বেগম, মমতাজ২

বেগম, মমতাজ (১৯৪৬-২০২০) অধ্যাপক, নারী নেত্রী, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত এমএনএ, নারী মুক্তিযোদ্ধা ও সমাজকর্মী।

মমতাজ বেগম

মমতাজ বেগম ১৯৪৬ সালের ১৩ই এপ্রিল বৃহত্তর কুমিল্লার ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমা (বর্তমানে জেলা)-র কসবা থানার (বর্তমান উপজেলা) শিমরাইল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম আবদুল গনি ভূঁইয়া এবং মাতার নাম জাহানারা বেগম। পিতামাতার ৩ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন একমাত্র কন্যা-সন্তান। তাঁর পিতাও আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন।

মমতাজ বেগম স্থানীয় কসবা হাইস্কুলে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশুনা করে কুমিল্লা সরকারি ফয়জুননেছা বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। সেখানে কয়েক ক্লাস পড়ার পর তিনি ঢাকায় কামরুন্নেছা সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং ১৯৬১ সালে এ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন। এরপর তিনি সরকারি ইডেন মহিলা কলেজে ভর্তি হন কিন্তু সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার কারণে তাঁর পক্ষে যথাসময়ে ইন্টারমেডিয়েট পরীক্ষা দেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৬৫ সালে কুমিল্লা মহিলা কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট এবং ১৯৬৭ সালে একই কলেজ থেকে স্নাতক পরীক্ষায় উর্ত্তীণ হন। তিনি ১৯৬৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শনশাস্ত্রে এম এ ডিগ্রি অর্জন করেন। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৮ সালে তিনি এল এল বি পরীক্ষা দিয়ে তাতে উত্তীর্ণ হন। ১৯৭০ সালে তিনি কায়েদে আযম কলেজে (বর্তমানে সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ) প্রভাষক হিসেবে চাকরি জীবন শুরু করেন। ২০০৪ সালে তিনি ঢাকা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের উপাধ্যক্ষ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন।

রাজনৈতিক পরিবারে জন্ম নেওয়া মমতাজ বেগম এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। মূলত কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে পূর্ণকালীন নিজেকে যুক্ত করেন। তিনি তখন থেকেই ছাত্রলীগ, পরবর্তী যুব নেতা ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ ফজলুল হক মনির সান্নিধ্যে আসেন। ১৯৬২ সালে তিনি ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্রী থাকাকালীন সময়ে শরীফ শিক্ষা কমিশন ও ১৯৬৪ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৫-১৯৬৬ সালে তিনি কুমিল্লা মহিলা কলেজ ছাত্রী সংসদের সহ-সভাপতি (ভিপি) নির্বাচিত হন। সে সময়ে তিনি বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ‘বাঙালির মুক্তিসনদ’ হিসেবে পরিচিত ছয়দফা কর্মসূচির সমর্থনে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯৬৭ সালে ছাত্রলীগের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোকেয়া হল শাখা কমিটি গঠিত হলে তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সদস্য হন। সে সময়ে তিনি ছয়দফা ও সংগ্রামী ছাত্রসমাজের ১১-দফা কর্মসূচি-ভিত্তিক উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে পূর্ব বাংলার জন্য সংরক্ষিত ৭টি নারী আসনের মধ্য থেকে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য বা এমএনএ নির্বাচিত হন। নির্বাচনোত্তর ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না-করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর বিরুদ্ধে মার্চ মাসে বাঙালির অবিসাংবাদিত ও নির্বাচিত মেজরিটি পার্টির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলনের ডাক এবং ৭ই মার্চ তাঁর রেসকোর্সের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণের উদাত্ত আহ্বান জানানোর সঙ্গে সঙ্গে মমতাজ বেগম আন্দোলন-সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ছাত্রী ও পাড়া-মহল্লার মহিলাদের তিনি সংগঠিত করতে থাকেন। ইন্দিরা রোডের মরিচা হাউসে মহিলাদের জন্য আয়োজিত অস্ত্র চালানো ও অন্যান্য প্রশিক্ষণকার্যে তিনি অংশগ্রহণ করেন। ২৫শে মার্চ রাতে ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরু এবং তাদের হাতে বন্দি হওয়ার পূর্বে ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে মমতাজ বেগম প্রথমে কুমিল্লায় হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় ভূমিকা পালন করেন। অতঃপর কসবা সীমান্ত দিয়ে তিনি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় চলে যান। সেখানে অবস্থানকালে বাঙালি শরণার্থী ও মুক্তিযোদ্ধাদের পক্ষে নানামুখি তৎপরতা চালিয়ে যান। এক পর্যায়ে তিনি কলকাতা চলে যান। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ১০ই এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য যে অনুষ্ঠানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ও আওয়ামী লীগের জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গণপরিষদ গঠিত হয় তিনি সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। বেগম সাজেদা চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত কলকাতার গোবরা ক্যাম্পে নারীদের যুদ্ধ প্রশিক্ষণসহ অন্যান্য প্রশিক্ষণকার্যের সঙ্গেও তিনি সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এছাড়া তিনি শরণার্থী ক্যাম্পে নানা সেবামূলক কাজ পরিচালনা করেন। তরুণদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণে মটিভেটর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের মে মাসে ছাত্রলীগের নেতাকর্মী ও বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারীদের নিয়ে বিএলএফ বা ‘মুজিব বাহিনী’ গঠিত হলে মমতাজ বেগম শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বাধীন পূর্বাঞ্চলীয় মুজিব বাহিনীর পরিচালনা পরিষদের সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।

মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিসমাপ্তির পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে দেশের পুনর্গঠন-পুনর্বাসন কার্য বিশেষ করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নির্যাতিতা নারীসহ অন্যান্য নারীদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ বাস্তবায়নে মমতাজ বেগম আত্মনিয়োগ করেন। তিনি বিচারপতি কে এম সোবহানের নেতৃত্বে গঠিত নারী পুনর্বাসন বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সহ-সভানেত্রী ও এ সংস্থার লিগ্যাল এইড কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে দীর্ঘদিন দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগের তিনি সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। তিনি মহিলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ গঠনেও নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। ২০০৯ সাল থেকে আমৃত্যু তিনি জাতীয় মহিলা সংস্থার চেয়ারম্যান হিসেবে নারীর সার্বিক উন্নয়নে বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করেন।

মমতাজ বেগম একাধিক গ্রন্থ রচনা/সম্পাদনা করেন। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানসহ তাঁর কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বিভিন্ন সংস্থা থেকে সম্মাননা পদক লাভ করেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ‘বেগম রোকেয়া পদক ২০১৪’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, মুজিব বাহিনীর বৃহত্তর কুমিল্লা অঞ্চলের অধিনায়ক, প্রখ্যাত আইনজীবী সৈয়দ রেজাউর রহমান মমতাজ বেগমের স্বামী। ২০২০ সালের ১৭ই মে মমতাজ বেগম মৃত্যুবরণ করেন। এ দম্পতির দুই পুত্র ও এক কন্যা সন্তান রয়েছে। [হারুন-অর-রশিদ]

তথ্যসূত্র অধ্যাপক মমতাজ বেগম ও মফিদা বেগম, স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলার নারী (ঢাকা হাক্কানী পাবলিশার্স ২০১৮), পৃ. ৬০-৬৬