বাঙালি জাতি
বাঙালি জাতি সম্পর্কে নৃবিজ্ঞানীদের ধারণা, এটি একটি মিশ্রিত জাতি এবং এ অঞ্চলে বসবাসকারী আদিতম মানবগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে অন্যতম। পৃথিবীর বহু জাতি বাংলায় অনুপ্রবেশ করেছে, অনেকে আবার বেরিয়েও গেছে, তবে পেছনে রেখে গেছে তাদের আগমনের অকাট্য প্রমাণ। বৃহত্তর বাঙালির রক্তে মিশ্রিত আছে বহু এবং বিচিত্র সব নরগোষ্ঠীর অস্তিত্ব। দীর্ঘকাল বিভিন্ন জন ও কোমে বিভক্ত হয়ে এ আদি মানুষেরা বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বসবাস করেছে, এবং একে অপরের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে শতকের পর শতকব্যাপী। জাতিতাত্ত্বিক নৃবিজ্ঞানীদের মতে পৃথিবীর চারটি প্রধান নরগোষ্ঠীর প্রতিটির কোনো না কোনো শাখার আগমন ঘটেছে বাংলায়। নরগোষ্ঠীগুলি হলো নিগ্রীয়, মঙ্গোলীয়, ককেশীয় ও অষ্ট্রেলীয়। মনে করা হয় যে, বাংলার প্রাচীন জনগুলির মধ্যে অষ্ট্রিক ভাষীরাই সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের সাঁওতাল, বাঁশফোড়, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অষ্ট্রেলীয়দের সঙ্গে সম্পৃক্ত। এই আদি জনগোষ্ঠীগুলি দ্বারা নির্মিত সমাজ ও সামাজিক ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে আর্যদের আগমনের পর। বাংলাদেশের জনপ্রবাহে মঙ্গোলীয় রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির রক্তে নতুন করে মিশ্রন ঘটল পারস্য-তুর্কিস্তানের শক জাতির আগমনের ফলে। বাঙালি রক্তে বিদেশি মিশ্রন প্রক্রিয়া ঐতিহাসিককালেও সুস্পষ্ট। ঐতিহাসিকযুগে আমরা দেখি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী নরগোষ্ঠী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখতে। গুপ্ত, সেন, বর্মণ, কম্বেজাখ্য, খড়গ, তুর্কি, আফগান, মুগল, পুর্তুগিজ, ইংরেজ, আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। এমনকি পাকিস্তান যুগেও আমরা দেখি রক্ত মিশ্রণে চলমান প্রক্রিয়া। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এ শংকরত্ব আরো বেগবান হচ্ছে। এক কথায় বাঙালি একটি শংকর জাতি।
তবে আধুনিক শংকরতার পরিবেশ থাকলেও আদি জাতি স্বত্ত্বাই বাঙালির প্রকৃত পরিচয়। বৈদিক স্তবগান-স্ত্ততিতে বাংলা অঞ্চলের কোনো উল্লেখ নেই। বৈদিকদের সর্বপূর্ব জায়গা বিহার। ঐতরীয় ব্রাহ্মণে উল্লেখ আছে যে, পূর্ব আর্যবর্তের আরো পূর্বে থাকে দস্যুরা। দস্যুদের কথা অস্তিত্ব ঘোষণা দিয়ে ঐতরীয়তে উল্লেখ করা হয়েছে যে, পুন্দ্র জাতি এবং তাদের রাজধানী ’পুন্ড্রনগর’-এর কথা। বর্তমান মহাস্থান গড়ই সেই দস্যুদের রাজধানী। ঐতরীয় ব্রাহ্মণে না থাকলেও সমকালীন ঐতরীয় আরণ্যকএ বঙ্গ জাতির উল্লেখ প্রথম পাওয়া যায়। ঐতরীয় রায় দিয়েছে, দস্যুরা পথভ্রষ্ট পাপী কেননা তাঁরা কোনো সত্য গ্রন্থের অনুসারী নয়। রামায়ণ ও মহাভারতে দেখা যায় যে, বঙ্গজরা পাপীতো নয়ই, বরং মিত্রতা প্রতিষ্ঠা করার মতো অতি সম্ভাবনাময় জাতি। রামায়ণে এক তালিকায় রয়েছে কোনো কোনো বঙ্গজ জাতির সঙ্গে আর্যদের মিত্রতা স্থাপিত হয়েছে। মহাভারতে ভীব কর্তৃক পুন্ডবর্ধন ও অন্যান্য কয়েকটি বঙ্গজ জাতিকে বশীভূত করার উল্লেখ আছে। বনপার্বণ গ্রন্থের তীর্থযাত্রা পর্বে পুন্ডনগরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হওয়া গঙ্গার একাংশ করতোয়া নদীকে পবিত্র ঘোষণা করা হয়েছে। এমনিভাবে ধীরে ধীরে বঙ্গজ জাতিগুলি মহাভারতের যুগে এসে আর্যাবর্তের সঙ্গে রাজনৈতিকভাবে মর্যাদার সহিত সম্পৃক্ত হলো।
