বাদুড়

NasirkhanBot (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ২২:২৭, ৪ মে ২০১৪ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ (Added Ennglish article link)

বাদুড় (Bat) ডানাবিশিষ্ট উড়তে সক্ষম একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী। এদের Chiroptera বর্গের Megachiroptera (বড়বাদুড়) ও Microchiroptera (ক্ষুদেবাদুড়) দলে শ্রেণিবিভাগ করা হয়। Megachiroptera-র প্রজাতিগুলি মূলত ফলভোজী, এজন্য নাম ফ্রুটব্যাট (fruit bat), আর স্থানীয়ভাবে বাদুড় বা কলাবাদুড় নামে পরিচিত। Microchiroptera-র প্রজাতিগুলি পতঙ্গভুক, তাই এদের ইনসেক্ট ব্যাট (insect bat), এবং বাংলায় চামচিকা বলা হয়। কোন কোন কলাবাদুড় চামচিকা প্রজাতি থেকেও আকারে ছোট।

বাদুড়দের প্রজাতি সংখ্যা প্রায় ৮০০, এ দিক থেকে এরা রোডেন্টদের পর দ্বিতীয় বৃহত্তম গোষ্ঠী। ফাটল, গাছের খোঁড়ল, দেয়াল, পাথরের ফোঁকর, গুহা-গহবর, পোড়ো-দালান, পুলের তল, সড়কের কালভার্ট, বড় বড় গাছ, পুরানো কুয়া এগুলিই এদের আস্তানা। এসব জায়গায় সাধারণত এদের স্তূপীকৃত মল ঝাঁঝালো গন্ধ ছড়ায়। বিঘ্ন না ঘটলে এরা বহু বছর একই জায়গায় থাকে।

বাদুড়ের গন্ধ ও শব্দের বোধ অত্যন্ত তীব্র। মিশরীয় Rousettus aegyptiacus ছাড়া ওই জাতীয় আর সব বাদুড় খাদ্য ও আশ্রয়ের খোঁজে ঘ্রাণশক্তি ও দৃষ্টিশক্তি ব্যবহার করে, কিন্তু সব প্রজাতির চামচিকা ও মিশরীয় কলাবাদুড় প্রতিধ্বনিভিত্তিক স্থান নির্ণয় পদ্ধতি কাজে লাগায়। অনেক প্রজাতির রূপান্তরিত নাক সংবেদী অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।

প্রাণিজগতে প্রতিধ্বনিভিত্তিক স্থান নির্ণয় একটি অনন্য ঘটনা। বাদুড় ছাড়া সামুদ্রিক স্তন্যপায়ীরাও যোগাযোগের জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করে। চামচিকারা মুখ ও নাকের মাধ্যমে উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সির শব্দ তরঙ্গ উৎপাদন করে। মিশরীয় কলাবাদুড় এজন্য জিহবা কাজে লাগায়।

বাদুড়


এই তরঙ্গমালা শিকার বা প্রতিবন্ধকে আঘাত করলে প্রতিধ্বনি ফেরৎ আসে এবং সেগুলি বাদুড়ের কানে ধরা পড়ে। চামচিকাদের শ্রুতিশক্তি খুবই তীক্ষ্ণ।

বিশ্রামকালে বাদুড়রা পেছনের পায়ের নখ দিয়ে আশ্রয় অাঁকড়ে অধোমুখে ঝুলে থাকে এবং তখন ভাঁজ করা ডানাগুলি শরীরের সঙ্গে সেঁধে থাকে বা শরীর ঢেকে রাখে। ফলগাছে খাবার খোঁজার সময় আঙ্গুলের নখগুলি বাদুড়কে ডালে উঠতে সাহায্য করে। সব বাদুড়ই নিশাচর বা গোধূলিচর, তবে কোন কোন কলাবাদুড় দিনের বেলাও ওড়ে।

এখন জানা গেছে যে বাদুড়রা আস্তানা ছাড়ার আগে প্রতি সেকেন্ডে ১০টি হারে সংকেত-নাদ পাঠায়। উড়ন্ত অবস্থায় ৩০টি পর্যন্ত বাড়ে এবং বিপদ বা শিকার দেখলে তা সতর্কধ্বনি হিসেবে সেকেন্ডে ৫০ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। ডাক পাঠানো ফেরত প্রতিধ্বনি গ্রহণ ও উদ্দীপকের প্রতি বাদুড়ের দৈহিক প্রতিক্রিয়ার মধ্যেকার সময়ের ফারাক সম্ভবত সেকেন্ডের শতাংশ।

