বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) এর যাত্রা শুরু হয় ১৯৫৯ সালে। তখন এটি ছিল পূর্ব পাকিস্তান পানি ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের একটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান। সমগ্র বাংলাদেশে বিদ্যুৎ প্রকল্পের নিয়ন্ত্রণকারী ও বিতরণকারী একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৭২ সালে পিডিবি-র উত্থান ঘটে। এর সদর দপ্তর ঢাকায় অবস্থিত এবং প্রধান নির্বাহী হচ্ছেন সরকার নিযুক্ত একজন চেয়ারম্যান। ২০০১ সালে সমগ্র বাংলাদেশে পিডিবির ২৮,৬৩৯ জন কর্মী বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণ কর্মে নিয়োজিত ছিলেন। পিডিবি বিদ্যুৎ বিতরণ কার্যক্রম বর্তমানে ঢাকা ব্যতীত শুধু দেশের অন্যান্য শহরে সীমাবদ্ধ।
পিডিবির আওতাধীন নিবন্ধিত কয়েকটি কোম্পানি দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিমাংশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ ও উৎপাদন করছে। রাজধানীতে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা বিদ্যুৎ বিতরণ কোম্পানি (ডেসকো) এবং পল্লী অঞ্চলে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) বিদ্যুৎ বিতরণের দায়িত্ব পালন করে থাকে। দেশের মোট বিদ্যুৎ ভোক্তাদের ৬০ শতাংশের চাহিদা এ দুটি কোম্পানি ও আরইবি পূরণ করে। পিডিবি বাকি ৪০ ভাগ ভোক্তাদের সেবা প্রদান করে থাকে। দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন রয়েছে ২০৯.৯৩২ কিলোমিটার, এর মধ্যে পিডিবির লাইন ২৯.১৭৬ কিলোমিটার। তবে সকল লাইনে সরবরাহকৃত বিদ্যুতের অধিকাংশই পিডিবি উৎপাদন করে থকে।
গাজীপুর জেলার ভাওয়াল পরগনার রাজা পূর্ববঙ্গের প্রথম বিদ্যুৎ ব্যবহারকারী হিসেবে পরিচিত। ঊনবিংশ শতাব্দীতেই তিনি একটি বৈদ্যুতিক জেনারেটর সংগ্রহ করেছিলেন বলে জানা যায়। ঢাকা নগরীতে ১৯০১ সালের ৭ ডিসেম্বর বৈদ্যুতিক বাতি জ্বালানো হয়। অক্টোভিয়া স্টিল কোম্পানি নামে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ঢাকা নগরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ও বিতরণের দায়িত্ব গ্রহণ করে। ঢাকার নবাব খাজা আহসানুল্লাহ এই কর্মসূচির অর্থায়ন করেন। অক্টোভিয়া কোম্পানির বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ছিল অনেক কম এবং এজন্য তাদের বিদ্যুৎ সরবরাহ শুধু অভিজাত এলাকায় সীমাবদ্ধ ছিল। কেবল প্রধান প্রধান সড়ক ও তৎসংলগ্ন গণ্যমান্য ব্যক্তিদের বাড়িগুলিতে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হয়েছিল। ১৯৩৩ সালে আরেকটি বেসরকারি কোম্পানি ডেভকো ঢাকার পরীবাগে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করে। এই কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ সাধারণ নগরবাসীদের মধ্যে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে সঞ্চালন লাইনের মাধ্যমে বিতরণ করা হয়। ভারত-ভাগের দশ বছর পরে ১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তান সরকার এ দেশের সকল বেসরকারি পাওয়ার হাউজ ও বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন অধিগ্রহণ করে।
