বৃহদ্ধর্ম পুরাণ
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ একটি উপপুরাণ। মহাপুরাণের সংখ্যা ১৮টি। মহাপুরাণগুলি ব্যতীত এবং লেখকের নাম উল্লেখবিহীন পুরাণসমূহকে উপপুরাণ বলা হয়। বৃহদ্ধর্ম পুরাণকে ধর্ম সংজ্ঞীতা বা ধর্মনামকও বলা হয় এবং এটি একটি উপদলীয় অসূয়ামুক্ত উপপুরাণ, যার মধ্যে ধর্মীয় ঔদার্যগুণের ঐতিহ্যকে প্রথায় রূপান্তরিত করা হয়েছে।
পুরাণ শব্দটির অর্থ পুরাণম্ আখ্যাণম্। সম্ভবত পুরাণ কিংবদন্তি ও লোককাহিনীর সাথে সম্পর্কিত প্রাচীন বর্ণনা। সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা হিসেবে পুরাণসমূহ প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির উৎসরূপে ঐতিহাসিকদের নিকট গুরুত্বপূর্ণ, যদিও ঐতিহাসিক প্রয়োজন পূরণে এগুলির তথ্যসমূহকে সতর্কতার সাথে গ্রহণ করতে হয়।
বাংলায় ম্লেচ্ছ এবং যবনদের অত্যাচারের উল্লেখ এবং আদর্শ পরিমাপ পদ্ধতি, বিশেষত ‘সেরক’ (‘সেতক’ হিসেবে উল্লিখিত) হতে পন্ডিতগণ এটিকে তেরো শতকের রচনা বলে মত প্রকাশ করেছেন।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ তিনটি খন্ডে বিভক্ত: পূর্ব খন্ড, মধ্যম খন্ড এবং উত্তর খন্ড। পূর্ব এবং মধ্যম খন্ডের প্রত্যেকটিতে ৩০টি করে অধ্যায় রয়েছে, উত্তর খন্ডে আছে ২১টি অধ্যায়।
পূর্ব খন্ডে ধর্মের প্রশংসা এবং এর অনুশীলনের প্রয়োজনীয়তা প্রভৃতি বিষয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। দয়া, সত্য, শান্তি, অহিংসা এসব গুণ, পিতাপাতা এবং গুরুর প্রতি আনুগত্য এবং সেবাসহ গভীর শ্রদ্ধামিশ্রিত মন্ত্র পাঠের দ্বারা দীক্ষাগুরুর প্রশংসা, তীর্থস্থানে ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান, রামায়ণের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতক - দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ) কাহিনীর বর্ণনা, দেবী পূজার নিয়ম, বেশ কিছু ধর্মীয় কৃত্যানুষ্ঠান ও উৎসব যেমন লক্ষ্মীপূজা, রাসযাত্রা, বাণী সৃষ্টি, দর্শনভিত্তিক রচনা, রামায়ণের সাতটি অংশের (সপ্তখন্ড) বর্ণনা, প্রভৃতি নিয়ে ধর্ম গঠিত।
মধ্যম খন্ডে ব্রহ্মার উৎপত্তি, বিভিন্ন দেব-দেবীর সৃষ্টি প্রভৃতি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। সতীর স্বয়ংবর, দক্ষের যজ্ঞ ও এর সাথে সম্পর্কিত ঘটনাসমূহ, পীঠসমূহের উৎপত্তি, ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব কর্তৃক সতীর তুষ্টিসাধন, গঙ্গার উৎপত্তি, শিব ও গঙ্গার মিলন, শিবের গাজন, বালীর উপাখ্যান, পৃথিবীতে গঙ্গার আগমনে ভগীরথের ভূমিকা, গঙ্গামাহাত্ম্য প্রভৃতি বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত।
