বেঙ্গল প্যাক্ট, ১৯২৩
বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৩) বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিদ্যমান সাম্প্রদায়িক বিভেদের সমাধানের লক্ষ্যে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তি। চিত্তরঞ্জন দাশ প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদারিত্বের নীতিতে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস ছিলেন।
অসহযোগ আন্দোলন ও বিধানসভা বর্জনের আহবান প্রত্যাহূত হলে সি.আর দাশ (চিত্তরঞ্জন দাশ) ও পন্ডিত মতিলাল নেহরুর নেতৃত্বে ভারতীয় কংগ্রেস নেতাদের একটি অংশ আইন সভায় যোগদানের পক্ষে চিন্তা ভাবনা করতে থাকেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল, কাউন্সিলে থেকে ধারাবাহিক প্রতিবন্ধকতার নীতি অনুসরণের মাধ্যমে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে প্রবর্তিত দ্বৈত শাসন-ব্যবস্থার অবসান ঘটানো। কিন্তু তাঁরা ১৯২২ সালের ডিসেম্বরে গয়ায় অনুষ্ঠিত ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশন কাউন্সিলে যোগদানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। কংগ্রেসের গয়া অধিবেশনের পর সি.আর দাশ কংগ্রেসের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং কংগ্রেসের ভেতর থেকেই ‘স্বরাজ্য পার্টি’ নামে একটি উপদল গঠন করেন। ১৯২৩ সালে বঙ্গীয় আইন সভা (কাউন্সিল) নির্বাচনে স্বরাজ্য পার্টি উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করে। প্রাদেশিক পরিষদের ১৩৯টি আসনের মধ্যে ৪৬টি আসন লাভ করে দলটি কংগ্রেস প্রতিনিধিদের মধ্যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সি.আর দাশ এ দলের নেতা নির্বাচিত হন। সার্বিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ না হলেও এ দল বাংলায় যে-কোন মন্ত্রিসভা গঠনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার অবস্থানে ছিল। বাংলায় এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য বাংলার গভর্নর লর্ড লিটনের আহবান সি.আর দাশ প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ক্রমাগত অসহযোগিতার মাধ্যমে ১৯১৯ সনের সংবিধান সংশোধনে বাধ্য করা।
সি.আর দাশ তাঁর রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বঙ্গীয় আইন সভার মুসলিম সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতা কামনা করেন। তিনি বাংলার বিশিষ্ট মুসলিম নেতাদের সঙ্গে যুগপৎ আলোচনা চালান এবং এর ফলশ্রুতিতে ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরের প্রথম দিকে তাঁদের সঙ্গে এক চুক্তি করেন। চুক্তিটির (যা সাধারণত বেঙ্গল প্যাক্ট নামে পরিচিত) শর্তাবলি (বিধানসমূহ) ১৯২৩-এর ১৬ ডিসেম্বর স্বরাজ্য দলীয় সদস্যদের সভায় অনুমোদিত হয়। এ সভায় সুস্পষ্টভাবে ঘোষিত হয় যে, প্রদেশে সত্যিকারের স্ব-নিয়ন্ত্রিত সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই এ চুক্তি কার্যকর হবে। চুক্তিটি বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস কমিটির ১৯২৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর তারিখের সভায়ও অনুমোদন লাভ করে। চুক্তিটির বিভিন্ন শত ছিল নিম্নরূপ:
১. বঙ্গীয়-আইন সভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচক মন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
২. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ।
৩. সরকারি চাকরির শতকরা পঞ্চান্ন ভাগ পদ পাবে মুসলমান সম্প্রদায় থেকে। যতদিন ঐ অনুপাতে না পৌঁছানো যায়, ততদিন মুসলমানরা পাবে শতকরা আশি ভাগ পদ এবং বাকি শতকরা কুড়ি ভাগ পাবে হিন্দুরা।
৪. কোন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫ শতাংশের সম্মতি ব্যতিরেকে এমন কোন আইন বা সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা যাবে না, যা ঐ সম্প্রদায়ের সঙ্গে স্বার্থের পরিপন্থী।
