ব্যাংক ব্যবস্থা, প্রাক-আধুনিক
ব্যাংক ব্যবস্থা, প্রাক-আধুনিক আজকের দিনে ব্যাংক ব্যবস্থা বলতে যা বোঝায় তার অপরিহার্য দিকগুলি প্রাচীন ভারতে ব্যাপক ও সুসংহতভাবে না হলেও মোটামুটি অনুসৃত হতো। সে সময়ে সাধারণত অর্থ দাদনকারী, মুদ্রা বিনিময়কারী, গ্রামীণ ব্যবসায়ী ও দোকানীরাই ছিলেন ব্যাংকার। মুসলিম শাসনামলে স্থানীয় মূলধন বিনিয়োগকারিগণ ব্যাংকারদের ভূমিকা পালন করতেন। তাদের দেওয়া দাদনপত্র বা ঋণপত্র হুন্ডি নামে পরিচিত ছিল এবং এর মাধ্যমে প্রাপক বা গ্রহীতা অর্থ স্থানান্তর করতে পারতেন।
মধ্যযুগে বাংলার অর্থনীতিতে মুদ্রা চলাচলের বিস্তৃতির ফলে গ্রাম মুদ্রা অর্থনীতির আওতায় চলে আসে। এর ফলে ব্যাংকার এবং স্থানীয়ভাবে সররফ নামে পরিচিত মুদ্রা বিনিময়কারীদের কার্যক্রম জনসাধারণের দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য অপরিহার্য হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে এ সররফদের কার্যক্রম বহুলাংশে দেশের জটিল মুদ্রা ব্যবস্থার দ্বারা নির্ধারিত হতো। দেশের বিভিন্ন টাকশাল হতে জারি করা মুদ্রার বিশুদ্ধতার মাত্রা নির্ধারণ করার প্রয়োজনীয়তার কারণে স্থানীয় সররফদের প্রধান কাজ ছিল মুদ্রা পরীক্ষা করা।
স্বর্ণপিন্ড হতে টাকশালে মুদ্রা তৈরির স্বাধীনতা সাধারণ লোকের থাকলেও বাস্তবে এ কাজটি স্থানীয় ব্যাংকারদের জন্য সংরক্ষিত ছিল। তারা পুরাতন ও হ্রাসকৃত মূল্যের মুদ্রা টাকশালে এনে তার দ্বারা নতুন মুদ্রা তৈরি করত এবং এ কাজের জন্য তারা স্বর্ণপিন্ডও ক্রয় করত। সরকারের জন্য এটি একটি সাধারণ রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল যে, সরকার তার প্রয়োজনে কিছুসংখ্যক প্রভাবশালী ও বিত্তবান ব্যাংকারদের সরকারি রাজস্ব আদায়কারী, মুদ্রা বিনিময়কারী ও কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ করতেন। দেশের অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণে এই ব্যাংকারগণ কিরূপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে বাংলার নওয়াবদের ব্যাংকার হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রে নিয়োজিত জগৎ শেঠ পরিবার।
মুদ্রা পরীক্ষা ও মুদ্রা বিনিময় ছাড়াও স্থানীয় ব্যাংকারগণ হুন্ডি বা ‘বিল অব এক্সচেঞ্জ’ জারি করত। বিপুল অংকের মুদ্রা দূরবর্তী স্থানে বহন করার ঝুঁকিপূর্ণ ও ব্যয়বহুল উপায় পরিহারের জন্য এই ব্যবস্থা জরুরি ছিল। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, ঢাকা ও দিল্লির মধ্যবর্তী উত্তর ভারতের গুরুত্বপূর্ণ নগরসমূহে জগৎ শেঠ পরিবারের শাখা কার্যালয় ছিল এবং এ পরিবার এই শাখা কার্যালয়গুলির উপর যে কোন অংকের অর্থের ‘বিল’ জারি করত। ব্যাংকারদের অপরাপর দায়িত্ব ছিল সরকারি অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত এবং সেগুলি ছিল রাজস্ব গ্রহণ ও রাজকোষে প্রেরণ এবং সরকারকে ঋণ প্রদান সংক্রান্ত। মুর্শিদকুলী খানএর সময় থেকেই জগৎ শেঠ পরিবার বাংলার সরকারি রাজস্বের গ্রহীতা ও কোষাধ্যক্ষ ছিল।