২০০৯ সালে বাংলাদেশে মাথাপিছু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল বছরে ২২০ কিলোওয়াট যা বিশ্বের সর্বনিম্ন হারসমূহের অন্যতম। ১৫ কোটিরও বেশি মানুষের বাংলাদেশে মাত্র শতকরা ৪৭ ভাগ লোক বিদ্যুৎ সরবরাহ সুবিধা পেয়ে থাকে। ইতোমধ্যে সরকার বেসরকারি খাতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে একটি নীতি প্রণয়ন করেছে। এই নীতির আওতায় বিদ্যুৎ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বেশ কয়েকটি স্বতন্ত্র বিদ্যুৎ উৎপাদক কোম্পানি ইতোমধ্যে তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ পিডিবির কাছে বিক্রয় করতে শুরু করেছে। এর ফলে দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে ২০১১ সালের জুন মাসে ৪,৬০০ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের নিজস্ব উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৬০০ মেগাওয়াট। অবশিষ্ট ২০০০ মেগাওয়াট বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের মাধ্যমে উৎপাদিত। সাম্প্রতিক বছরগুলিতে পিডিবি অনেকগুলি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপন করেছে এবং বেশ কতগুলি স্থাপনের বিএমআরই সম্পন্ন করেছে। এর ফলে ২০১২ সালের মার্চ মাসে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক ৮০০৫ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়। পিডিবি ২২ মার্চ ২০১২ তারিখে রেকর্ড ৬০৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করে। ২০১০ ও ২০১১ সালে দৈনিক সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১৭৪ মেগাওয়াট ও ৪৬৯৮.৫ মেগাওয়াট।
২০০৯-১০ অর্থ বছরে দেশে সর্বমোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল ২৫,৬২২ মিলিয়ন কিলোওয়াট আওয়ার। সারা দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের ৮৮.৪৪ শতাংশই আসে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে। এছাড়া শতকরা ৪.০২ ভাগ আসে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি থেকে, শতকরা ৩.৮৯ ভাগ ফার্নেস অয়েল চালিত বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে, শতকরা ২.০৪ ভাগ ডিজেল তেলনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলি থেকে এবং ১.৬১ ভাগ আসে পানি বিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি থেকে। ২০১১ সালে পিডিবির গ্রাহকসংখ্যা ছিল ২,১৫৯.৮৭৯। এর মধ্যে গৃহস্থালী গ্রাহক ৪২.৭%, বাণিজ্যিক ৮.১৭%, শিল্প ৪১.০২%, কৃষি (সেচ) ৫.৬১% এবং অন্যান্য ২.৫%। ২০০৯ সালে পিডিবির গ্রাহকসংখ্যা ছিল ১,৯২২,৩৬১। ২০১০-১১ অর্থ বছরে পিডিবির রাজস্ব আয় ছিল ১৫৭.১১৭ মিলিয়ন টাকা। ১৯৯৯ সালে আয় হয় মাত্র ২৩,৮৬২ মিলিয়ন টাকা।
বাংলাদেশের সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন ও পরিবেশ-বান্ধব সম্পদ হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস। বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাঁচামাল হিসেবে গ্যাসের ব্যবহার পিডিবির বিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির সুযোগ বৃদ্ধি করেছে। বেসরকারি বিনিয়োগকারীরাও গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রতি দিনদিন আকৃষ্ট হচ্ছে্। দেশব্যাপী বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও সঞ্চালনের ব্যবস্থাপনা উন্নততর ও দক্ষ করতে পিডিবি বেশ কয়েকটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রগুলিতে সম্পাদিত কাজের মান বৃদ্ধি করতে পিডিবির মালিকানায় কয়েকটি লিমিটেড কোম্পানি গঠিত হয়। এই কোম্পানিগুলি হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রসমূহের সংরক্ষণের জন্য গঠিত বাংলাদেশ পাওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি, সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বাংলাদেশ রিনিউয়েবল এনার্জি কোম্পানি, সাধারণ সেবা ও সহযোগিতা উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশ পাওয়ার সার্ভিসেস কোম্পানি এবং প্রি-স্ট্রেচড কংক্রিটের বৈদ্যুতিক খুঁটি তৈরির জন্য বাংলাদেশ পিসি পোল কোম্পানি। [মাহবুবুল আলম]