বিশ্বায়ন

বিশ্বায়ন প্রতিটি দেশ বা অঞ্চলের বৈশ্বিকভিত্তিতে অন্যান্য দেশ বা অঞ্চলের সাথে একীভূত করার প্রক্রিয়া। বহুমূখী এ প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে অর্থনৈতিক, কারিগরি, সামাজিক ও কৃষ্টি এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রাবলী। বহুল প্রচলিত এ শব্দটিকে অবশ্য বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়। জাতীয় অর্থনৈতিক কাঠামোকে আর্ন্তজাতিক অর্থনীতির সাথে একীভূতকরণের প্রক্রিয়াকে ব্যাখা করার জন্য এ শব্দটি অধিকতর ব্যবহূত হয়ে থাকে। এ ধরনের একীভূত প্রক্রিয়ায় বাণিজ্য, প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ, মূলধনের প্রবাহ, বর্হিবিশ্বে বসবাস ও কারিগরি প্রযুক্তিই হলো এ প্রক্রিয়ার চালিকা শক্তি।

অনেকে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়াকে নতুন হিসাবে দেখে একে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সাথে যুক্ত করলেও, প্রকৃতপক্ষে বহু পূর্বে এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। সার্বিকভাবে বলা যায় যে, সভ্যতার ক্রমবিকাশের ধারার মধ্যেই ছিল এর উৎস। বিগত পঞ্চাশ বছরে এ প্রক্রিয়া অধিকতর গতিশীল হয়। প্রাচীন রোমান, পার্থিয়ান ও হান সাম্রাজ্যের সাথেও একে যুক্ত করা হয়। এছাড়া মুসলিম ব্যবসায়ী এবং আবিষ্কারার্থে বিশ্বভ্রমণকারীরাও বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার উৎসের সঙ্গে যুক্ত। ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগালের বিশ্বব্যাপী আবিষ্কারমূলক ভ্রমণের ফলে বিভিন্ন মহাদেশ, অর্থনীতি ও কৃষ্টির সংমিশ্রণ ঘটে।

বৈশ্বিক বাণিজ্য, উপনিবেশিকরণের কারণে কৃষ্টির প্রসার অর্জিত হয়। এ প্রক্রিয়া আবিষ্কারের যুগ হিসাবে সুপরিচিত। সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্ভবের ফলে এ প্রক্রিয়া অধিকতর প্রসারিত হয়। এ কোম্পানিকে অনেকে প্রথম বহুজাতিক সংস্থা বা করপোরেশন হিসাবে উল্লেখ করেন। ফ্রান্সও এ ধরনের উপনিবেশিক পথ অবলম্ব^ন করে। কোম্পানিভিত্তিক এ মডেল অনুসরণ করে পরবর্তীকালে ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি (১৬০২) এবং পর্তুগিজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উদ্ভব হয়। উনবিংশ শতাব্দী ছিল বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম ভাগ। এ সময়ের বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ইউরোপে রাজকীয় শক্তিসমূহ, এদের উপনিবেশ হয়ে ওঠা দেশগুলি এবং পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগের প্রসার লাভ করে। সাব-সাহারান আফ্রিকা ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপসমূহ বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় আওতাভুক্ত করা হয়।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রথম ভাগ যথাক্রমে স্বর্ণমান সংক্রান্ত সংকট (১৯২০) এবং মহামন্দা (১৯৩০) সময়কালে সমাপ্ত হয়। বিশ্বায়নের আধুনিক পর্যায় শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে। পশ্চিমা বিশ্বের প্রথম সারির রাজনীতিবিদরা এ প্রক্রিয়া চালু করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্রেটন উডস সম্মেলনের মাধ্যমে এ উদ্যোগ বাস্তবরূপ ধারণ করে। বিশ্ব বাণিজ্য ও অর্থায়ন নিশ্চিত ও তা পরিবীক্ষণের জন্য একাধিক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি ও বিশ্বায়নের সাথে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত এ সম্মেলনে গৃহীত হয়। ফলশ্রুতিতে আর্ন্তজাতিক পুনর্বাসন ও উন্নয়ন (বিশ্বব্যাংক) এবং আর্ন্তজাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি অর্থাৎ জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ (গ্যাট) সংগঠিত হওয়ার ফলে বাণিজ্যসংক্রান্ত বাধা প্রশমিত হয়। পরবর্তী পর্যায়ে এ সংস্থা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লুটিও) নামে রূপান্তরিত হয়। এ সংস্থার কাজ হলো বাণিজ্য সংক্রান্ত বিবাদের মধ্যস্থতা ও আর্ন্তজাতিক ব্যবসা ও বাণিজ্যের বিধি প্রণয়ন করা। এ আধুনিক যুগে কিছু দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তির উদ্ভব ঘটে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ম্যাস্ট্রিখট চুক্তি, উত্তর আমেরিকা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (নাফটা), দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল (সাফটা), বঙ্গোপসাগরীয় বহুখাতসম্পদ কারিগরি ও অর্থনৈতিক চুক্তি (বিমসটেক) এবং এশীয় জাতিসমূহের সমিতি (আসিয়ান)-এর কথা। এসব চুক্তির ফলে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া অধিকতর প্রসারিত হয়।

