বেথুন, জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার

বেথুন, জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার (১৮০১-১৮৫১) স্যান্ডফোর্ডের কর্নেল জন ড্রিংকওয়াটারের পুত্র। জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন ১৮০১ সালের ১২ জুলাই চেজশায়ার বেথুনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা The Siege of Gibraltar নামক একটি গ্রন্থ রচনা করে সুনাম অর্জন করেন। মাতার নাম এলিয়ানর কংগ্যাস্টন। জ্ঞানালোকিত এবং উদার দৃষ্টিভঙ্গির অধিকারী বেথুনের ছিল মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা। মায়ের অনুরোধেই তিনি তাঁর নিজের নামের সঙ্গে মায়ের পারিবারিক ‘বেথুন’ পদবি যুক্ত করেন। কৃতী ছাত্র জন বেথুন ওয়েস্টমিনিস্টার বিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন এবং যুবক বয়স থেকে বিজ্ঞান ও সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে পড়েন। তিনি ১৮২৩ সালে ক্যামব্রিজের ট্রিনিটি কলেজ থেকে একজন ব্যাংগলার (ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিতশাস্ত্রে প্রথম শ্রেণির সম্মানসহ স্নাতক উপাধিধারী ছাত্র) হিসেবে স্নাতক ডিগ্রিলাভ করেন এবং পরবর্তীকালে পার্লামেন্টে প্রশাসনিক পদে চাকরির জন্য ১৮২৭ সালে তিনি আইন পেশায় নিয়োজিত হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। একজন ভাষাবিদ হিসেবে তিনি গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি এবং ইতালি ভাষায় দক্ষতা অর্জন করেন এবং একজন কবি হিসেবেও খ্যাতি অর্জন করেন। লর্ড বেন্টিকের বিরুদ্ধে Sutte Prevention Law of 1829 (সতীদাহ প্রথা রদ আইন-১৮২৯) নামক বিখ্যাত মামলার সহকারী হিসেবে কাজ করার জন্য ফ্রান্সিস বেথি বেথুনকে আমন্ত্রণ জানান। বেথির সহকারী হিসেবে বেথুন ১৮৩১ সালের আগস্ট মাসে প্রিভি কাউন্সিলে আবেদন পেশ করেন, কিন্তু এই আবেদন খারিজ হয়ে যায়। ভারতবর্ষে এবং ভারতবর্ষের সমস্যা সম্পর্কিত আলোচনায় এটিই বেথুনের প্রথম আত্মপ্রকাশ। এই আবেদন খারিজ হওয়ার কারণে তিনি অত্যন্ত আশাহত হন, কারণ প্রতিক্রিয়াশীলরা একটি অমানবিক বিষয়কে স্থায়ীরূপ দেয়ার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিল। ভারতবর্ষের নারীদের অবস্থার উন্নতির জন্য বেথুনের মা অনুতপ্ত বেথুনকে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ দেন।

জন এলিয়ট ড্রিংকওয়াটার বেথুন

একজন আইনজীবী হিসেবে তাঁর পেশা ছিল স্বল্প স্থায়ী, কিন্তু তাঁর মেধা ও ন্যায়বিচারবোধের কারণে লর্ড গ্রে তাঁকে হোম অফিসের পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। এ সময় বেথুন সরকার কর্তৃক গৃহীত কিছু গুরুত্বপূর্ণ আইনের খসড়া প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। বেথুনের ভারত আগমনের পূর্ব পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেশে নারীশিক্ষা প্রচলনের খুব সামান্য উদ্যোগই গ্রহণ করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রাতিষ্ঠানিক নারীশিক্ষার জন্য এক ধরনের আন্দোলন শুরু হয় এবং কয়েকজন যুবকের উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতায় একটি বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এ আন্দোলন চূড়ান্তরূপ লাভ করে। এদেশের নারীদের দুঃখ-দুর্দশা ও বঞ্চনা সম্পর্কে বেথুন পূর্বেই অবহিত ছিলেন। ফলে তিনি নারীদের আনুষ্ঠানিক শিক্ষা প্রদানের জন্য আগ্রহী হন। তাঁর মতে, শিক্ষা নারীদের ‘সুগৃহিনী ও আদর্শ মা’ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে।বাংলার মেয়েদের শিক্ষাদানের লক্ষ্য নিয়ে তিনি রামগোপাল ঘোষ এবং দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের মতো সমমনা ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন।

দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায় তাৎক্ষণিকভাবে তাঁর বাহির শিমুলিয়ার সুকেয়া সড়কের বাড়িটি বেথুনের প্রস্তাবিত বিদ্যালয় স্থাপনের জন্য দিতে রাজি হন। এঁদের মত সজ্জন ব্যক্তি নারীদের জন্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার গুরুত্ব সম্পর্কে হিন্দুসমাজের সম্মানিত ব্যক্তিদের বোঝাতে সক্ষম হন এবং তাঁদের নিকট থেকে এই নিশ্চয়তা পান যে, তাঁরা তাদের কন্যাদের প্রস্তাবিত বিদ্যালয়ে শিক্ষালাভের জন্য পাঠাবেন। বেথুন জানতেন যে, মিশনারি নারীদের দ্বারা উচ্চশ্রেণি হিন্দু পরিবারের নারীদের শিক্ষাদানের পূর্ব প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এসব মিশনারি বিদ্যালয় সমাজের দরিদ্র শ্রেণির নিম্নবর্ণের মধ্য থেকে ছাত্র-ছাত্রী সংগ্রহ করত। ছাত্র-ছাত্রীদের শিক্ষাপ্রদান করা তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল না, মূল উদ্দেশ্য ছিল অর্থনৈতিক এবং অন্যান্য বিষয়। বেথুন শুধুমাত্র ‘সম্ভ্রান্ত পরিবারের’ নারীদের নতুন প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে ভর্তির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ উপলক্ষে ভর্তিচ্ছু ছাত্রীদের নাম পরীক্ষা-নিরীক্ষা করার জন্য কিছু অভিভাকদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। তাদের এই শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা। অভিভাকদের সুনির্দিষ্ট চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ইংরেজি ভাষা চালু করা হবে।

বেথুন কোম্পানির সরকারের উচ্চ পদমর্যাদায় অধিষ্ঠিত থাকা সত্ত্বেও নিজের উদ্দেশ্যাবলি অর্জনের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত উদ্যোগকেই অগ্রাধিকার প্রদান করেন। এভাবে তিনি সরকারিভাবে পরিচিত হিন্দু নারী বিদ্যালয় পরিচালনার সমুদয় অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব নিজের সঞ্চিত অর্থ থেকে ব্যয় করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ১৮৪৯ সালের ৭ মে সকাল ৭টায় এই ঐতিহাসিক বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু হয়। বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অধিকাংশ ইংরেজি ও বাংলা সংবাদপত্রে এই বিদ্যালয়ের উদ্বোধনী সংবাদ প্রকাশিত হয়। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয় যে, বেথুন এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে কোনো ইউরোপিয়কে আমন্ত্রণ করেন নি। বেথুন অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় নারীশিক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এবং ঘোষণা করেন যে, বিদ্যালয় প্রশাসন, পাঠ্যসূচি প্রণয়ন, পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ এবং নারীদের ভর্তি সংক্রান্ত বিষয়াদি সম্পর্কে মত বিনিময়ের জন্য কয়েকটি কমিটি গঠন করা হবে। এসব কমিটিতে অভিভাবক-প্রতিনিধি থাকবেন। বেথুন সাহেবের বিদ্যালয় নামে সাধারণভাবে পরিচিত এ বিদ্যালয়ের সুনাম ও মর্যাদা আরো বৃদ্ধি পায় যখন তাঁর অনুরোধে ১৮৫০ সালে বিদ্যাসাগর সচিব হিসেবে এর দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। বিদ্যাসাগরের সহায়তায় বেথুন রাজা কালীকৃষ্ণ বাহাদুরের মতো কয়েকজন ত্যাগী হিন্দু নেতাদের এই বিদ্যালয়ের কমিটিতে যোগদান করাতে সক্ষম হন।

ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দিন বেথুন ঘোষণা করেন, ‘আমি বিশ্বাস করি আজকের দিনটি একটি বিপ্লবের সূচনা করতে যাচ্ছে ... আমরা সফল হয়েছি এবং আজকের যে আদর্শের বীজ রোপিত হলো তা আর কোনোদিন বিফলে যাবে না’। ১৮৫১ সালের ১২ আগস্ট কোলকাতায় জন ড্রিংকওয়াটার বেথুনের মৃত্যু হয়। তিনি অবশ্য জীবিত অবস্থায় খোলা চত্বরসহ বিরাট প্রাসাদপোম অট্টালিকা, লম্বা গম্বুজ এবং বিশাল মার্বেল হলে প্রতিষ্ঠিত বেথুন বিদ্যালয় দেখে যেতে পারেন নি। তবে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, ভারতীয় নারীদের জন্য তিনি একটি প্রাতিষ্ঠানিক স্থাপনা তৈরি করেছেন, এবং একটি মজবুত নির্ভরযোগ্য ভিত্তির ওপর নারীশিক্ষা প্রতিষ্ঠিত করেছেন।  [রচনা চক্রবর্তী]