উত্তর খন্ড বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষার উদ্দেশ্যে একান্তভাবে নিয়োজিত। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্যএবং শূদ্র-দের পাশাপাশি বিভিন্ন আশ্রমের দায়িত্বের প্রশংসা; নারীর কর্তব্য; বর্ণাশ্রম নির্ণয়; বর্ণসঙ্কর (মিশ্র বর্ণ) ব্যবস্থা; দানের মহিমা; প্রভু কৃষ্ণের জন্ম এবং তাঁর রোমাঞ্চকর কীর্তি; কালের (শুভকাল) বর্ণনা; বৃহদ্ধর্ম পুরাণ পাঠের প্রশংসা প্রভৃতি বিষয় এর অন্তর্ভুক্ত।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ যে বাংলা অঞ্চলে রচিত হয়েছে তা বেশ কয়েকবার উল্লেখ করা হয়েছে। ছত্রিশটি মিশ্র বর্ণ, বৈদ্য গণক; ক্ষত্রিয়দের বংশনামে দেব-শর্মণ, রায় এবং বর্মণ, বৈদ্যের ক্ষেত্রে ‘ধন’ প্রভৃতি; জননী বোঝাতে ‘মা’ শব্দের ব্যবহার এবং বোন অর্থে ‘ভগ্নি’ শব্দের ব্যবহার; কতিপয় সংস্কৃত শব্দ এবং বাচনিক উৎস যেমন বসে থাকা বোঝাতে (বস্> উসিত) ‘বস্’ শব্দের ব্যবহার; প্রতিজ্ঞা অর্থে ‘স্বীকার’ শব্দের ব্যবহার; কালী দেবীর পূজার বর্ণনা; রাস উৎসবের প্রথা পদ্ধতি; বাংলার সকল অংশে চৈত্র মাসে শিবোৎসব (চড়ক পূজা) অনুষ্ঠান; মঙ্গলোকস্থের (বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোট) পীঠের উল্লেখ প্রভৃতি থেকে বৃহদ্ধর্ম পুরাণ যে বাংলা অঞ্চলেই রচিত হয়েছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণে দেবদেবীর মর্যাদা সম্পর্কে তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। প্রভু বিষ্ণু লক্ষ্মী দেবীকে বলেন যে, শিব তাঁর প্রিয়তম ও তাঁরা অভিন্ন। দেবীপূজা, দেবীবোধন, বিল্ববৃক্ষ হতে শুল্কা ষষ্ঠী পর্যন্ত দেবীপূজা, সপ্তমী তিথিতে দেবীপূজা করলে নির্মিত গৃহে দেবীর আগমন ঘটে, ‘হোম’ সম্পাদন, মহাষ্টমী তিথিতে পূজারাতে জেগে থাকা, অষ্টমী-নবমী সান্ধিতে সান্ধি পূজা, বিজয়া দশমী তিথিতে নারী-পুরুষের প্রজনন অঙ্গের সাথে সম্পর্কিত প্রণয়াকুল সঙ্গীতচর্চা বিষয়ে পূর্ব খন্ডের ২২তম অধ্যায়ের প্রাসঙ্গিক শ্লোকসমূহে উল্লেখ পাওয়া যায়। বৃহদ্ধর্ম পুরাণে সন্ধ্যাকালে (প্রদোষ) দেবীপূজা করা উচিত এবং পূজারীদের সারাদিন উপবাসের পর লক্ষ্মীপূজা শেষে ডাবের জল পানের উপদেশ দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, কালী/শ্যামা পূজার সময় প্রদীপ জ্বালাতে হবে এবং গভীর রাতে দেবী অর্চনা করতে হবে। পূর্ব খন্ডের ১২-১৭ নম্বর শ্লোকসমূহে কালীর বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। এখনও রাস উৎসবকালে ভগবান কৃষ্ণের আরাধনা করা হয়। মধ্য খন্ডের ৪৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে যে, ব্রহ্মার ক্রোধ থেকে মহারুদ্রের উৎপত্তি হয়েছে। ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিবের উৎপত্তি সম্পর্কে বলতে গিয়ে আরও বলা হয়েছে যে, সতী তার ‘মূল-প্রকৃতি‘ শিবের কাছে তুলে ধরেন। এ মূল-প্রকৃতিতে দশটি রূপের সমন্বয় ঘটেছে। এ দশটি রূপ হলো যথা: কালী, তারা, ষোড়শী, ভুবনেশ্বরী, ভৈরবী, ছিন্নমস্তা, সুন্দরী, বগলামুখী, ধূমবতী এবং মাতঙ্গী।