ব্যাংক প্রতিষ্ঠান বেসরকারি পক্ষকেও ঋণ প্রদান করত। বাংলায় তাদের মালামাল ক্রয়ের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানিগুলি প্রায়শ স্থানীয় ব্যাংকারদের কাছ থেকে টাকা ধার করত। অধিকাংশ ব্যাংকার যৌথভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করত। বাণিজ্যিক লেনদেনের ফলে গড়ে ওঠা ব্যক্তিগত সম্পর্ক ব্যবসায়ীদের নিকট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে বহুলাংশে জনপ্রিয় করে তোলে। অন্যদিকে ঋণ প্রদান একজন ব্যবসায়ীকে ব্যবসায়িক সুবিধা লাভেও সহায়তা করে; কারণ পণ্য উৎপাদনকারীদের ঋণ প্রদান করার ফলে বাস্তবক্ষেত্রে তারা ঋণ প্রদানকারী ব্যবসায়ীর নিকট তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য থাকে। উপরন্তু, অর্থ আদান-প্রদানের জন্য ব্যাংকিং ব্যবসা বণিকদের নিকট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
উচ্চ পর্যায়ে বিশেষত সরকার, জমিদার ও ইউরোপীয় কোম্পানিগুলির সঙ্গে ব্যাংকের মাধ্যমে আর্থিক লেনদেন জগৎ শেঠ এবং পরবর্তীকালে মনোহর দাস ও গোপাল দাসের পরিবারের মতো অল্প কয়েকটি ব্যাংক পরিবারের মধ্যেই সীমিত ছিল। কিন্তু এমন আরও অনেক ব্যাংকার অবশ্যই ছিলেন যারা প্রদেশব্যাপী তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণ করেছিলেন। মুর্শিদাবাদের কালেক্টর জগৎ শেঠ ও গোপাল দাসের পরিবার ছাড়াও, কিশোর মোহন, জগবন্ধু রায়, বাহাদুর সিং, বিজয়রাম রায়, কাশীনাথ প্রমুখ ব্যাংকারদের কাছ থেকে ঋণ গ্রহণ করেছিলেন। ‘কুঠিওয়ালা’ নামে পরিচিত এ সকল ব্যাংকারদের ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে প্রতিনিধি ছিল। তারা তাদের এজেন্টদের মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের কারিগরদেরও ঋণ প্রদান করত।
আধুনিক ব্যাংক ব্যবস্থা ও ব্যাংকের বাণিজ্যিক সংগঠনের উৎপত্তির ফলে ব্যাংকারদের কার্যক্রম হ্রাস পেলেও অর্থ লগ্নিকারীদের কায়কারবার পূর্বের ন্যায় অব্যাহত থাকে। স্থানীয় ব্যাংকাররা নওয়াবী আমলে মুদ্রা ও সরকারি অর্থনীতির ওপর যে প্রভাব বিস্তার করেছিল, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক বাংলার দীউয়ানি লাভের পর সে প্রভাব তারা ধরে রাখতে পারে নি। কালক্রমে তাদের আয়ের উৎস হ্রাস পেতে থাকায় এ ধরনের অধিকাংশ ব্যাংক পরিবারের অবনতি ঘটে। দেশে এক অনন্য অবস্থান এবং প্রদেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী জগৎ শেঠ পরিবারের স্বল্প গুরুত্বের অবস্থানে অবনমন ঐ সময়ে দেশীয় ব্যাংক ব্যবস্থার ক্রম-অবক্ষয়েরই একটি নজির। তাদের অর্থলগ্নি ব্যবসা অন্যান্য ছোট ব্যাংকারদের হাতে চলে যায়। ১৭৭৩ সালে রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত সাধারণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতার ব্যবসায়ী মহলের নতুন কিছু লোক দিনে দিনে প্রসিদ্ধি লাভ করেন। আধুনিক বাণিজ্য পদ্ধতির প্রচলনের সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় ব্যাংকারগণ ব্যবসা ও ব্যাংক-এর ক্ষেত্রে তাদের পূর্বের প্রাধান্য হারিয়ে ফেলেন। সরকারি কোষাগার এবং পশ্চিমা ধাঁচে ব্যাংক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা, কলকাতার বাইরের টাকশালের বিলুপ্তি এবং ফলে স্বর্ণপিন্ডের ঘাটতি স্থানীয় ব্যাংকারদের উপর চরম আঘাত হানে। [কে.এম মোহসীন]