বেসরকারিকরণ

বেসরকারিকরণ  সরকারি মালিকানায় পরিচালিত পরিসম্পদ বেসরকারি মালিকানায় হন্তান্তরের নীতি। বিলগ্নীকরণের পূর্বে সরকারি ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে চালু প্রতিষ্ঠান বেসরকারি মালিকানায় চলে যায় এবং রাষ্ট্রায়ত্ত খাত থেকে ব্যক্তিখাতে হন্তান্তরের এই প্রক্রিয়া যে যুক্তিতে অবলম্বন করা হয় তা হচ্ছে, সম্পদ আবণ্টন ও ব্যবহারের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানার চেয়ে ব্যক্তি মালিকানা ও বেসরকারি নিয়ন্ত্রণ অধিকতর দক্ষ ও কার্যকর।

বাংলাদেশে বিলগ্নীকরণের দুটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়: ক. শ্রমিক, কর্মচারী, কর্মকর্তাদের সমিতি এবং দেশীয় ও বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নিকট দরপত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিক্রয় এবং খ. সরাসরি অথবা শেয়ার বাজারের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের ৫০%-এর বেশি শেয়ার বিক্রয়ের মাধ্যমে তাকে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর।

১৯৪৭-এ দেশবিভাগের সময় পাকিস্তানের অংশে মোট ১৬,১৬৩টি শিল্প প্রতিষ্ঠান পড়ে। এগুলির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানে ছিল মাত্র ২৫২টি। পাকিস্তান সরকার শিল্পোন্নয়নে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহ দেওয়ার নীতি গ্রহণ করে এবং সরকারি সমর্থনকে অনুঘটক হিসেবে কাজে লাগায়। সরকার নিজেও অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে, সেগুলি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের নিকট বিক্রয় করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ উত্তরাধিকার হিসেবে বেসরকারি খাতের আধিপত্য-প্রধান একটি অর্থনীতি পায়, তবে শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং অবকাঠামোর অনেক কিছুই মুক্তিযুদ্ধের সময়ে ব্যাপক পরিমাণে ধ্বংস হয়। এছাড়া বাংলাদেশের শিল্পখাতে সে সময়ে যেসব উদ্যোক্তা ছিলেন তাদের অধিকাংশই ছিলেন অস্থানীয়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠান অরক্ষিত রেখে এদের অনেকে পালিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পরপরই বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে পরিত্যক্ত সম্পত্তি অধ্যাদেশ ও জাতীয়করণ আদেশ জারির মাধ্যমে দেশে পরিত্যক্ত সকল মাঝারি ও বৃহৎ শিল্প কারখানার মালিকানা নিয়ে নেয় এবং ব্যাংক, বীমা কোম্পানি, বড় আকারের আমদানি করসমূহ এবং রসায়ন, চিনি ও খাদ্য, জাহাজ নির্মাণ ও প্রকৌশল, বন, পাট, বস্ত্র ইত্যাদি খাতের সব কল-কারখানা জাতীয়করণ করে। জাতীয়করণকৃত শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহ ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদনে ব্যর্থতা এবং অদক্ষতার প্রমাণ দেয়। এগুলিতে কর্মরত লোকের সংখ্যা অপ্রয়োজনীয়ভাবে বেশি, কাঁচামালের উদ্বৃত্ত মজুতজনিত অপচয় অনেক, রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় মালামাল ও উৎপন্ন পণ্যসামগ্রীও অযথা গুদামে পড়ে থাকে। ক্রমাগত অধিক পরিমাণ লোকসানের মধ্যে পতিত এসব প্রতিষ্ঠানকে অস্তিত্ব বিলোপের হাত থেকে রক্ষার জন্য সরকারি তহবিল থেকে বছরের পর বছর অনুদান ও ভর্তুকি দিয়ে আসতে হচ্ছে।

১৯৭৫ সালে সরকার বিলগ্নীকরণ নীতি গ্রহণ করে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের শিল্প কারখানাসমূহ বিরাষ্ট্রীয়করণ শুরু করে। এরপরও দীর্ঘদিন ধরেই রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের আধিপত্য বহাল ছিল এবং দেশের শিল্পখাতে বিনিয়োগের বৃহদাংশই ব্যয় হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলিতে, যেগুলি মূলত নিয়োজিত ছিল রাসায়নিক সার উৎপাদন, মৌলিক প্রকৌশল শিল্প এবং বস্ত্র ও পোশাক প্রস্ত্তত খাতে। সরকার ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প উন্নয়ন ও রপ্তানি উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে শিল্প এলাকা স্থাপন ও রপ্তানি উন্নয়ন এলাকা প্রতিষ্ঠা এবং এগুলিতে বিনিয়োগকারী দেশি ও বিদেশি উদ্যোগসমূহের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিনিয়োগ করে। ১৯৯০-৯১ সালে শিল্পখাতে মোট বিনিয়োগের ৩৫.৬% ছিল রাষ্ট্রায়ত্ত খাতে। পরবর্তীকালে শিল্পপণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের অংশ দ্রুত হ্রাস পেতে থাকে এবং ১৯৯৬-৯৭ সালে তা দাঁড়ায় মাত্র ৩.১ শতাংশ।