সুতরাং এটা দেখা যায় যে, তেরো শতকে বাংলায় এসব দেবদেবী সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করেছে। সাধারণ শ্রেণীর মানুষকে পাঁচ দেবতার (গণেশ, সূর্য, বিষ্ণু, অম্বিকা এবং শিব) দশ দিকপাল (ইন্দ্র, অগ্নি, যম, নির্ঋত, বরুণ, বায়ু, কুবের, ঈশান, ব্রহ্মা এবং অনন্ত) এবং নয় গ্রহের (সূর্য, সোম প্রভৃতি) প্রতি যথার্থভাবে বন্দনা করতে উপদেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে তাদের কর্মে সফলতা আসে।
বৃহদ্ধর্ম পুরাণ গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, এতে বাংলার কলিযুগের ধর্মীয় এবং সামাজিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এতে বলা হয়েছে যে, কলিযুগে মানুষ আক্রমণোদ্যত (পরস্পর বধেপ্সবঃ)। পাষন্ড ধর্মের দ্বারা বৈদিক ধর্মের উৎখাত হয়। পাষন্ড এবং যবনেরা বর্ণাশ্রম ধর্ম ধ্বংস করে। পুরাণ এবং অন্যান্য দর্শন ব্যবস্থার মধ্যে তীব্র বিবাদ চলছিল। দেবতারা পৃথিবী হতে বিদায় নিচ্ছিলেন এবং যবন ও ম্লেচ্ছগণ ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছিল। এক কথায়, পুরাণের এ অধ্যায়ে একটি সামাজিক সঙ্কটের যুগের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে যা বর্তমানে একটি বহুল বিতর্কিত বিষয়।
ম্লেচ্ছ, যবন এবং পাষন্ডদের সম্পর্কে কিছু কথা-বার্তার মাধ্যমে এ আলোচনা শেষ করা হয়েছে। এ পুরাণ বাংলায় পৌরাণিক ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচারভিত্তিক একটি ব্রাহ্মণ্য সমাজ গঠনের চেষ্টা করেছে। স্থানীয় দেব-দেবী এবং ধর্মীয়প্রথা সমাজের স্বীকৃতি লাভ করেছিল। বেদের শ্লোক অনুসারে ব্রাহ্মণদের প্রাধান্য এবং বর্ণাশ্রমের প্রয়োজনীয়তার কথাও এতে বলা হয়েছে। প্রকৃত পক্ষে, এ পুরাণ বাংলায় একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যসূচক আঞ্চলিক ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতি সৃষ্টির চেষ্টা করেছে। যারা প্রচলিত ব্রাহ্মণ্য ধর্মীয় আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না, তাদেরকে বহিরাগত মনে করা হতো এবং সম্ভবত তাদেরকেই ‘ম্লেচ্ছ’ ও ‘যবন’ নামে ডাকা হতো। বৌদ্ধদেরকে ‘পাষন্ডী’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কারণ, তারা বেদকে যথার্থ বলে বিবেচনা করত না (বৌদ্ধাঃ পাষন্ডিনাঃ প্রোক্তঃ যতো বই বেদনিন্দক)। তারা বেদে বর্ণিত পথ থেকেও বিচ্যুত হয়েছে (বেদমার্গবহিষ্কৃত) কারণ, তারা বর্ণধর্ম ত্যাগ করেছে। বৌদ্ধদেরকে ক্ষতিকর এবং অশুভ শক্তির দৃশ্যমান প্রতীক এবং সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও সমস্যার জন্য দায়ী করা হতো। প্রকৃতপক্ষে, এ ধরনের অসহিষ্ণু মানসিকতার উদ্ভব হয় এ মনোভাব থেকে যে, বৌদ্ধ মতবাদের ধর্মীয় সামাজিক প্রভাব নিশ্চিহ্ন করতে না পারলে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। [কৃষ্ণেন্দু রায়]