বেরাভাসান
বেরাভাসান একটি লোকউৎসব। নদ-নদী, খাল-বিল ও হাওড় অধ্যুষিত এলাকার জনগণ জলের যে কোনো প্রকার অকল্যাণকর প্রভাব থেকে মুক্ত থাকার জন্য জলের পীর বা দেবতা খোয়াজ খিজিরের উদ্দেশে ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার বেরা বা কলার ভেলা ভাসিয়ে থাকে। সামাজিক ও পারিবারিকভাবে যেমন, তেমনি ফকির সম্প্রদায়ের উদ্যোগেও উৎসবটি পালিত হয়।
খোয়াজ হচ্ছেন সেমিটিক জলদেবতা। প্রাক-ইসলামি যুগে সর্বপ্রাণবাদী চিন্তাধারা থেকে এর উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে। তুর্কি শাসকদের (১৩শ শতক) মাধ্যমে খোয়াজ খিজির বঙ্গদেশে প্রবেশ করে এবং এখানকার লোকমনে ক্রমশ স্থায়ী আসন করে নেয়। মুর্শিদাবাদ ও ঢাকার নবাব-নায়েব-নাজিমরাও তাঁর ভক্ত ছিলেন। মুকাররম খান, সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিম মহাসমারোহে ভাদ্রমাসের শেষ বৃহস্পতিবার ঢাকার বুড়িগঙ্গা এবং মুর্শিদাবাদের ভাগীরথী নদীতে বেরা ভাসিয়েছেন।
লোকায়ত ধ্যান-ধারণা অনুযায়ী বেরাভাসান খোয়াজ-কেন্দ্রিক হলেও কোথাও তিনি এককভাবে পূজিত হন না; এমনকি কোথাও কোথাও তিনি অনুক্তও থাকেন। ঢাকার মুন্সিগঞ্জে হিন্দু মেয়েদের ব্রতাচারধর্মী পারিবারিক বেরাভাসান উৎসবটি গঙ্গাদেবীর উদ্দেশে উদ্যাপিত হয়। কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়া পন্ডিতবাড়িতে যে বেরা উৎসব হয়, সেখানেও খোয়াজ অনুপস্থিত; যদিও অনুষ্ঠানটির নাম ‘জিন্দাপীর ও পরাণ ফকিরের বেরা উৎসব’। এখানে যাঁদের স্মরণ করা হয় তাঁদের প্রথমজন হলেন আদ্যাশক্তি গুহ্যকালী এবং অপর চারজন ফকির। এ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের তমালতলায় পূজিত হন আটজন: প্রথম স্থানে মহাগুরু, দ্বিতীয় স্থানে খোয়াজ খিজির।
বেরা তৈরি করতে যে কলাগাছ প্রয়োজন তা সংগ্রহের জন্য উপবাসী সেবাইত শিষ্যদের নিয়ে গাছের মালিকের অনুমতি নিয়ে কলাবাগানে যায়। গাছের উদ্দেশ্যে সে বলে: ‘মা গঙ্গা আর খোয়াজ খিজিরের বেরা তৈরির জন্য সাতটি কলাগাছ চাই।’ পরে এক এক কোপে সাতটি কলাগাছ কেটে নিয়ে তারা বেরা তৈরি করে।
বেরা উৎসবের সময় খোয়াজ এবং গঙ্গার বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের কথা আছে একটি বেরাভাসান গানে। এর মধ্য দিয়ে দুই সংস্কৃতির সমন্বয় সাধনের একটি প্রয়াস লক্ষ করা যায়। কোনো সমস্যা বা সঙ্কটে বছরের যে কোনো সময় বেরা ভাসান যায়। [মোমেন চৌধুরী]