বৈষ্ণববাদ

বৈষ্ণববাদ  ভগবান বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে ভক্তির মাধ্যমে ভজনা করা বৈষ্ণববাদ বা বৈষ্ণব ধর্মীয় মতবাদের মূল ভিত্তি। এখন বাংলাভাষী অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম গৌড়ীয় ধর্ম-দর্শনের প্রায় সমার্থক, যা প্রধানত কৃষ্ণের আদি রসাত্মক লীলায় ভরপুর। এই ধর্ম-দর্শনের প্রেরণা ও প্রতিষ্ঠাতা হলেন কৃষ্ণচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩), যাঁর ভক্তরা বিশ্বাস করেন যে, তিনি হলেন স্বয়ং ভগবান পরমেশ্বর কৃষ্ণের প্রতিমূর্তি এবং যিনি চির মিলনে ও বিরহে রাধাকৃষ্ণের যুগলসত্তাস্বরূপ। চৈতন্য ও কৃষ্ণ এতটাই একীভূত যে, একজনকে পূজা করা মানে অন্য জনকেও পূজা করা। গৌড়ীয় ধর্মতত্ত্বের চমৎকারিত্ব এবং এর প্রাথমিক কৃত্যসমূহের সহজ রূপ, যেমন, কীর্তন গানে খুব সহজভাবে কৃষ্ণের সংকীর্তন, পাঁচ শতক ধরে বাংলার প্রত্যেক রাজনৈতিক ভাঙ্গাগড়ায় বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে অভূতপূর্ব সাফল্যের সঙ্গে মানিয়ে নিতে সক্ষম করেছে।

যদিও আজকের দিনে ব্রজকেন্দ্রিক গৌড়ীয় ভজনারীতি এই অঞ্চলে প্রধান, তবু ঐতিহ্য হিসেবে বৈষ্ণব ধর্মের অন্যান্য রূপও অনুসৃত হয়ে চলেছে, যেমন বিষ্ণুর সঙ্গী লক্ষ্মীর পূজা সনাতন হিন্দু পরিবারে মেয়েদের ব্রত-পার্বণের কেন্দ্রীয় বিষয় হিসেবে পরিগণিত। উড়িষ্যার পুরীতে জগন্নাথ দেবের প্রধান মন্দির থেকে সূচিত হওয়া তাঁর পূজা প্রাচীন পঞ্চরাত্র রাষ্ট্রধর্মের ঐতিহ্য নির্মাণ করেছে এবং এখন এটি চৈতন্যের নিজের ধর্মব্যবস্থার স্বাধীন মর্যাদা বজায় রেখেও নতুন দিক হিসেবে গৃহীত হয়েছে। বৈষ্ণববাদ বৃহৎ বঙ্গে সত্যপীরের মতো প্রান্তিক দেবতাকেও বুকে টেনে নিতে হাত বাড়িয়েছে। ইসলাম ধর্মের আদর্শের সাথে বৈষ্ণব মতের কিছু মিল ও সাদৃশ্যের স্বীকৃতিস্বরূপ সত্যপীর ও সত্যনারায়ণ সমার্থক গণ্য হয়েছেন।

পুরাতাত্ত্বিক সাক্ষ্য নিশ্চিত করে যে, দক্ষিণ এশীয় মহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে এক হাজার কিংবা তারও বেশি সময় ধরে বিষ্ণু ও কৃষ্ণের প্রাচীন ভক্তিমূলক পূজা-পদ্ধতি প্রচলিত ছিল। তেরো শতকের সূচনালগ্নে লক্ষ্মণসেন এর রাজসভা থেকে যে অভিলিখন পাওয়া গেছে তা পঞ্চরাত্র বা ভক্তিধর্মের পৌরাণিক রীতির প্রমাণ দেয়। ভাস্কর্যসমূহ ইঙ্গিত দেয় যে, বিষ্ণুর অবতার হিসেবে নরসিংহ, বামন ও বরাহ সবচেয়ে জনগ্রাহী হয়ে ওঠে। সমসময়ে অনেকগুলি সাহিত্যিক নিদর্শনও পাওয়া যায়  যার সূচনা হয়েছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য জয়দেবের সংস্কৃত রচনা গীতগোবিন্দ কাব্য দিয়ে। সম্ভবত এই কাব্য প্রাচীন ভারতের সব অঞ্চল জুড়ে কৃষ্ণের প্রতি নিবেদিত সবচাইতে বিখ্যাত রচনা। বৈষ্ণব সাধক রামানুজ একই সময়ে উড়িষ্যার