বাসনা

বাসনা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা। প্রকাশিত হয় বাংলা ১৩১৫ সনের বৈশাখ মাসে। পত্রিকার প্রচ্ছদপটে লেখা থাকত ‘মাসিক পত্রিকা ও সমালোচনী’। পত্রিকার সম্পাদক  শেখ ফজলল করিম (১৮৮৩-১৯৩৬)। পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো রংপুর জেলার কাকিনা থেকে। কাকিনা বর্তমানে লালমনির হাট জেলার কালিগঞ্জ থানার একটি গ্রাম। পত্রিকাটির প্রকাশক ছিলেন জীবনকৃষ্ণ দাস। পত্রিকার রেজিস্ট্রার্ড নম্বর ছিল ডি-৬২। এর বার্ষিক মূল্য ছিল দুই টাকা।

বাসনা পত্রিকাটি শেখ ফজলল করিমের সামাজিক কল্যাণচিন্তার ফল। সেকালে উত্তরবঙ্গ দুর্গম এলাকা হওয়ার দরুন স্বাভাবিকভাবেই সে অঞ্চল ছিল পশ্চাৎপদ। বাসনা পত্রিকার শুরুতে এ বিষয়ে আক্ষেপ করতে দেখা যায়। পত্রিকাটিতে উত্তরাঞ্চলের অবহেলিত মুসলমান সমাজের শিক্ষার প্রসার, শুদ্ধরীতিতে মাতৃভাষার চর্চা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির অনুশীলন, সমাজে প্রচলিত কুসংস্কার দূরীকরণ প্রভৃতি সম্পর্কে আলোচনা পত্রিকার প্রধান উদ্দেশ্য। এ পত্রিকায় ধর্ম, ইতিহাস, বিজ্ঞান, প্রবন্ধ, পুরাতত্ত্ব, শিক্ষা, গল্প, নাটক, কবিতা, সমালোচনা, অনুবাদ ভ্রমণকাহিনী, জীবনী প্রভৃতিবিষয়ক লেখা প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটি ছিল সম্পূর্ণরূপে অসাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন। এস রেয়াজউদ্দীন আহমদ, অম্বিকাচরণ গুপ্ত, মুনশী মোহাম্মদ জমীর উদ্দিন সরকার, মুনশী আবু আহমেদ, ললিতমোহন সেন, হামেদ আলী, হেমেন্দ্রনাথ সিংহ, মুনশী মোজাফফর আহমদ, মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সুরেশচন্দ্র রায় চৌধুরী, দীনেশচন্দ্র চৌধুরী, কোকিলেশ্বর ভট্টাচার্য, জীবেন্দ্রকুমার দত্ত, তসলিম উদ্দিন আহমদ, আশরাফ উদ্দীন, সৈয়দ নূরুল হোসেন, নওশের আলী ইউসুফ, জ্যোতিশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ এ পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন।

বাঙালি মুসলমান পরিচালিত ও সম্পাদিত পত্রিকাগুলির মধ্যে সম্ভবত বাসনা পত্রিকাই প্রথম বাংলা ভাষার পক্ষে জোরালো মতামত ব্যক্ত করে। বাংলা ভাষার অনুশীলন বিমুখতা ছিল সেসময়ের একশ্রেণীর মুসলমানের একটি বৈশিষ্ট্য। বাসনা পত্রিকা এ বিষয়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাঙালি মুসলিম সমাজের উন্নতির একমাত্র পথ বাংলা ভাষার অনুশীলন ও সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা করা অর্থাৎ মাতৃভাষার চর্চা ছাড়া এ সমাজের উন্নতি অসম্ভব- এ মত ব্যক্ত করে বাসনায় বলা হয়:

একদল সেকেলে গোঁড়া মুসলমান আছে, তাহারা বাংলা শিক্ষার পক্ষপাতি নহেন। তাহারা উর্দুতে আলাপ করেন, পার্শীতে পত্র লেখেন, অথচ বাংলাদেশের ভাত না খাইলে তাহাদের জীবন ধারণ করা চলে না। কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে তাহারাও বোধ হয় বুঝিতে পারিবেন যে, দেশের পনের আনা লোক উর্দুর ধার ধারে না, মায়ের পেট হইতে পড়িয়াই যে-দেশের মুসলমান বাংলা বলিতে শুরু করে, সে-দেশের মুসলমানের বাংলা না শিখিলে পরিণাম কী হইবে?

বাংলা ভাষার পক্ষে এ মত প্রকাশে বাসনা পত্রিকার ঐতিহাসিক ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। উল্লেখযোগ্য হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতিতে এ পত্রিকার দানের কথাও।

সাহিত্য-সমালোচনায় বাসনা পত্রিকার ভূমিকা খুবই প্রশংসনীয়। গ্রন্থ-সমালোচনার জন্য এ পত্রিকা পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। সৃষ্টিশীল সাহিত্যের প্রতি মনোযোগী হলেও পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় ১০/১২টি গ্রন্থের সমালোচনা থাকত। মূল্যবান গ্রন্থ সমাজ পরিবর্তনের এক অসাধারণ মাধ্যম- গ্রন্থ-সমালোচনায় বাসনা এ বক্তব্যের প্রতি জোর দেয়। উল্লেখ্য, এ পত্রিকায়  বেগম রোকেয়ার দুটি গ্রন্থ- মতীচূর ও Sultana’s Dream আলোচনা প্রসঙ্গে সাহিত্য-সৃষ্টিতে ও সমাজ-সংস্কারে তাঁর অসাধারণ অবদানের কথা স্বীকার করে তাঁকে বাংলাদেশের ‘অত্যুজ্জ্বল রত্ন’ বলে অভিনন্দিত করা হয়।

বাসনা জমিদারি ব্যবস্থার সমালোচনা করে জনসাধারণের পক্ষ নেয়। কিছুদিন পরে ‘প্রেস অ্যাক্ট’ আইন তৈরি হয়। এ আইনে প্রায় দু-বছর নিয়মিত চলার পর পত্রিকাটি বন্ধ (বাংলা ১৩১৬ সনের শেষ দিকে) হয়ে যায়। পত্রিকাটি বাংলা সাহিত্যে নতুন কোনো ধারার সৃষ্টি না করতে পারলেও সাময়িক পত্রিকার ইতিহাসে এবং মুসলিম সমাজের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।  [মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম]