বীন

বীন বাংলাদেশের অন্যতম ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী। তাদের আদিনিবাস পশ্চিমবঙ্গের বিহার সীমান্তে। জীবিকার সন্ধানে তারা সিলেট অঞ্চলে আসে এবং সেখানকার চা বাগানগুলিতে কাজ শুরু করে। বর্তমানে তারা মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে বিভিন্ন চা বাগানের চা-শ্রমিক হিসেবে বসবাস করছে। বীনদের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার।

বীনেরা নিজেদের মধ্যে হিন্দীভাষা ব্যবহার করে। তবে তারা বাংলাও বলতে পারে। বিদ্যালয়গামী ছেলেমেয়েরা বাংলা ভাষায় পাঠগ্রহণ করে। বীন জনগোষ্ঠী আমিষভোজী। জঙ্গলে জন্মানো আলু ও ফলমূল তারা খেতে পছন্দ করে।

বীন সমাজে শিক্ষার হার খুবই কম। প্রতি একশো জনে দশ জনের মতো অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন ব্যক্তির অস্তিত্ব জানা যায়। বীন জনগোষ্ঠী একটিমাত্র গোত্রের অন্তর্গত এবং এই গোত্র কয়েকটি বংশ বা গোষ্ঠীতে বিভক্ত। বীন সমাজে নিজ বংশ বা গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ। বীন সমাজ পিতৃপ্রধান। পিতার মৃত্যুর পর পরিবারের পুত্রসন্তান সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়। যেকোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে পারস্পরিক সহযোগিতা এবং মিলেমিশে কাজ করা তাদের জাতিগত বৈশিষ্ট্য। যেকোনো সমস্যা সামাজিক মধ্যস্থতায় সমাধান করা হয় এবং এজন্যে আইনের সহায়তা নিতে কাউকে দেখা যায় না।

বীন জনগোষ্ঠী ধর্মবিশ্বাসে হিন্দু। তারা দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী, শনি, কার্তিক, গণেশ, বিশ্বকর্মা প্রভৃতি দেবদেবীর পূজা করে থাকে। তারা শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি (জন্মাষ্টমী) পালন করে। এছাড়া বীনেরা রামনবমী, হোলিখেলা, দীপান্বিতা প্রভৃতি উৎসব সাড়ম্বরে পালন করে।

ছেলে অথবা মেয়ে বিয়ের উপযুক্ত হলে মা-বাবা অথবা অভিভাবকরাই বিয়ের প্রস্তাব আদানপ্রদান করে ও বিয়ের যাবতীয় প্রস্ত্ততি সম্পন্ন করে। বীন জনগোষ্ঠী সগন, কহরভাত, মূল বিবাহ, পর্চাবন, মানানা, দুয়ার লঙ্গাই, মুহদেহাই, নওরতন ইত্যাদি বিবাহ অনুষ্ঠান পালন করে। সধবা বীন মহিলারা সিঁথিতে সিঁদুর ও হাতে শাঁখা পরে। সমাজে কন্যাপণ এবং যৌতুক প্রথা প্রচলিত আছে। স্বামী ও স্ত্রী উভয়ের ক্ষেত্রে বিবাহ-বিচ্ছেদের প্রথা রয়েছে।

বীনেরা মৃতদেহ দাহ করে। মৃত ব্যক্তির জ্যেষ্ঠ পুত্র অথবা তার অবর্তমানে অন্য কোনো পুত্র মুখাগ্নি করে। মৃত ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ আত্মীয়েরা ষোলদিন পর্যন্ত শোকদিবস পালন করে। এ ষোলদিনের প্রথম দশদিন প্রধান শোকার্ত ব্যক্তি মৃতব্যক্তির বিদেহী আত্মার উদ্দেশ্যে অন্নজল উৎসর্গ করে। বীনেরা এ প্রথাকে ‘দাগুয়া খানা’ বলে। ষোলতম দিবসে মৃত ব্যক্তির শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান পালিত হয়। বীনদের নিকট এ অনুষ্ঠান ‘শরহাইয়া শ্রাদ্ধ’ নামে পরিচিত।  [সুভাষ জেংচাম]