বিপাকজনিত রোগ
বিপাকজনিত রোগ (Metabolic disease) শরীরের অভ্যন্তরীণ প্রাণরাসায়নিক বা বিপাক সংশ্লিষ্ট কার্যাদি সঠিকভাবে সম্পন্ন না হলে এ রোগের সৃষ্টি হয়। মানুষ প্রধানত দুই ধরনের বিপাকজনিত ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়। এর মধ্যে একটি জন্মের পর সংক্রমণশীল জীবাণু বা পরজীবী দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার ফলে অসুস্থতা এবং অপরটি বেঠিক এবং অপ্রতুল খাবার খাওয়ার জন্য অপুষ্টিজনিত রোগ। রোগসৃষ্টিকারী জীবাণু শারীরিক কার্যাবলিতে এমনভাবে বাধা দেয় যে, তার দ্বারা উদ্ভূত উত্তেজনা শরীরে রোগ হিসেবে প্রকাশ পায়। এ ধরনের রোগের কারণ বাহ্যিক। অপরপক্ষে, অপুষ্টির কারণে শারীরিক বিপাক পদ্ধতি ভেঙে পড়ে শরীরের অভ্যন্তরীণ কোষের যাবতীয় ভৌত এবং রাসায়নিক পরিবর্তন সংঘটিত হয় বলেই বিপাকজনিত রোগ সৃষ্টি হয়।
বিপাকজনিত রোগগুলিকে পুনরায় দুটি ভাগে ভাগ করা যায়। একটি ভাগ হচ্ছে সেসব রোগ যা বিপাকক্রিয়ার অসঙ্গতির জন্য দেখা দেয়, উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত না হয়ে রোগাক্রান্ত ব্যক্তি জীবনের কোন একটি পর্যায়ে এই রোগের শিকার হয় এবং তা পরবর্তী বংশধরদের মাঝে সঞ্চারিত হয় না। অপর ভাগটি হচ্ছে জন্মের সময় বিপাকক্রিয়ার অসঙ্গতিজনিত, কিন্তু এই অসঙ্গতি জীনগত ত্রুটির জন্যই হয়ে থাকে এবং সেজন্যই উত্তরাধিকার সূত্রে তা প্রাপ্ত হয় ও পরবর্তী বংশধরদের মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ জীনের সঞ্চালন বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী তা সঞ্চারিত হয়। এ ধরনের বিপাকজনিত রোগ সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে (১৯১০) একজন ব্রিটিশ চিকিৎসক এ.ই. গ্যারড (AE Garrod) এবং এই বংশগত রোগের নামকরণ করেন ‘জন্মগত বিপাক ত্রুটি’।
অনেক বিপাকজনিত রোগ হরমোন অপকৃতির জন্য হয়ে থাকে। তাদের মধ্যে কিছু হচ্ছে বংশগত, যেমন কয়েকপ্রকার ডায়াবেটিস মেলিটাস (Diabetes mellitus)। আবার কিছু বিপাকজনিত রোগ বংশগত নয় যেমন থায়রয়েড বিকলতা। কিছু বংশগত বিপাকজনিত রোগ একটি মাত্র জীনের ত্রুটির কারণে হয়ে থাকে এবং মাতাপিতা থেকে সন্তান-সন্ততিতে তার সঞ্চালন পদ্ধতি জেনেটিক্সের সাধারণ সূত্র মেনে চলে। কিন্তু অন্যান্য ক্ষেত্রে একাধিক ত্রুটিযুক্ত জীন বংশগতির এই সঞ্চরণ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করে। ডায়াবেটিস এবং করোনারি ধমনির রোগ শেষোক্ত প্রকৃতির। এগুলি জটিল ও অনুধাবন করা কষ্টসাধ্য। তবে এ ধরনের রোগের সংখ্যা প্রকারভেদ অনুযায়ী এখনও খুব বেশি নয়। অপরপক্ষে, একক ত্রুটিযুক্ত জীনঘটিত জ্ঞাত বিপাকজনিত রোগের সংখ্যা প্রচুর। সাম্প্রতিককালে একক ত্রুটিযুক্ত জীনঘটিত রোগের সংখ্যা ৫,০০০ ছাড়িয়ে গেছে এবং তার মধ্যে অনেকগুলি খুবই পরিচিত রোগ, যেমন কাঁচি-কোষ রক্তাল্পতা (sickle cell anaemia), হিমোফিলিয়া (haemophilia), কৌশিক তন্তুজ বিকৃতি (systic fibrosis), পেশির অপুষ্টি (muscular dystrophy), â-থেলাসেমিয়া (â-thalassemia) প্রভৃতি।
ডায়াবেটিস এবং কোন কোন ক্ষেত্রে থায়রয়েড বিকলতা ব্যতিরেকে বিপাকজনিত বিকলতার কোন পরিসংখ্যান বাংলাদেশে নেই। আয়োডিন স্বল্পতার লক্ষণ যদি থায়রয়েড গ্রন্থির অপকৃতির একটি ভাল নির্দেশক হয়ে থাকে তাহলে সাম্প্রতিক বছরগুলিতে যেটুকু সীমাবদ্ধ জরিপ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে বলা যায় যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক লোক এই বিপাকজনিত বিকলতায় ভুগছে, অর্থাৎ প্রায় ৬ কোটি মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। [জিয়া উদ্দিন আহমেদ]