধারণ মস: Fissidens, Bryum, Splanchnobryum, Hydrogonium, Physcomitrium, Philonotis, Garckea, Gymnostomiella, Leucophanes, Octablepharum, Isopterigium, Vesicularia, Glossadelphus এবং Plagiothecium। [খুরশিদা বানু-ফাত্তাহ]