বিশ্বায়নের অর্থনৈতিক প্রভাব পরিমাপ করা অপেক্ষাকৃত সহজ। এর মধ্যে চারটি উপাদান রয়েছে। (১) মালামাল ও সেবার প্রবাহ, (২) শ্রম ও জনশক্তির প্রবাহ, (৩) মূলধনের প্রবাহ, অর্থাৎ বহির্মুখী ও অন্তর্মুখী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ এবং (৪) প্রযুক্তির প্রবাহ। তবে বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার প্রভাব অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমিত নয়। এজন্য অনেকে এ সংক্রান্ত তিনটি ক্ষেত্র চিহ্নিত করেছেন; যথা: অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক। এ তিনটি ক্ষেত্রের মধ্যে কিছু অনুক্ষেত্র রয়েছে। এগুলি হচ্ছে অর্থনৈতিক প্রবাহ এবং কৃষ্টিগত নৈকট্য। এ ক্ষেত্রগুলি কেওএফ (KOF) নামে একদল সুইস চিন্তাবিদ ব্যবহার  করেছেন। অন্যরা এ ক্ষেত্রে ভিন্ন মানদন্ড ব্যবহার করে থাকেন। তবে একই রকমের মানদন্ড ব্যবহার না করা হলে বিশ্বায়নপ্রসূত প্রভাবের ফলাফলও ভিন্নতর হিসেবে চিহ্নিত হবে।

বিশ্বায়নের বহুমূখী ধারাসমূহের কয়েকটি ক্ষেত্রে বিভাজন করা সম্ভব। যথা: (১) শিল্প সংক্রান্ত (২) আর্থিক, (৩) অর্থনৈতিক, (৪) রাজনৈতিক, (৫) তথ্যপ্রবাহ, (৬) ভাষা, (৭) প্রতিযোগিতা, (৮) পরিবেশ, (৯) কৃষ্টি, (১০) সামাজিক, (১১) কারিগরি এবং (১২) আইনগত বা নৈতিক।

শিল্প সংক্রান্ত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়া বলতে বিশ্বব্যাপী উৎপাদন ও বিপণনের সুযোগ সৃষ্টির মাধ্যমে বিদেশি পণ্য ও মালামাল ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করাকে বোঝায়। বিশেষ করে এর ফলে দেশের অভ্যন্তরে বা বাইরে পণ্য ও মালামালের প্রাপ্যতা বৃদ্ধি হয়েছে। শিল্প সংক্রান্ত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য অনুন্নত দেশে তৈরি পোশাক শিল্প বিকশিত হয়েছে। অন্যান্য উদাহরণের মধ্যে রয়েছে উন্নয়নকামী দেশসমূহে রপ্তানি প্রক্রিয়া অঞ্চল এবং বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের উদ্ভব।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার আর্থিক ক্ষেত্র বলতে বোঝায় বিশ্বব্যাপী আর্থিক বাজারের প্রসার যার ফলে দেশে বা দেশের বাইরে থেকে অর্থ ঋণ নেওয়ার সুবিধা ও সুযোগ সৃষ্টি হয়।

বিশ্ব সরকার সৃষ্টিকে অনেকে বিশ্বায়নের রাজনৈতিক ক্ষেত্র হিসাবে সংজ্ঞায়িত করে থাকেন। এ প্রক্রিয়ার ভিন্নরূপ হলো কয়েকটি সরকার কর্তৃক প্রভাবিত ও পরিচালিত বহুপক্ষিক অর্থ লেনদেনের বা ব্যবসা-বাণিজ্যের সংস্থা যেমন ডব্লুটিও, বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ। এ সংস্থাগুলিই বৈদেশিক সাহায্যপুষ্ট দেশের অর্থনৈতিক, উন্নয়ন সংক্রান্ত নীতি নিয়ন্ত্রণ করে। এরা সংশ্লিষ্ট দেশের জনমানুষের প্রকৃত চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়ে উদাসীন বলে অনেকে মনে করেন।

তথ্য-প্রযুক্তির দ্রুত উন্নতির ফলে বিভিন্ন দেশের মধ্যে তথ্য প্রবাহের বিষয়টি অনেকাংশে বিনা বাধায় চালু হয়েছে। ফাইবার অপটিক সংক্রান্ত যোগাযোগ, উপগ্রহ ও টেলিফোনের সহজপ্রাপ্যতার ফলেই এটা সম্ভব হয়েছে।

ভাষা সংক্রান্ত বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে ইংরেজি ভাষা উপনিবেশিক দেশসমূহের মধ্যে মূলত সীমিত থাকলেও সময়ের বির্বতনে বর্তমানে এ ভাষা ব্যবহূত হচ্ছে সারা বিশ্বে।

বিশ্বায়নের অন্য একটি ক্ষেত্র হলো বিশ্বব্যাপী ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার কাঠামোর উদ্ভব। এর ফলে পণ্য উৎপাদনকারক সংস্থাগুলি সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে এবং তাদের উৎপাদন সংক্রান্ত দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে বিশ্বমানের পণ্য উৎপাদন করতে বাধ্য হয়েছে।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার পরিবেশগত বিষয়টি হলো বিশ্বের পরিবেশ রক্ষার সাম্প্রতিক হুমকির বিষয়াবলী। এর মধ্যে রয়েছে জলবায়ু পরিবর্তন, পানিবণ্টন সংক্রান্ত বিবাদ ও দূষণ, অতিমাত্রায় সামুদ্রিক মৎস আহরণ এবং ক্ষতিকর জীবাণুর প্রসার। এ বিষয়টি নিয়ে উন্নত ও উন্নয়নশীল বিশ্বের মধ্যে কিছুটা দ্বান্দ্বিক অবস্থান করেছে, যা কিয়োটা প্রটোকলে প্রতিফলিত হয়েছে। বলা হয়েছে বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত বিপর্যয়ের জন্য শিল্পোন্নত দেশগুলিই দায়ী এবং এজন্যই উন্নয়নকামী দেশগুলিকে তারা ক্ষতিপূরণ করতে বাধ্য।

অন্য একটি যুক্তি শিল্পোন্নয়ন সংক্রান্ত। উন্নয়নকামী দেশসমূহে অনেক কলকারখানা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এসব দেশে পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের কাঠামো দুর্বল। পরিবেশ রক্ষা সংক্রান্ত আইন বা বিধি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো ব্যবস্থা নেই বা থাকলেও তা দুর্বল। কাজেই পণ্য ও সেবার অধিকতর প্রবাহ দূষণ বৃদ্ধি করতে পারে। এ ছাড়া আরও যুক্তি প্রদর্শন করা হয় যে শিল্পের বিকাশের প্রাথমিক পর্যায়ে কিছু দূষণ সহ্য করা ছাড়া উপায় নেই। একই যুক্তিতে এ জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্য কিছু সময় অবশ্যই দিতে হবে যাতে করে জীবনযাত্রার মান এ সব দেশে ব্যহত না হয়।

বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার ফলে কৃষ্টির ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। এ অর্জনে তথ্য প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার, ভ্রমণ ও পর্যটনের অধিকতর বিকাশ, আইনি-বেআইনি অভিবাসন, বিশ্বব্যাপী খেলাধুলা যথা ফুটবল, ক্রিকেট, অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠান এবং ইন্টারনেট ব টেলিভিশনের মাধ্যমে বিশ্ব মিডিয়ায় সহজে প্রবেশ বিষয়গুলি সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করেছে।

ইন্টারনেট বা স্যাটেলাইট চ্যানেলের মাধ্যম ছাড়া বিশ্বায়নের প্রভাব তরুণ প্রজন্মের খাদ্যাভাসের ক্ষেত্রে উজ্জ্বলভাবে দৃশ্যমান। বাংলাদেশসহ এ পর্যায়ের অন্যান্য দেশে বার্গার এবং পিজ্জার বিক্রয়কেন্দ্রের উদ্ভব হয়েছে। কৃষ্টিভিত্তিক রেস্টুরেন্ট বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল অন্যান্য দেশেও এখন দেখা যায়।

সামাজিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের ফলে বেসরকারি সাহায্য সংস্থার উদ্ভব হয়েছে। এরা এককভাবে অথবা সরকারি সংস্থার সাথে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড বাস্তবায়ন করেছে। এ ধরনের কিছু সংস্থা জননীতি প্রণয়নসহ দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও বঞ্চিত সম্প্রদায়ের অধিকার সংক্রান্ত বিষয়ে সহায়ক উৎস হিসাবে সুপরিচিত।

কারিগরি প্রযুক্তির প্রসারের ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের অবদান বৈশ্বিক টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো প্রতিষ্ঠা ও প্রসার। এর ফলে আন্তর্জাতিক তথ্যপ্রবাহ বৃদ্ধিসহ বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে বুদ্ধিগত সম্পত্তি সংরক্ষণের অধিকারের (Intellectual Property Right) জন্য কপিরাইট, ট্রেডমার্ক ও পেটেন্ট আইনের হালনাগাদকরণ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছে।