পুরীতে একটি টোল প্রতিষ্ঠার জন্য খ্যাত এবং আরও কিছু পরে মাধবের অনুসারীরা ঐ এলাকার বৈষ্ণবদের ওপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিল। এখন পর্যন্ত বিদ্যমান বাংলা ভাষায় রচিত সবচেয়ে প্রাচীন বৈষ্ণবীয় রচনার নিদর্শন এসব সম্প্রদায় বা দলের কোন ধর্মতাত্ত্বিক বা ভক্তিমূলক বর্ণনা নয়, বরং তা হলো চৌদ্দ শতকের শেষে কিংবা পনেরো শতকের প্রথমে রচিত বড়ু চন্ডীদাসের জনপ্রিয় গীতালেখ্য শ্রীকৃষ্ণকীর্তন। পূর্বতন ভাগবতপুরাণ ও গীতগোবিন্দের মতো, পুথিটিকে প্রথমেই ধরাবাঁধাভাবে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের রচনা বলা যাবে না। এর সহজ কারণ হলো, এর মধ্যে সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত কৃষ্ণের সঙ্গে রাধা ও অন্যান্য ব্রজবালার প্রেমলীলা চিত্রিত হয়েছে, কিন্তু পরে এটি গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের ভক্তিমাধুর্যের বিবরণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। ১৩টি সর্গ ও ৪১২টি পদবিশিষ্ট পুথিটি একটি নতুন যুগের বাংলা সাহিত্যের সূচনা করেছে এবং এটি পরবর্তীকালের বাংলা, মৈথিলী ও ব্রজবুলি ভাষায় রচিত ভক্তিমূলক পদাবলি সাহিত্যের উৎস ও প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। এই পুথিটিকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয় এজন্য যে, চৈতন্য বলেছিলেন তিনি চন্ডীদাস ও বিদ্যাপতির পদ উপভোগ করতেন, যদিও এটি পরিষ্কার নয় যে, চৈতন্য যে পদগুলি গাইতেন সেগুলি বর্তমানে প্রচলিত পুথিটির পান্ডুলিপি ও মুদ্রিত রূপের সঙ্গে মেলে কি না।

পনেরো শতকে রাজসভার সাহিত্য হিসেবে মহাভারতরামায়ণ এর প্রথম বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত হয়। কিন্তু চৈতন্যের আন্দোলনের অভ্যুদয়েই কেবল বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের সত্যিকারের ভক্তিবাদী সাহিত্য সুস্পষ্ট বঙ্গীয় রূপ হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। সংগীতা পদাবলি, যেগুলি কীর্তন হিসেবে জনসাধারণের মধ্যে বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে উদ্ভূত হয়েছিল, সেগুলি ছিল বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের দৃষ্টিকোণ থেকে কৃষ্ণ ও রাধার লীলা বর্ণনার প্রথম প্রয়াস। এই ঐতিহ্যের সর্বোত্তম হিসেবে বিবেচিত হয়েছে সতেরো শতকে রচিত গোবিন্দ দাসের পদাবলি। প্রায়শ নৃত্যযোগে পরিবেশিত কীর্তন গান নবদ্বীপে চৈতন্য-সম্প্রদায়কে ভক্তির উন্মত্ততায় উদ্বেলিত করে তোলে, যা অতি সহসা ঐ অঞ্চলের অন্য বৈষ্ণবদের ভাবনাকেও উদ্দীপিত করে। ঐ কালের ইতিহাসমূলক ও জীবনচরিতমূলক উপাদানের শাস্ত্রীয় ভাষা এই যুক্তি দেয় যে, এই সময়ে এ অঞ্চলে বৈষ্ণব ধর্ম ছিল ভয়াবহ অবক্ষয়ের সম্মুখীন