ঐতিহাসিকযুগে এসে প্রথম বঙ্গজ জাতিসমূহের উল্লেখ পাওয়া যায় দিগ্বিজয়ী আলেকজান্ডারের সঙ্গে ভারত বিজয় অভিযানে আসা গ্রিক ঐতিহাসিকদের লেখায়। তাদের লেখায় উল্লেখ করা হয় যে, পূর্ব ভারতে শক্তিশালী রাজ্যের কথা। গ্রিক এবং অন্যান্য বিদেশি ভ্রমণকাহিনীতে উল্লেখ করা হয়েছে পূর্ব ভারতের বিভিন্ন শক্তিশালী রাষ্ট্রের কথা। যেমন, গৌড়, বঙ্গ, হরিকেল, চন্দ্রদ্বীপ, বাঙ্গালাবাদ, পুন্ড, বারেন্দ্রী, দক্ষিণারাড়, উত্তরা রাধামন্ডল, তাম্রলিপ্তি, পুন্ডবর্ধন-ভুক্তি, সুবর্ণবীথি, বর্ধমানভুক্তি, কঙ্কগ্রাম ভুক্তি, মেঘনা নদীর অববাহিকার কয়েকটি রাজ্য। এসব রাজ্য ও ভুক্তি বৃহৎ বঙ্গের রাজনৈতিক বিকাশধারা, এমনকি বৈদেশিক বাণিজ্যে বাংলার ব্যাপক অংশগ্রহণ নির্দেশ করে। চৈনিক পরিব্রাজকদের দৃষ্টিতে পুন্ড্র রাজ্যের সামুদ্রিক বন্দর তাম্রলিপ্তি ছিল একটি আন্তর্জাতিক সামদ্রিক বন্দর। অর্থাৎ আর্য সভ্যতার পাশাপাশি এবং আর্যদের আগমনের আগেই এই বঙ্গভূমিতে গড়ে উঠেছিল নানা ছোটবড় রাজ্য। মহাভারতের বীরকর্ণ, কৃষ্ণ এবং ভীমসেনা বঙ্গরাজ্যগুলি জয় করে বীরত্ব প্রদর্শন করেছিলেন। অর্থাৎ সমকালীন যুগে রাজ্যগুলির বিকাশ ও খ্যাতি ছিল এমনই যে, এগুলিকে জয় করার জন্য আর্যবর্ত থেকে এসেছিলেন ঐশ্বরিক শক্তিধর বীরেরা।
বাঙালি জাতি পরিচয়ের ঐতিহাসিক যুগ শুরু হয় গুপ্তযুগ (৩২০ খ্রি.- ৬৫০ খ্রি.) থেকে এবং এ যুগেই প্রথম ক্ষুদ্র রাজ্যপুঞ্জগুলিকে নিয়ে গঠিত হয় বিশাল রাজ্য। যেমন গুপ্তদের সাম্রাজ্যিক ছত্রছায়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ক্ষুদ্র রাজ্যের বদলে বৃহৎ রাজ্য যেমন পূর্ব ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গরাজ্য ও উত্তরাঞ্চলের গৌড় রাজ্য। বৃহৎ বঙ্গের প্রথম এবং ঐতিহাসিকভাবে সুনির্দিষ্ট এবং শক্তিশালী শাসক। শশাঙ্ক (খ্রিস্টপূর্ব আনু ৬০০ খ্রি.-৬২৫ খ্রি.) তাঁর দক্ষ শাসনের মাধ্যমে বাংলা ও বাঙালিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন থেকেই বাঙালি জাতিসত্ত্বার যাত্রা শুরু এবং পাল ও সেন আমলে এসে সে সত্ত্বা আরো বিকশিত হয়ে বাঙালি জাতির শক্তিশালী ভিত্তি স্থাপন করে। সে ভিত্তির ওপরই স্থাপিত বাংলায় সুলতানি রাষ্ট্র। এ রাষ্ট্রের নাম দেয়া হয় বাঙ্গালাহ বা বাংলা এবং বাংলা রাষ্ট্রের অধিবাসীরা পরিচিত হয় বাঙালিয়া বা বাঙালি নামে। সুলতানি আমলেই আবার সমগ্র বাঙালি জাতির জন্য তৈরি হয় একটি সাধারণ ভাষা। নাম বাংলা ভাষা। শতকের পর শতক ব্যাপী বিকশিত হয়ে সুলতানি আমলে এসে আমরা পাই বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষা। এ পর্বে বাঙালি জাতি ও সংস্কৃতিতে যুক্ত হয় নতুন নৃগোষ্ঠী তুর্কি-আফগান-মধ্যএশীয় উপাদান। সরকারি পর্যায়ে বাংলা ভাষার পাশাপাশি প্রবর্তিত হয় ফার্সি ভাষা। এ উপাদান আরো সমৃদ্ধি লাভ করে মুগল আমলে (১৫৭৫-১৭১৭)।
মুগল রাষ্ট্র কাঠামোয় বাংলাদেশ একটি সুবাহ বা প্রদেশ হলেও বাংলার সুবাদারেরা এর সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যে যত্নবান ছিলেন। এ সময়ে প্রচলি হয় বাঙালির প্রধান উৎসবাদি। বাংলা সাল, বাংলা মাসের নাম ও পহেলা বৈশাখএ নববর্ষ উৎসব মুগলদের অবদান। বাঙালি সমাজে প্রবর্তিত নানা উৎসব, নানা খাদ্য, নানা বেশভূষা যা বাঙালিত্বকে আরো বর্ণাঢ্য করে তোলে। পান, তামাক, পানীয়, জলসা বা আড্ডা প্রভৃতি মুগল শাসনের বিশেষ অবদান। এ সবের প্রভাব পড়ে বাংলা সাহিত্যে। সুফিবাদ ও বৈষ্ণববাদ ও এতদসংক্রা্ন্ত সাহিত্য ও লোকাচার বাঙালি মননকে করে তোলে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ যা সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা-সহযোগিতাকে শক্তিশালী করে। মুগল রাজনীতি ও দরবার সংস্কৃতি ছিল সব ধর্ম ও মতের প্রতি শ্রদ্ধা ও সহনশিলতা। ঢাকা ও পরবর্তীকালে মুগল দরবারের আমীর-ওমরাদের অর্ধেকই ছিলেন হিন্দু। নবাব সুজাউদ্দিন খান (১৭২৭-১৭৩৯) এর দরবারে হিন্দু আমীররা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ। সমকালীন প্রায় সব বড় ব্যবসায়ী পরিবার যারা নবাবি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিপূর্ণ ছিলেন তারা প্রায় সবাই ছিলেন হিন্দু। রাজনৈতিকভাবে এসব বৈশিষ্ট্য বলে দেয় যে, সমকালীন রাষ্ট্র ব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িক বিবেচনা ছিল না। বিগত কয়েক শত বছর ধরে অনেকটা অজ্ঞাতসারেই যে বাঙালি জাতি নির্মিত হচ্ছিল তাতে ধর্মীয় বিবেচনা কখনো আসেনি। এমনকি ব্রিটিশ আমলের শেষ দশক পর্যন্ত জাতি নির্মাণে ধর্ম দেখা যায় না। ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে বঙ্গবিভাগ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সমর্থন আদায়ের জন্য তাদের এ মর্মে জাগ্রহ করা হচ্ছিল যে, বাংলা ভাগ হলে পূর্ববঙ্গের অপেক্ষাকৃত অনুন্নত মুসলমান সম্প্রদায় অভূতপূর্ব সুযোগ সুবিধা লাভ করবে। সরকারের প্ররোচনায়ই ঢাকায় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হলো সর্ব ভারতীয় মুসলিম লীগ। এরই প্রতিক্রিয়ায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সাম্প্রদায়িক মনোভাব জেগে উঠে। অযৌক্তিকভাবে নতুন প্রদেশ ইস্ট বেঙ্গল ও আসাম প্রদেশের বিরুদ্ধে কলকাতা ভিত্তিক হিন্দু ভদ্রলোক শ্রেণি এর বিরুদ্ধে আন্দোলন করে শেষ পর্যন্ত সরকারকে বঙ্গভঙ্গ রদ করতে বাধ্য করা হয়।
ব্রিটিশপূর্ব যুগে সরকার কখনো জনগণকে ধর্মীয়ভাবে বিভক্ত করে শাসন করার প্রয়াস পায়নি। এ কৌশল ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগের। ১৯০৯, ১৯১৯ ও ১৯৩৫ সালের ইন্ডিয়া অ্যাক্টগুলি সম্প্রদায় ভিত্তিক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ১৯৩৭ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে এবং এরই ভিত্তিতে গঠিত হয় পরবর্তী সময়ের সরকারগুলি। এর ফলে দেশে ধীরে ধীরে রাজনৈতিক সম্পর্কে সাম্প্রদায়িক স্বার্থ প্রাধান্য পায়। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রণোদনায়ই ১৯৪০ সালে ভারতে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দাবি উঠে এবং ঐ দাবির ভিত্তিতেই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু মুসলিম জাতীয়তাবাদতত্ত্ব টেকসই প্রমাণিত হয়নি। উর্দু এবং বাংলা উভয় ভাষাই সুলতানি ও মুগল শাসনামলে বিকশিত হয়- উর্দু উত্তর ভারতে এবং বাংলা বঙ্গদেশে। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তান কেন্দ্রীয় শাসকশ্রেণি হিন্দুর ভাষা হিসেবে গণ্য করে কেবল উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। বাংলা ভাষী পূর্ব পাকিস্তানীরা এর প্রতিবাদ জানায় এবং বাংলাকে সমমর্যাদা দেবার জন্য আন্দোলন করে। এ আন্দোলনে পাকিস্তানীদের নিকট স্পষ্ট করা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানীরা জাতি হিসেবে বাঙালি এবং বাংলা তাদের মাতৃভাষা। এখান থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত। এরই চূড়ান্ত ফল বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে একটি সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে লাভ করল ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশ। [সিরাজুল ইসলাম]