বেগম, নূরজাহান

বেগম, নূরজাহান (১৯২৫-২০১৬) নারী সাংবাদিকতার অগ্রদূত, বিখ্যাত ‘বেগম’ পত্রিকার সম্পাদক। ১৯২৫ সালের ৪ঠা জুন চাঁদপুরে অবস্থিত চালিতাতলি গ্রামে তাঁর জন্ম। তাঁর পিতা ছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক, ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন এবং মাতা ফাতেমা খাতুন। নূরজাহান বেগমের ডাক নাম ছিল নূরী এবং অফিসিয়াল নাম ছিল নুরুন নাহার। পরবর্তীকালে তাঁর নানীর ইচ্ছায় নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় নুরজাহান বেগম। তৎকালীন রক্ষণশীল সমাজে নারীদের লেখাপড়ার প্রতি অনাগ্রহ এবং মায়ের প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও প্রগতিশীল পিতার হাত ধরে তিনি বিহার রাজ্যের ভাগলপুর জেলার বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল স্কুলে শিশু শ্রেণিতে ভর্তি হন। এই বিদ্যালয়ে এক বছর অধ্যয়নের পর বেলতলা হাইস্কুলে দ্বিতীয় থেকে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন করে পুনরায় ফিরে আসেন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে। এই বিদ্যালয় থেকে ১৯৪২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৪৪ সালে কলকাতার লেডি ব্রাবোর্ন কলেজ থেকে ইন্টারমেডিয়েট এবং একই কলেজ থেকে ১৯৪৬ সালে ¯œাতক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

নূরজাহান বেগম

কলকাতায় নূরজাহান বেগম থাকতেন ১১ নম্বর ওয়েলেসলি ষ্ট্রীটের দোতলা বাড়িতে। দোতলার একদিকে ছিল ‘সওগাত’ পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল ‘ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টার্স’ প্রেস আর অন্যদিকে থাকা-খাওয়ার ঘর। নূরজাহান বেগম হারমোনিয়াম ও অর্গান বাজিয়ে গান গাইতেন। স্কুলের অনুষ্ঠানে গান, নৃত্য, নাটকে অংশগ্রহণ করতেন। তিনি লেখাপড়ার সাথে সাথে রান্না, সেলাই, ছবি আঁকা সবই শেখেন। কলেজ জীবনে তিনি ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকটির নাট্যরূপ দেন ও পরিচালনা করেন এবং তাতে নাম ভূমিকায় অভিনয় করেন। ‘মেঘদূত’ নাটকে নাচের মাধ্যমে মেঘের গতিবিধি তুলে ধরে কৃতিত্বের পরিচয় দেন। ১৯৪৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখা দিলে অন্যান্যদের সঙ্গে তাঁর উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ‘মুসলিম অরফ্যানেজ ও উইমেনস হোম’ নামে একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারি ছিলেন। দুস্থদের সাহায্য করার জন্য নূরজাহান বেগমের পরিচালনায় ওয়াইএমসিএ-তে রবীন্দ্রনাথের ‘সামান্য ক্ষতি’ নামে নাটক মঞ্চস্থ হয়। তখন তিনি থাকতেন দরগাহ রোডের ৫৯ নম্বর বাড়িতে।

১৯৪৭ সালের ২০ই জুলাই (রবিবার, ৩রা শ্রাবণ ১৩৫৪ বঙ্গাব্দ) প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক ‘বেগম’ পত্রিকা প্রকাশিত হয়। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের ছবি স্থান পায়। প্রথম দিকে নূরজাহান বেগম ‘বেগমে’র ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। এর মূল্য ছিল প্রতি সংখ্যা চার আনা, বার্ষিক মূল্য ১২ টাকা। ১৯৪৮ সালে তিনি কলকাতায় প্রথম ঈদ সংখ্যা ‘বেগম’ প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে ‘বিশ^নবী সংখ্যা বেগম’ প্রকাশিত হয়। ১৯৫০ সালে বাবার সাথে নূরজাহান বেগম ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় এসে ৩৮ নম্বর শরৎগুপ্তের বাড়িতে ‘বেগম’ এর কাজকর্ম শুরু হয়। ১৯৫১ সালে ঈদ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যায় ৬২ জন মহিলা লেখিকার লেখা ছাপা হয়। এর মূল্য ছিল ২ টাকা। ১৯৫৪ সালের ১৫ই ডিসেম্বর ‘বেগম ক্লাব’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সেক্রেটারি নির্বাচিত হন নূরজাহান বেগম। এর প্রাথমিক সদস্য সংখ্যা ছিল ৬৪। তবে ১৯৬৯-এর অসহযোগ আন্দোলনের পর বেগম ক্লাবের কর্মকা- বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫২ সালে ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ পত্রিকার কচিকাঁচার মেলার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক শিশুসাহিত্যিক রোকনুজ্জামান খানের সাথে নূরজাহান বেগম বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। তিনি ওয়ারী মহিলা সমিতি, নিখিল পাকিস্তান সমিতি এবং গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতির সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ সালে তিনি নারিন্দা মহিলা সমিতি গঠন করেন এবং এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি আপওয়া, জোনটা ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ শিশু কল্যাণ পরিষদ, মহিলা পরিষদ, বাংলাদেশ লেখিকা সংঘ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।

তিনি তাঁর কর্মজীবনের স্বীকৃতিস্বরূপ রোকেয়া পদক (১৯৯০), নন্দিনী সাহিত্য ও পাঠচক্র সম্মাননা (১৯৯৬), গেন্ডারিয়া মহিলা সমিতি শুভেচ্ছা ক্রেস্ট (১৯৯৯), অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার (২০০৩) নারীপক্ষ দুর্বার নেটওয়ার্ক (২০০৩), কন্যা শিশু দিবস সম্বর্ধনা (২০০৫), ইনার হুইল সম্মাননা (২০১০), একুশে পদক (২০১১) অর্জন করেন। এছাড়াও কাজী মাহবুবউল্লাহ-জেবুন্নেছা ট্রাস্ট, বাংলাদেশ সাংবাদিক ফোরাম, রোটারী ক্লাব কর্তৃক বিভিন্ন সময়ে স্বর্ণপদক এবং সম্মানসূচক সম্বর্ধনা অর্জন করেন।

১৯৯৯ সালের ৩রা ডিসেম্বর নূরজাহান বেগমের স্বামী মৃত্যুবরণ করেন। ২০১৬ সালের ২৩শে মে এই মহিয়সী নারীর জীবন অবসান হয়। [জেবউননেছা]