এবং কেবল বৈষ্ণব ধর্ম থেকে ভক্তিবাদের উত্থান ঘটে নি। আগে থেকেই ভক্তিবাদের নব উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছিল এবং তা সহসা জনপ্রিয়তাও পেয়েছিল। ভক্তিপূজার নতুন রীতির আকর্ষণ এমন একটি পদ্ধতিতে আবেগদীপ্ত জীবন বিকাশের অনুকূল ছিল যে, তা ব্রজধামে গোপ যুবতীদের সঙ্গে কৃষ্ণের প্রেম ও অন্যান্য লীলার প্রধান ঘটনাগুলিতে ভক্তবৃন্দের প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণ সম্ভব করেছিল। চৈতন্য থেকে আরম্ভ করে প্রধান প্রধান ভক্তপুরুষ চরিতাখ্যান রচনার উপজীব্যরূপে পরিগণিত, যা বিশটি বংশ পরম্পরারও বেশি সময়ব্যাপী বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের নিরবচ্ছিন্ন ঐতিহাসিক ধারা সৃষ্টি করেছে। ভক্ত পুরুষদের প্রামাণ্য জীবনী পুরুষানুক্রমে বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রেরণার আদর্শ হিসেবে কাজ করেছিল এবং তা পর্যায়ক্রমে ব্যক্তিগত ও ধর্মীয় কৃত্য সম্পাদনে পরিবর্তন আনার জন্য উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল।

ষোল শতকে গোষ্ঠীপূজা যে স্তরে গড়ে উঠেছিল তা আগে কখনও দেখা যায়নি এবং এই কর্মযজ্ঞের যথার্থ জায়গা ছিল গৃহ ও প্রকাশ্য স্থান উভয়ই, তবে শেষোক্তটি নতুন রূপেও দেখা যায় মন্দিরসমূহে। নির্মাণের ক্ষেত্রে মন্দির স্থাপত্য এর মধ্যে বেশ অস্পষ্টভাবে এই পরিবর্তন দেখা যায়। পাল ও সেন আমলের মন্দির স্থাপত্য ঐতিহ্যবাহী চালা ও রেখার নকশা যা ধর্মীয় পূজা-রীতির একটি প্রাচীন পদ্ধতির উপর নির্ভরশীল ছিল তা রত্ন নামে অভিহিত সম্পূর্ণ একটি মহৎ নকশায় পরিণত হয় এবং এটি সৃষ্টিধর্মী নতুন পূজা-পদ্ধতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যবহূত হয়। রত্নরীতি যা বিষ্ণুপুরের মল্ল বংশের মন্দির নির্মাণে পূর্ণরূপে প্রকাশমান, তা সুলতানি আমলের স্থাপত্য রূপের সঙ্গে নতুন ধরনের উপরিস্তর ও মোচা আকৃতিবিশিষ্ট চূড়ার সমন্বয় করে এই মন্দির বৈষ্ণবের নতুন ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করেছিল। এখন সমগ্র এলাকা জুড়ে একটি সাধারণ রীতির অবিকল প্রতিরূপ হিসেবে পরিচিত সতেরো শতকের এই নতুন মন্দিরটি বৈষ্ণবীয় আরাধনাকে নতুনভাবে রূপদানের জন্য পৌরাণিক উপাদানকে প্রস্তর ও পোড়ামাটির শিল্পকর্মে প্রকাশ করেছে। মন্দিরগুলির ভিত্তি-কাঠামোতে, মুখমন্ডলে ভয় ও শ্রদ্ধামিশ্রিত সর্বশক্তিমান ঈশ্বর বিষ্ণুর ঐশ্বর্য-মূর্তি থেকে আরম্ভ করে মন্দিরের উপরিস্তরে কৃষ্ণের প্রণয়ব্যঞ্জক সূক্ষ্ম রূপ অর্থাৎ কৃষ্ণের মাধুর্য মূর্তি পর্যন্ত বিভিন্ন ভক্তিরূপের ক্রমস্তর অভিব্যক্ত হয়েছে। উপরিভাগে প্রতীকীভাবে নির্মিত ব্রজমন্ডল এবং অলঙ্কার শোভিত মন্দির ভিত্তিতে প্রথানুগত রাজকীয় অর্ঘ্য দানের ব্যবস্থায় এই মন্দিরগুলি আদিরস ও আবেগমূলক ভক্তির প্রাধান্য দিয়েছিল।