বাদুড়ের খাদ্য ফল ও ফলের রস, পতঙ্গ, মাকড়সা, মাছ, ব্যাঙ, ছোট সরীসৃপ ও পাখি, ক্ষুদে বাদুড় ও অন্যান্য ছোট ছোট স্তন্যপায়ী। আমেরিকার রক্তচোষা বাদুড় উষ্ণরক্তবিশিষ্ট প্রাণীর রক্ত পান করে। বাংলাদেশের বাদুড়রা শীতনিদ্রায় বা গ্রীষ্মযাপনে যায় না।

বাদুড়ের গর্ভধারণকাল ৩-৫ মাস এবং শীতের শেষ বা গ্রীষ্মের শুরুতে বাচ্চা প্রসব করে। এক কিস্তিতে একটি বাচ্চা জন্মানোই নিয়ম এবং বছরে একবারই মা বাদুড়ের প্রসব হয়। নবজাতক অন্ধ ও সাধারণত লোমবিহীন হয়ে জন্মায়। তবে কোন কোন ক্ষেত্রে শরীর খাটো ও সূক্ষ্ম রেশমি লোমে ঢাকা থাকে। জন্মের পরই বাচ্চাটি মায়ের দুটি স্তনের একটিতে না পৌঁছানো পর্যন্ত হামাগুড়ি দেয় এবং স্তন্যপান না ছাড়া পর্যন্ত ওটা ধরে থাকে। সবগুলি দুধদাঁতই সমান আকারের এবং ভালভাবে স্তনের চুচুক অাঁকড়ে রাখার জন্যই ব্যবহূত হয়। সাবালক না হওয়া পর্যন্ত বাচ্চারা প্রথম ২-৩ মাস মায়ের শরীরেই সেঁধে থাকে।

বাংলাদেশের ১১৩ প্রজাতির স্তন্যপায়ীর মধ্যে এক-চতুর্থাংশই বাদুড়। এখানকার বাদুড় হলো ফ্লাইং ফক্স (Flying Fox) বা কলাবাদুড়, Pteropus giganteus। উড়ুক্কু স্তন্যপায়ীদের মধ্যে এটিই বৃহত্তম; ডানার মাপ ১.৫ মিটার, ধড় ৪০ সেমি, লেজহীন। এরা বট, আম, ছাতিম, রেইনট্রি, গগণশিরীষ, নারিকেল, তাল, সুপারি, খেজুর গাছে ও বাঁশঝাড়ে এক ডজন থেকে এক হাজার সংখ্যার একটি দলে থাকে; খায় আম, লিচু, পেয়ারা, কলা ও সফেদা। লালচে কলাবাদুড় Rousettes leschenaulti আরেকটি ব্যাপক বিস্তৃত কিন্তু বিরল বাদুড়। ফল্স ভ্যাম্পায়ার/ডাইনি বাদুড় Megaderma lyra এদেশের চামচিকাদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে বড় মাথা ও ধড় ৯ সেমি, লেজহীন, খায় ক্ষুদে মেরুদন্ডী ও কীটপতঙ্গ। গোধূলিতে এদেরই বেশি দেখা যায়।

চামচিকা Indian Pipistrelle, Pipistrellus coromandra শুধু বাংলাদেশের সবচেয়ে ছোট বাদুড়ই নয়, সবচেয়ে ছোট স্তন্যপায়ীও, মাথা ও ধড় ৪.৫ সেমি, লেজ ৩.৫ সেমি, দেশের সর্বত্র দেখা যায় ও ব্যাপক বিস্তৃত স্তন্যপায়ী।

মাঝেমধ্যে ফলফলাদির ক্ষতি করলেও বাদুড় বুনো গাছপালার পরাগায়ণ, বীজ-বিস্তরণ ও কীটপতঙ্গ নিয়ন্ত্রণে যথেষ্ট সহায়তা যোগায়। কলাবাদুড়রা নরম ও মাংসল ফলের অনেকগুলি বৃক্ষ প্রজাতির সুদক্ষ বংশবর্ধক। কিছু আদিবাসী সমাজে কলাবাদুড় ভক্ষণের রেওয়াজ আছে। কোন কোন প্রজাতি জলাতঙ্কের ভাইরাসবাহী হলেও নিজে তাতে আক্রান্ত হয় না। তাই বাদুড় কামড়ালে জলাতঙ্করোধী টিকা নেওয়া আবশ্যক।

[আলী রেজা খান]