বাংলাদেশে বিলগ্নীকরণের উদ্যোগ খুব একটা সফলতা অর্জন করে নি। বিলগ্নীকরণের প্রক্রিয়ায় শুধু কালো টাকার মালিক কতিপয় বিত্তবান সস্তায় শিল্পসম্পত্তির মালিক হয়েছে। আবার এদের প্রায় সকলেই শিল্প পরিচালনায় অনভিজ্ঞ এবং অথবা অদক্ষ। বিলগ্নীকৃত পাটকল, বস্ত্রকল ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের অনেকগুলিই এখন রুগ্ন এবং সেগুলির জন্য সরকারি তহবিল থেকে অনুদান বা স্বল্প সুদহারে পুনর্বাসন ঋণ দাবি করা হচ্ছে। বিলগ্নীকরণ প্রক্রিয়া সহজতর প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন করা এবং চিহ্নিত সরকারি শিল্প কারখানাসমূহ দ্রুত বেসরকারি মালিকানায় হস্তান্তর করার জন্য সরকার ১৯৯৩ সালে বেসরকারিকরণ বোর্ড গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে ২০০০ সালে সংস্থাটির নাম ও কর্মপরিধি পরিবর্তন করে গঠন করা হয় বেসরকারিকরণ কমিশন। কমিশনের কর্মপরিধি নির্ধারণের লক্ষ্যে ২০০১ সালে বেসরকারিকরণ নীতিমালা এবং ২০০৭ সালে বেসরকারিকরণ আইন প্রণয়ন করা হয়।

বেসরকারিকরণ কমিশনের প্রধান কাজ হচ্ছে বিলগ্নীকরণ নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানসমূহ বিক্রয়ের মাধ্যমে সরকারি তহবিলের ওপর চাপ কমানো ও সরকারি অর্থসম্পদের অপচয় রোধ করা এবং চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানসমূহের মূল্য যথাসময়ে আদায় করা। টেন্ডারের মাধ্যমে বিক্রয় করার জন্য চিহ্নিত প্রতিষ্ঠান কিনতে আগ্রহী ক্রেতাদের শুধু দরপত্র জমা দেওয়াই যথেষ্ট নয়, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পরিসম্পদের বিনিময়ে নেওয়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণের দায়ও তাদের গ্রহণ করতে সম্মত থাকতে হয়। বিনিয়োগ বোর্ড দরপত্রসমূহ যাচাই-বাছাইয়ের পর মন্ত্রণালয়ের কার্য উপদেষ্টা কমিটিতে পাঠায় এবং সেখানেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সকল দরপত্রদাতাকে দরপত্রে উল্লিখিত পরিমাণের ৩২.৫% অর্থ দরপত্র গৃহীত হবার ত্রিশ দিনের মধ্যে পরিশোধ করে দিতে হয়। এই অর্থ জামানত হিসেবে দেয় ২.৫% পরিমাণ অর্থের অতিরিক্ত। পরিশোধ্য অবশিষ্ট ৬৫% তিন বছর সময় ধরে ষান্মাসিক কিস্তিতে দিতে হয় এবং এক্ষেত্রে চক্রবৃদ্ধি ৯% সুদহার আরোপ করা হয়। দরপত্র গৃহীত হওয়ার ত্রিশ দিনের মধ্যে সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করলে ২০% রিবেট এবং উক্ত সময়ের মধ্যে সম্পূর্ণ মূল্যের ৭৫% পরিশোধ করলে ১৫% রিবেট পাওয়া যায়। কর্মকর্তা-কর্মচারী সমিতির কাছে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের সকল দায় দরপত্রে উল্লিখিত মূল্যের সঙ্গে সমন্বয় করে দেওয়া হয়। আর সফল দরপত্রদাতা যদি কোন লিমিটেড কোম্পানি হয়, তাহলে তাকে জামানত হিসেবে মূল্যের ৩০% দিতে হয়, অবশিষ্ট ৭০% টাকা পরিশোধ করতে হয় ৬০ দিন সময়ের মধ্যে।

১৯৯৩ থেকে ১৯৯৭ এই চার বছরে বিনিয়োগ বোর্ড বিক্রয় অথবা বিলগ্নীকরণের জন্য ২১৭টি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করেছিল। ২০১০ সাল পর্যন্ত এর মধ্যে ৭৫টি প্রতিষ্ঠানকে বেসরকারিকরণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫৪টি সরাসরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, আর বাকি ২০টির মালিকানা সত্ত্বের অংশ বিশেষ শেয়ার হিসেবে বিক্রি করা হয়েছে। তবে এ বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে, বলা যাবে না। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই এসব প্রতিষ্ঠান যারা কিনেছে তারা যথাসময়ে মূল্য পরিশোধ করে নি। রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহে নিয়োজিত শ্রমিক-কর্মচারীদের আপত্তি ও প্রতিরোধের মুখে এগুলির বিলগ্নীকরণ কঠিন হয়ে পড়ে। নতুন মালিকরা আবার প্রথম কাজ হিসেবে অপ্রয়োজনীয় শ্রমিক-কর্মচারী ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপটিই গ্রহণ করেন। তবে নানা কারণে এ কাজটি করা খুবই কঠিন। বিলগ্নীকৃত প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ব্যাংক থেকে কার্যচালনা মূলধন জোটানোও বেশ দুরূহ। কারণ, সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ না হওয়া পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানের কোন পরিসম্পদ সহ-জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যায় না। [এম. হবিবুল্লাহ]