ভাব-ভক্তি নামে অভিহিত প্রেমের মূল আবেগের ওপর গুরুত্ব আরোপ এমন এক অভিজ্ঞতাকে ধারণ করেছে যা সকল মানুষের ক্ষেত্রে একটি সাধারণ বৃত্তি হিসেবে পর্যবসিত এবং যা মুক্তির উপায় হিসেবে নব রূপও লাভ করে। চৈতন্য প্রকাশ্যভাবে এই রূপান্তরের কলাকৌশল সম্বন্ধে কিছু লিখে যান নি; কিন্তু এটা স্পষ্ট যে পুরীতে চৈতন্যের দুই পরিকর, স্বরূপ দামোদর ও রামানন্দ রায় প্রথম ভক্তিমার্গের শৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। ভক্তিমার্গের বৃদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তি গাঁথার প্রয়াস প্রসারিত হলো ভরত ও ভোজের সংস্কৃত রসতত্ত্বের দিকে, ধ্রুপদী নাট্যশাস্ত্রের মর্মমূলে। কিন্তু প্রতীয়মান হয় যে, চৈতন্যের নির্দেশে রূপ গোস্বামীই রসতত্ত্বকে ভক্তিতত্ত্বে রূপ দানের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। কৃষ্ণদাস কবিরাজ এর চৈতন্য চরিতামৃত মতে ব্রজে যাওয়ার পথে কোন এক জায়গায় মিলিত হয়ে একটি প্রলম্বিত উপদেশ শিক্ষাদানের বৈঠকে চৈতন্য রূপ গোম্বামীকে ঐ তত্ত্বের জ্ঞান দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে রূপ গোস্বামী দুটি সংস্কৃত ধর্মতাত্ত্বিক-রসতাত্ত্বিক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন যেগুলিতে ভক্তিরস চর্চার পুঙ্খানুপুঙ্খ দিকগুলি আলোচিত হয়েছে। রূপ গোস্বামীর ভক্তিরসামৃত সিন্ধু আবেগ নির্ভর ভক্তির রূপরেখা অঙ্কন করেছে এবং পরবর্তী রচনা উজ্জ্বলনীলমণি রাধার কৃষ্ণানুরাগের আদর্শে প্রেমের চূড়ান্ত অভিজ্ঞতাকে বর্ণনা করেছে। এই দুটি বিখ্যাত রচনা বাংলাভাষী অঞ্চলে এবং উত্তর ভারতের বৃহদংশে পরবর্তী কালের প্রায় সকল বৈষ্ণব ধর্মাচরণে, এমনকি গ্রাম বাংলার পথে ঘাটে কখনও কখনও দৃষ্ট বিতর্কিত তান্ত্রিক ও সহজিয়া বৈষ্ণবদের ক্ষেত্রেও প্রামাণ্য শাস্ত্রগ্রন্থ হিসেবে পরিগণিত হয়।

এই নব ভক্তিবাদী ধর্মাচারের মূল সূত্র হলো গতানুগতিক আদিরস বা কাম ভাবের সঙ্গে যুক্ত মৌল মানবিক বৃত্তিগুলি এবং সকল মানুষের অনুভবগম্য অন্যান্য কম জটিল বা স্বাভাবিক প্রেমরূপকে সূচনাবিন্দু ধরে শৃঙ্খলার সঙ্গে কৃষ্ণপ্রেমের অনুভূতির নিবিষ্ট পরিচর্যা। এই জাগতিক প্রেমকে আধ্যাত্মিক ভাবাদর্শে সফলভাবে রূপ দিতে জাতপাত নির্বিশেষে প্রত্যেক ভক্তকে বৈদিক বিধানের অনুশাসনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এক গুচ্ছ ধর্মকৃত্য অনুসরণ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। নির্দেশিত চৌষট্টিটি কৃত্যের মধ্যে ভক্তিরসামৃত সিন্ধু (১.২.