বেগম, ফিরোজা

বেগম, ফিরোজা (১৯৩০-২০১৪) উপমহাদেশের সংগীত জগতের এক উজ্জল নক্ষত্র ফিরোজা বেগম। তাঁর জন্ম ২৮শে জুলাই ১৯৩০ সালে। তিনি ফরিদপুর জেলার কাশীয়ানী থানার ঘোনাপাড়ার এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম খান বাহাদুর মুহাম্মদ ইসমাইল এবং মাতার নাম কাও-কব-উনন্নেসা। পিতা ছিলেন একন বিশিষ্ট আইনজীবী। পশ্চিমবঙ্গের আলীপুর কোর্টে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল তৎকালীন ব্রিটিশ সরকারের আমলে প্রথম মুসলিম সরকারি আইনজীবী হিসেবে। তিনি বহুমুখী সমাজকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান যেমন স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘খান বাহাদুর’ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি নিজেও সংগীত প্রেমিক ছিলেন।

ফিরোজা বেগম

শিল্পী ফিরোজা বেগম আট বছর বয়স থেকে সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় সংগীত সাধনায় ব্রত হন। তিনি যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়েন তখন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে অডিশন দিয়ে শিশুশিল্পী হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়ে অনুষ্ঠানে গান করতে শুরু করেন। সেই থেকে সংগীত জগতে যাত্রা শুরু। কিশোরী ফিরোজা বেগম শুধু গান নয়, পাশাপাশি অভিনয়, নৃত্য, আবৃত্তি, সাঁতার প্রতিটি বিষয়ে প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেন। তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওতে কাজী নজরুলের অনেক নাটকে গানসহ অভিনয় করেছিলেন।

সংগীত শিক্ষা গ্রহণের ক্ষেত্রে তাঁর সংগীত শিক্ষক ছিলেন চিত্ত রায় এবং কমল দাশগুপ্ত। পরবর্তীতে কমল দাশগুপ্তের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। কমল দাশগুপ্তের মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাঁরই কাছে সংগীত শিক্ষা লাভ করেন।

উল্লেখ্য, কমল দাসগুপ্ত কাজী নজরুলের একজন ঘনিষ্ঠ সহচর হিসেবে বহু বছর এক সঙ্গে কাজ করেন। তিনি একজন প্রখ্যাত শিল্পী, সুরকার ও সংগীত পরিচালক ছিলেন। প্রখ্যাত এই সংগীতজ্ঞ ২০শে জুলাই ১৯৭৪ সালে মৃত্যুবরণ করেন। ফিরোজা বেগম নজরুল সংগীত ছাড়াও আধুনিক গান, গীতগজল, কাওয়ালী, ভজন, হামদ্, নাত, লঘু ক্লাসিকাল, রবীন্দ্রসংগীতসহ বিভিন্ন ধরণের গানে পারদর্শী ছিলেন।

নজরুল সংগীতের লং প্লে (রেকর্ড) ও উর্দু গজলের বহু রেকর্ড তাঁর কণ্ঠে প্রকাশিত হয়। বিশেষকরে নজরুল সংগীতের রেকর্ড শুনে সাধারণ মানুষের মধ্যে এক অসাধারণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পরবর্তীতে তাঁর গীত ১২টি এলপি (লং প্লে) ১২টি ইপি, ৬টি সিডি, এবং ২০টির মতো অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়ে।

শিল্পী হিসেবে তিনি বিশ্বের বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন এবং বাংলা গানের প্রচার ও প্রসারে অনন্য ভূমিকা রেখেছেন। তিনি চীন, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ভারতসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে একাধিকবার সংগীত পরিবেশেন করতে যান। জানা যায়, তিনি সর্বমোট ৩৮০টি একক অনুষ্ঠান করেন। কাজী নজরুলের গান পরিবেশন ও প্রচার-প্রসারের লক্ষ্যে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অত্যন্ত সুখ্যাতির সঙ্গে শ্রোতাদের মুগ্ধ করেন।

ফিরোজা বেগম কণ্ঠশিল্পী ছাড়া স্বরলিপিকার হিসেবেও অবদান রেখেছেন। কাজী নজরুল ইসলাম অসুস্থ হওয়ার পর তিনিই প্রথম নজরুল সংগীতের স্বরলিপি রচনা করেন যা ১৯৬০ সালে পশ্চিমবঙ্গের হরফ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়। এরপর তদানীন্তন পাকিস্তান আমলে বাংলা একাডেমির অনুরোধ পেয়ে ১০০টি নজরুল সংগীত স্বরলিপির জন্য প্রদান করেন। বাংলা একাডেমি থেকে তিনটি স্বরলিপি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। এছাড়াও নজরুল একাডেমীকে ৫০টি গান ও ‘বইঘর’ কে ১০০টি স্বরলিপি প্রদান করেন, যদিও আজও তা প্রকাশিত হয়নি। খ্যাতনামা শিল্পী ফিরোজা বেগম দেশ-বিদেশ থেকে অজ¯্র পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। সরকার কর্তৃক সংগীতে অবদানের জন্য তিনি ‘স্বাধীনতা পদক’ এবং ‘একুশে পদকে’ ভূষিত হন। এছাড়াও তিনি বহু বেসরকারি পদক ও সম্মাননা লাভ করেন। পশ্চিমবঙ্গ থেকে তিনি যেসব পুরস্কার প্রাপ্ত হন সেগুলি হলো- নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু স্মারক; সত্যজিৎ রায় স্মারক; নজরুল একাডেমী, চুরুলিয়া স্বর্ণপদক; আসাম, ত্রিপুরা ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের যৌথ উদ্যোগে শ্রেষ্ঠ নজরুল- সংগীত শিল্পীর সম্মাননা; বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি.লিট ডিগ্রি।

সংগীতে অসামান্য কৃতিত্বের সঙ্গে-সঙ্গে তিনি বিভিন্ন সমাজকল্যাণ কাজের সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। বারডেম হাসপাতালের প্রতিষ্ঠালগ্নে এর প্রতিষ্ঠাতা ডক্টর ইব্রাহিম-এর অনুরোধে আর্থিক সহায়তার জন্যে তিনি চ্যারিটি শো করেন। সম্মানস্বরূপ তাঁর বারডেম হাসপাতালের আজীবন সদস্য করা হয়। তা ছাড়া পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুর পুকুর ক্যান্সার সেন্টার ও ওয়েলফেয়ার হোম-এর সাহায্যার্থেও তিনি চ্যারিটি শো করেন।

বাংলাদেশের কবি নজরুল ইন্সটিটিউট-এর ‘নজরুল সংগীতের বাণী ও সুরের সত্যায়ণ’ এবং ‘স্বরলিপির শুদ্ধতা যাচাইয়ে’র জন্যে ১৯৮৫ খ্রি. সরকার কর্তৃক বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত ‘নজরুল সংগীত স্বরলিপি প্রমাণীকরণ পরিষদের’ তিনি সভানেত্রী ছিলেন। কমল দাশগুপ্ত ও ফিরোজা বেগম দম্পতির ৩ পুত্র সন্তান রয়েছে। বাংলা সংগীতের এই গুণী শিল্পী ২০১৪ সালের ৯ই সেপ্টেম্বর মৃত্যুবরণ করেন। [লীনা তাপসী খানম]

তথ্যসূত্র মোবারক হোসেন খান (সম্পা.), সংগীত সাধক অভিধান, বাংলা একাডেমি ২০০৩; নজরুল ইনস্টিটিউট পত্রিকা ও স্মরণিকা, ঢাকা ১৯৯৮।