ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ (খ্রিস্টীয় ৮-১৬ শতক) একটি উপপুরাণ। মূল পুরাণের সংখ্যা ১৮ এবং সেগুলি ছাড়া লেখকবিহীন পুরাণগুলিকে উপপুরাণ বলে। উপপুরাণকে ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণও বলা হয়, কারণ এ পুরাণে ব্রহ্মাকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে।
‘পুরাণ’ শব্দটি পৌরাণিক ও কিংবদন্তির লোকগীতির সঙ্গে সম্পর্কিত অতীত বর্ণনা (পুরাণম্ আখ্যায়ানম) বোঝায়। সাহিত্যের একটি শাখা হিসেবে পুরাণসমূহ প্রাথমিক ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির ঐতিহাসিকদের তথ্য সরবরাহের একটি মৌলিক উৎস হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যদিও ঐতিহাসিক প্রয়োজনে তাদের সরবরাহকৃত তথ্য সতর্কতার সাথে ব্যবহার করা উচিত।
খ্রিস্টীয় সাত শতকের পূর্বে সম্ভবত লিখিত একটি মূল ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের অস্তিত্ব ছিল, কিন্তু সেটা বিলুপ্ত। এই মূল পুরাণটি ছিল সম্ভবত একটি লঘু-ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের বর্তমান বিশাল খন্ডটির কাল খ্রিস্টীয় আট শতকের বলে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং খ্রিস্টীয় দশ শতক হতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন লেখকের দ্বারা এটি পরিবর্তিত হতে থাকে এবং ষোল শতকে এটি বর্তমান রূপ লাভ করে।
ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণটি চার খন্ডে বিভক্ত; ব্রহ্ম খন্ড, প্রকৃতি খন্ড, গণেশ খন্ড এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ড। প্রতিটি খন্ডে অধ্যায়ের সংখ্যা যথাক্রমে ৩০, ৬৭, ৪৬ এবং ১৩১। ব্রহ্ম খন্ডের পংক্তিসমূহে সৃষ্টি, মঙ্গলের জন্ম, দক্ষ সংবাদ, মিশ্র বর্ণ, ভেষজ চিকিৎসা, কৃষ্ণ-কবচ, বিষ্ণু-ধন্য, বিষ্ণু মন্ত্র, মনুষ্য কর্তৃক করণীয় এবং পরিহার্য প্রভৃতি বিষয়ের বর্ণনা রয়েছে। প্রকৃতি খন্ডে দেব-দেবীগণের উৎপত্তি, সরস্বতী দেবীর বন্দনা এবং প্রণাম, গঙ্গাপূজা, বেদবতী রাবণ, তুলসী এবং সাবিত্রী কাহিনী, দেবী মহালক্ষ্মী, ষষ্ঠী, মঙ্গল-চন্ডী, প্রভৃতির গৌরবগাথা, রাধা-শ্রুতি, চন্দ্র কাহিনী, রাজা সুরথ কর্তৃক দুর্গার পূজা প্রভৃতির বর্ণনা রয়েছে। গণেশ খন্ড মূলত শ্রীকৃষ্ণের অবতার রূপে অভিহিত গণেশের জন্ম কাহিনী ও কার্যাবলির বিবরণ সমৃদ্ধ। শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ড শাব্দিকভাবে কৃষ্ণের জন্ম সম্পর্কে ইঙ্গিতবাহী হলেও এতে শ্রীকৃষ্ণের সমগ্র জীবনকাহিনী বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। এতে তাঁর কালীয়নাগ-দমন, কংস-বধ, জরাসন্ধ-দমন, যদুবংশ ধবংস প্রভৃতির ওপর বিশেষ গুরূত্ব আরোপ করা হয়েছে। কৃষ্ণের আদ্যা শক্তি হিসেবে শ্রীমতী রাধার বিস্তারিত বিবরণও এখানে পাওয়া যায়।
স্মৃতি ছাড়াও বর্তমান পুরাণের বিভিন্ন খন্ডে বিভিন্ন বিষয় বর্ণিত হয়েছে। এভাবে মিশ্র বর্ণ সম্পর্কে ব্রহ্ম খন্ডের দশম অধ্যায়ে; ভূমি দান সম্পর্কে প্রকৃতি খন্ডের নবম অধ্যায়ে; আরাধনা সম্পর্কে প্রকৃতি খন্ডের ১০, ২২, ২৩, ৩৯, ৪৩-৪৬, ৫৫ এবং ৬৫ অধ্যায়ে এবং গণেশ খন্ডের ১৩, ১৯, ৩২ অধ্যায়ে; নরক ও কর্মফল সম্পর্কে প্রকৃতি খন্ডের ২৪-২৭, ২৯-৩৩, ৫২ অধ্যায়ে; আরাধনা এবং ব্রাহ্মণদের গৌরব সম্পর্কে প্রকৃতি খন্ডের ৫৪ অধ্যায়ে এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ডের ২১তম অধ্যায়ে; হরিব্রত, একাদশীব্রত প্রভৃতি ব্রত সম্পর্কে গণেশ খন্ডের ৩-৪ অধ্যায়ে এবং শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ডের ৮, ২৬ ও ২৭ অধ্যায়ে এবং বর্ণাশ্রমধর্ম ও নারীর কর্তব্য সম্পর্কে শ্রীকৃষ্ণ জন্ম খন্ডের ৮৩-৮৪ অধ্যায়ে আলোচনা রয়েছে।
মধ্যযুগের প্রথম দিকে বাংলার সমাজব্যবস্থার কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য, যেমন সমাজে অব্রাহ্মণ বর্ণ হিসেবে বৈদ্যদের উল্লেখযোগ্য অবস্থান, কৈবর্ত এবং সদগোপদের নিম্নবর্ণ হিসেবে উল্লেখ, ভূমিদানের ও ব্রত উদ্যাপনের পুণ্য প্রাধান্য লাভ করেছে। পন্ডিতগণ এজন্য গ্রন্থটিকে বাংলার মধ্যযুগের প্রথম দিককার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত বলে মনে করেন। [কৃষ্ণেন্দু রায়]
গ্রন্থপঞ্জি RC Hazra, Studies in the Upapuranas, II, Calcutta, 1979; S Bhattacharyya and Nityananda (ed), Sri Brahmavaivarta Puranam, Bangla ed, Calcutta, 1984.