৯০-৯২, ২৩৮-৪৫) পাঁচটিকে সর্বাধিক ফলদায়ক হিসেবে উল্লেখ করেছে, কারণ এগুলি অপর সকল কৃত্যের ভিত্তিরূপে পরিগণিত। এই পাঁচটি কৃত্য হচ্ছে  (১) কৃষ্ণের নাম সংকীর্তন; (২) কৃষ্ণের কীর্তিগাথাপুষ্ট ভাগবত পুরাণের বিশেষ বিশেষ অংশ স্মরণ ও আস্বাদ লাভ; (৩) মন্দিরে শ্রদ্ধা ও প্রেমভাবে কৃষ্ণমূর্তির পরিচর্যা; (৪) সাধুসঙ্গে অধিবাস এবং (৫) মথুরা বা ব্রজমন্ডলে অবস্থান। পাঁচটি মূল নির্দেশের প্রথমটি থেকেই ভক্তরা কৃষ্ণের নাম কীর্তনে ব্যবহূত সবচেয়ে সাধারণ মন্ত্র শ্রবণ করে থাকে। মন্ত্রটি হলো ‘হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম, রাম রাম হরে হরে’। নামকীর্তনের এই সহজ কর্ম থেকেই ভক্তির সকল রূপ উদ্ভূত এবং ঐসব কৃত্যানুষ্ঠান থেকে ভক্তের হূদয়মনে বিশুদ্ধ প্রেমের ধারাক্রমিক বিকাশ ঘটে থাকে। নামকীর্তনের সহজ-সরল রূপ এবং চন্ডীদাস, বিদ্যাপতি ও গোবিন্দ দাসের পদাবলি-কীর্তন সমাজের সকল স্তরে আবেদন সৃষ্টি করে এবং গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজের ধর্মীয় রীতি-নীতিতে সহজ প্রবেশ লাভের প্রাথমিক কলা-কৌশলের ক্ষেত্রে গুরুত্ব আরোপ করে।

সর্বক্ষণ কৃষ্ণ সম্বন্ধে চিন্তা করে এবং নাম জপে ভক্ত একটি অনানুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার সূত্রপাত করে, যা ক্রমশ কৃষ্ণের সাধারণ পরিচয়কে একটি গভীর ভক্তিতে রূপান্তরিত করে। ভক্তকুলের কাঙ্ক্ষিত সুখাবস্থায় উপনীত হতে সাধারণ গতানুগতিক আবেগ যথেষ্ট নয়, বরং মানব প্রেমের মূল আবেগ পরিশ্রুত ও পরিশুদ্ধ হয়ে বিমূর্ত রূপ লাভ করবে এবং এই অবস্থা জাগতিক পৃথিবীর সীমা অতিক্রম করেছে মনে হবে। এই পরিশ্রুত আবেগের পরিচর্যার জন্য, ভক্তকে অবশ্যই প্রেমাবেগের তীব্রতা বাড়ানোর বা কমানোর সকল উপাদান, কীর্তনের আবহ ও ভাবমন্ডলের পরিবেশ, আসন্ন অভিজ্ঞতা এবং রাধা ও অন্যান্য ব্রজ বালার প্রেমানুভূতি হূদয়ঙ্গম করতে হবে। প্রাগ্রসর ভক্তেরা শিখে নেয় কিভাবে ধ্যানের মধ্য দিয়ে এই অভিজ্ঞতা লাভ করতে হয়। শিখে নেয় কিভাবে লৌকিক প্রেমের (কাম) মূল আবেগ (ভাব) প্রেম নামের একটি বিশুদ্ধ নিখাদ ও নিঃস্বার্থ অনুরাগে রূপান্তরিত হয়। কুশলী ও পারদর্শী ভক্তের ক্ষেত্রে, চৌষট্টিটি বিধান পরিবর্তিত হয়ে যান্ত্রিক কৃত্য থেকে প্রেমের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তিতে রূপ লাভ করে। প্রেমের এই অভিজ্ঞতাই এর সারবস্ত্ত অর্থাৎ রসের বৃদ্ধির জন্য প্রবল অনুরাগ দ্বারা পরিচালিত হয়ে ভক্ত অজান্তেই কৃষ্ণের একান্ত আপন ভুবনে প্রবেশ করেছে। ভক্তির এই অবস্থার নাম রাগানুগ, এবং এটি কৃষ্ণের স্বর্গীয় বৃন্দাবনে স্থায়ী আসন লাভের প্রবেশ পথ। আরও দুরধিগম্য স্তরে এই অনুশীলন যোগক্রিয়ার জটিল রূপ ধারণ করে, যেখানে ভক্ত কৃষ্ণের সান্নিধ্য লাভ করতে একটি পরিশুদ্ধ দেহে (সিদ্ধ দেহ) বিরাজ করে। এটি কিভাবে সম্ভব হতে পারে তা জীব গোস্বামী কৃত ষট্সন্দর্ভ গ্রন্থে শৃঙ্খলাবদ্ধ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদের ধর্মীয় দৃষ্টিমার্গের মাধ্যমে ব্যাখ্যাত হয়েছে।