৫. মসজিদের সামনে বাদ্যসহকারে শোভাযাত্রা করা যাবে না।
৬. আইন সভায় খাদ্যের প্রয়োজনে গো-জবাই সংক্রান্ত কোন আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেওয়া হবে না এবং আইন সভার বাইরে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রচেষ্টা চালানো অব্যাহত থাকবে। এমনভাবে গরু জবাই করতে হবে যেন তা হিন্দুদের দৃষ্টিতে পড়ে তা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত না করে। ধর্মীয় প্রয়োজনে গরু জবাইয়ের ব্যাপারে কোন হস্তক্ষেপ করা যাবে না।
চুক্তিটি প্রচারিত হওয়ার পরপরই বাংলার হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করে। এ চুক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনেকে প্রবল বিরোধিতা করে। হিন্দু নেতাদের মধ্যে যাঁরা চুক্তিটির বিরোধিতা করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন এস.এন ব্যানার্জী ও বি.সি. পাল। এ চুক্তির বিরুদ্ধে, যা তাঁদের ভাষায় এক-তরফা ছিল, হিন্দু জনমত গড়ে তোলার ব্যাপারে বাংলার হিন্দু গণমাধ্যম এর বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে উঠে। সি.আর দাশের নিজ সম্প্রদায়ের ব্যক্তিরা তাঁকে সুবিধাবাদী ও মুসলিম পক্ষপাতদোষে দুষ্ট বলে দোষারোপ করেছিলেন। তিনি কিন্তু সকল বিরোধিতার মুখেও অটল থাকেন। চুক্তিটির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ব্যতীত স্বরাজ সম্ভবপর নয়। তিনি বাংলার বেশ কিছু কংগ্রেস নেতার সমর্থন লাভ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে জে.এম সেনগুপ্ত, সুভাষচন্দ্র বসু, কিরণশংকর রায়, অনিলবরণ রায়, বীরেন্দ্র শাসমল এবং প্রতাপচন্দ্র গুহ উল্লেখযোগ্য। তাঁর পরিকল্পনার প্রতি তিনি বাংলার অধিকাংশ মুসলমানের প্রাণঢালা সমর্থন লাভ করেছিলেন। তাঁরা সর্বান্তকরণে চুক্তিটিকে স্বাগত জানান। বাংলার মুসলমানগণ অনুধাবন করেছিলেন যে, চুক্তিটির বাস্তবায়ন সাম্প্রদায়িক দ্বন্দ্বের মূলে আঘাত হানবে। মুসলিম গণমাধ্যমগুলি তাদের ন্যায্য দাবিসমূহ পূরণ করার মতো ঔদার্য প্রদর্শন করায় হিন্দুনেতাদের ধন্যবাদ জানায়। তবে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ১৯২৩ সালের ডিসেম্বরের কোকোনদ অধিবেশনে চুক্তিটি প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় মুসলমানগণ অত্যন্ত হতাশ বোধ করেন। তাঁরা কংগ্রেসের সিদ্ধান্তকে অদূরদর্শী ও অতি স্বার্থপর বলে আখ্যায়িত করেন।
ভারতীয় কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করলেও সি.আর দাশ তাঁর শক্তি ও উদ্দেশ্যের সততার বলে ১৯২৪ সালের জুন মাসে সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনে চুক্তিটির বিধানসমূহের অনুমোদন লাভের আপ্রাণ চেষ্টা চালান। দুর্ভাগ্যবশত ১৯২৫ সালে তাঁর অকাল মৃত্যুতে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের পথে বাধা সৃষ্টি হয়। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর কয়েকজন অনুসারীও চুক্তিটি বর্জন করেন। অনেক বাঙালি মুসলমান রাজনৈতিক নেতা মর্মাহত হন এবং তাঁরা কংগ্রেস ও স্বরাজ্য উভয় দল থেকেই দূরে সরতে থাকেন। মুসলমানদের দলত্যাগের ফলে প্রদেশের উল্লেখযোগ্য কিছু মুসলমান নেতা মৌলভী আব্দুল করিম, মওলানা আব্দুর রউফ, খান বাহাদুর আজিজুল হক, আব্দুল্লা-হিল-বাকী, মৌলভী আশরাফউদ্দীন, ড. এ সুরাওয়ার্দী, এ.কে ফজলুল হক প্রমুখের উদ্যোগে ১৯২৬ সালে ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি গড়ে ওঠে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাময়িকভাবে এ দলের সম্পাদক হন। বস্ত্ততপক্ষে, এর পর থেকেই বাংলার মুসলমানগণ বাংলার রাজনীতিতে তাঁদের কিরূপ ভূমিকা থাকা উচিত সে সম্বন্ধে নতুন করে ভাবনা সৃষ্টি হয়। এরই ফলশ্রুতিতে ১৯২৬-এর দিকে এ প্রদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পুনরাবির্ভাব ঘটে। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]