সর্বোপরি আইন ও নৈতিক ক্ষেত্রে বিশ্বায়নের সুফলও দৃশ্যমান। উদাহরণস্বরূপ কযেকটি বিষয় উল্লেখযোগ্য। (১) অ-অপসারণীয় অধিকার (Inalienable) সংক্রান্ত ধারণার সংরক্ষণসহ এর অধিকতর সুসংহতকরণ এবং পুরুষ, নারী ও শিশু সংক্রান্ত সার্বজনীন নৈতিকতাবোধ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণ, (২) আর্ন্তজাতিক ফৌজদারি আদালত প্রতিষ্ঠাসহ আর্ন্তজাতিক ন্যায়বিচার সংক্রান্ত আন্দোলন, জাতিসংঘের বিভিন্ন কনভেনশনভিত্তিক নীতি যথা সার্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণাপত্র রাজনৈতিক, কৃষ্টিগত ও নাগরিক অধিকার এবং নারী ও শিশু সংক্রান্ত ঘোষণাপত্র।

বিশ্বায়নের সুফলের তালিকা সহজেই দীর্ঘায়িত করা সম্ভব। তবে এর কুফলও কিছু রয়েছে। সমালোচকদের মতে, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দরিদ্র জনগোষ্ঠী উপকৃত হয় নি। পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বিশ্বায়নের প্রভাব খুব একটা বেশি নয়। বৈশ্বিক অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে নি। অনেক সমালোচকের মধ্যে জোসেফ ই. স্টিগলিজের মতে বিশ্বায়ন কোন অবিমিশ্র আশীর্বাদ নয়। তিনি এ বিষয়ে কিছু অনুসন্ধানমূলক প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। স্টিগলিজ প্রদত্ত যুক্তির মূলবিষয় হলো কুপ্রভাবের জন্য বিশ্বায়ন নয় বরং যে প্রক্রিয়ায় এ ধারণাকে বাস্তবায়ন করা হয়েছে ঐ ব্যবস্থাপনাই এর জন্য দায়ী। ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার জন্য তিনি আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা্কে দায়ী করেছেন। তিনি মত প্রকাশ করেছেন যে এ সংস্থাগুলি যে নীতি প্রণয়ন করে তা শুধু উন্নতদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ করে থাকে। বিশেষ করে ঐ দেশসমূহের অভ্যন্তরীণ স্বার্থ। এতে উন্নয়নশীল দেশসমূহের কোন স্থান নেই। বিশ্বায়ন সংক্রান্ত এ সব দেশের ধারণা একটি বিশেষ অর্থনৈতিক ও সামাজিক রূপকল্প সঙ্কীর্ণ চিন্তার মধ্যে আবর্তিত। বিশ্বায়নের বিরুদ্ধে অসন্তোষের বিষয়টি এখন জোরেশোরে উচ্চারিত হচ্ছে। বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার দোহা রাউন্ডের আলোচনায় এর প্রতিফলন দৃশ্যমান ছিল। উন্নয়নশীল দেশসমূহ এখন ন্যায়সংগত বাণিজ্যের কথা সজোরে জানিয়ে দিয়েছে যে উন্নত দেশ দ্বারা প্রভাবিত নির্ধারিত যে নীতি বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা প্রণয়ন করেছে তার ভিত্তিতে কোন চুক্তি হতে পারে না। এ জন্য ন্যায়ভিত্তিক বাণিজ্যের দাবীতে এরা সোচ্চার। নিরপেক্ষ ও স্বাধীন চিন্তা সংস্থাসহ (Think tank) গবেষকরা এখন উন্নয়নশীল দেশের বাস্তবতাকে স্বীকার করার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রণীত উন্নয়ন দর্শন সংস্কারের প্রয়োজনীয়তার প্রস্তাবও দেওয়া হচ্ছে। বিশ্বায়নের মানবিক দিকগুলির স্বীকৃতিও প্রয়োজন।

তবে স্টিগলিজের মত অনুসরণ করে বলা যায় যে, বিশ্বায়নকে পরিহার নয় বরং এর মানবিক দিকগুলির প্রতিষ্ঠার জন্য এ প্রক্রিয়ার সংস্কার সংক্রান্ত বাস্তবায়ন পর্যায়ক্রমে করা আবশ্যক।  [এ.এম.এম শওকত আলী]

গ্রন্থপঞ্জি  অমর্ত্য সেন, ডেভেলপমেন্ট অ্যাজ ফ্রিডম, অক্সফোর্ড, নিউইয়র্ক, অক্সফোর্ড ইউনিভারসিটি প্রেস, ১৯৯৯। জোসেফ ই. স্টিগলিজ, গ্লোবালাইজেশন অ্যান্ড ইটস ডিসকনটেন্ট, নিউইয়র্ক, ডব্লু ডব্লু নর্টন অ্যান্ড কোম্পানি, ২০০৩।