সৃষ্ট জগৎ বা মায়াশক্তি কৃষ্ণের মধ্যেই নিহিত, কিন্তু আবার তা কৃষ্ণ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন; কারণ কৃষ্ণ হলো শুদ্ধ চৈতন্য অর্থাৎ চিৎশক্তি। পার্থিব মানুষেরা মায়ার জগতে (মোটেও মায়া নয়, সম্পূর্ণ বাস্তব; যদিও মালিন্যযুক্ত প্রাকৃতিক বিষয়াদির মতো অস্থায়ী) আচ্ছন্ন অবস্থায় থাকে, আবার তারা ঈশ্বর বা ভগবান অর্থাৎ স্রষ্ট্রার বোধ শক্তি দ্বারা পরিচালিত। জীবশক্তি স্বরূপ একজন মানুষ এই পার্থিব জগৎ থেকে মুক্তি লাভের জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে একেই অর্থাৎ পৃথিবীকে ব্যবহার করতে পারে; যা কিছু একান্তই জাগতিক সেগুলি সুশৃঙ্খলভাবে পরিহার করে কৃষ্ণের সঙ্গে সম্বন্ধ স্থাপন করতে পারে। সেই সম্বন্ধ যা মানুষকে পরিশুদ্ধ করে এবং যা পার্থিব আকর্ষণের মূলীভূত আবেগগুলিকে একান্ত একক ঐশ্বরিক প্রেমের সমুন্নত ও সুমহান অভিজ্ঞতায় নিয়ে যায়। সৃষ্ট জগৎ ও মানুষ এবং ঈশ্বরের মধ্যে সম্পর্কের রহস্য মানুষের চিন্তার সীমার বাইরে যুগপৎ পৃথক (ভেদ) ও অপৃথক (অভেদ) হিসেবে বর্ণিত হয়েছে। এই কারণেই এ দার্শনিক তত্ত্বের নাম অচিন্ত্যভেদাভেদবাদ। যেখানে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুধাবন দুরূহ, সেখানে ভক্তেরা জেনে নিয়েছে যে, ঐতিহাসিক যুগপুরুষ চৈতন্য দেখিয়েছেন কিভাবে তাঁর নিজের মধ্যে রাধা ও কৃষ্ণ চির মিলনে ও বিরহে এক আধ্যাত্মিক যুগল সত্তারূপে একীভূত। অনেকেই তাঁকে এই আক্ষরিক অভিধায় বুঝে নিয়েছে, কিন্তু পরবর্তীকালের ধর্মবেত্তারা এই ব্যাপারটিকে রূপকায়িত করেছে জীবাত্মার ঈশ্বর-অন্বেষণ ও ঈশ্বরলাভ হিসেবে।

সর্বোচ্চ স্তরের আধ্যাত্মিক সুখানন্দ লাভ করে কৃষ্ণের ভুবনে অংশীভূত হওয়া কেবল কতিপয় নির্বাচিত যোগতান্ত্রিক কুশলতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। যে কোন ভক্ত, যার মন সম্পূর্ণরূপে কৃষ্ণে সমর্পিত, অজ্ঞাতসারেই ঐ ভক্তির প্রমাণ দেবে। এর সাক্ষ্য-প্রমাণ পাওয়া যায় শারীরিক লক্ষণাদি রূপে, যা অদীক্ষিত লোকের কাছে সুস্পষ্টভাবে মৃগীরোগের অনুরূপ মনে হবে। বৃন্দাবন দাসের চৈতন্য ভাগবত এ এসব লক্ষণের চিত্রময় বর্ণনা আছে। এ লক্ষণগুলিকে মিলিতভাবে বলা হয় সাত্ত্বিক ভাব। মূর্ছা, হসন, কম্পন, অনিচ্ছাকৃত ঝাঁকি, লোমহর্ষণ, অতিমাত্রায় হূদ্স্পন্দন এবং এরূপ আরও লক্ষণ এ সময় প্রকাশ পায়।

ভাব-ভক্তির তত্ত্বকে ঘিরে চৈতন্যসৃষ্ট বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের প্রাথমিক গঠন যুগের সময় থেকে প্রধান সমালোচনা প্রায়শ কেন্দ্রীভূত হয়েছে বিশৃঙ্খল আচরণ সৃষ্টির সম্ভাব্য উৎস হিসেবে ভক্তির প্রবল ভাবাবেগের ওপর, যার ফলে সামাজিক রীতিনীতি ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। চৈতন্যের জীবৎকালে নবদ্বীপের শাক্তরা স্পষ্টতই এত বিরক্ত হয় যে, বৈষ্ণব সম্প্রদায়কে ধ্বংস করার আগে তারা কীর্তনের আসর বন্ধ করার জন্য স্থানীয় কাজীর কাছে আবেদন করেছিল। পরবর্তী শতকগুলিতে ইংরেজরা, এমনকি বাঙালি সমাজ-সংস্কারকেরা এই ধর্মাচরণে একই রকম সন্দেহ পোষণ করেছে। তবে ঐ সন্দেহ পরিচালিত হয়েছিল বৈষ্ণব ধর্মের ভিন্ন একটি মীমাংসিত ভাষ্যের প্রতি যা আঠারো ও উনিশ শতকে বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে বিকশিত হয়েছিল। সেটি হলো বামাচারী-যোগতান্ত্রিক রীতিনীতির অনুসরণের ফলে গড়ে ওঠা ভাব-ভক্তির একটি তান্ত্রিক ব্যাখ্যা, যার উদ্দেশ্য ছিল এমন এক পদ্ধতিতে পুরুষ ও নারীর আচরণ-রীতিকে এক করা যা প্রকৃতপক্ষে চৈতন্যের মধ্যে রাধাকৃষ্ণের যুগল মিলন রূপকে উপহাসাম্পদ করেছে। একক গুরু পরম্পরা সহজিয়া ধর্মের সাধারণ বিধানের আওতায় এসব বিচ্ছিন্ন কৃত্যাচরণকে স্থায়ী করে দিয়েছে এবং পরবর্তীকালে ধর্মীয় দলগোষ্ঠী যেমন কর্তাভজারা ও বাউলেরা তাদের নিজেদের প্রয়োজনে এসব আচরণীয় রীতি কৌশলকে অবলম্বন করেছে মনে হয়। এসব ধর্মীয় গোষ্ঠী নবদ্বীপ, শান্তিপুর, বিষ্ণুপুর, খেতরি, ভগ্নপদ ও অন্যান্য অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত বৈষ্ণব ধর্মের মূল ধারার একটি সমান্তরাল বা বিকল্প রূপ গড়ে তুলেছিল। উনিশ ও বিশ শতকের প্রথম দিকের সংস্কারপন্থী আন্দোলন সক্রিয়ভাবে এই দুই ঐতিহ্য ধারাকে এক করতে চেয়েছিল। শিক্ষিত ও নাগরিক উচ্চবিত্ত শ্রেণি কর্তাভজাদের কাছ থেকে ‘হাট’ রূপক এবং ইংরেজ বাণিজ্যিক কোম্পানির ভঙ্গিতে জনগণের কাছে ভাবভক্তি বিক্রয় করার জন্য ‘দোকান কর’ রূপক গ্রহণ করেছিল। কলকাতা ও মুর্শিদাবাদে নবগঠিত মুদ্রণযন্ত্রগুলি বিপুলায়তন বৈষ্ণব সাহিত্য ছাপাতে শুরু করে যেহেতু সংস্কারপন্থীরা ঐতিহ্যকে সমন্বয়ের ধারায় পুনর্গঠন করতে চেয়েছিল। গুরুগণ শিক্ষাকেন্দ্র ও প্রার্থনা মন্দির হিসেবে সমাজসেবামূলক সংগঠনের রূপে মঠ স্থাপন করতে শুরু করেন। এখন এতদ্ঞ্চলে মন্দিরের সঙ্গে যুক্ত বৃহৎ ও আর্থিকভাবে সুদৃঢ় প্রতিষ্ঠান রূপে বৈষ্ণবধর্ম শহর এলাকাতে প্রাধান্য বিস্তার করেছে এবং এটি দেশের গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র অধিভুক্ত সংগঠনগুলির মাধ্যমে এক ধরনের শিথিল সম্পর্ক বজায় রাখে। ধর্মের কর্তৃত্ব-শক্তি এখন গ্রন্থ প্রণয়ন ও মুদ্রণের কাজে নিয়োজিত, যা আইন সঙ্গত নেতৃত্ব ও প্রাতিষ্ঠানিক পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে সেবাধর্ম পালন করে থাকে। পাঁচ শতকের অব্যাহত বিকাশের পরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ঐতিহ্য সাধারণভাবে রক্ষণশীলতার দিকে মোড় নিয়েছে, যা সমাজে এর কেন্দ্রীয় অবস্থান রক্ষা করেছে এবং বাংলা ভাষী অঞ্চলে এর বিশিষ্টতা নিশ্চিত করেছে।  [টনি কে. স্টুয়ার্ট]