বাওয়ালি

বাওয়ালি সুন্দরবনের কাঠকাটা শ্রমিকশ্রেণি। কাঠ কাটার সময় হিংস্র জন্তুর আক্রমণ ও অন্যান্য দুর্যোগ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তারা বাউলদের সাহায্য নেয় বলে তাদের নাম হয়েছে বাওয়ালি। লোকবিশ্বাস অনুসারে বাউলেরা বাঘ-বাঁধা মন্ত্র জানে। তারা গন্ডি কেটে বাঘ বন্দি করে কিংবা মন্ত্র পড়ে বাঘের মুখ বন্ধ করে দেয়। বৃহত্তর বরিশাল জেলার স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর, মঠবাড়িয়া, পাথরঘাটা এবং খুলনার দক্ষিণাঞ্চলের লোকেরা পুরুষানুক্রমে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তবে স্বরূপকাঠি উপজেলার বর্ষাকাঠি, সোহাগদল, বলদিয়া, সুঠিয়াকাঠি, বলিহারি ও জগন্নাথকাঠির লোকেরাই এ পেশায় অধিক অভিজ্ঞ। বর্ষাকাঠির বাওয়ালিরা সুন্দরবনের প্রাচীন বাওয়ালিদের বংশধর বলে জানা যায়। বাওয়ালিরা বিস্তৃত বনভূমি থেকে  সুন্দরী, গেওয়া, গরান,  কেওড়া প্রভৃতি কাঠ সংগ্রহ করে। ঠিকাদাররা ২০-১০০ একর পর্যন্ত বিস্তৃত ঘের নিলামে কিনে চুক্তির ভিত্তিতে কাঠ কাটার জন্য এদের নিয়োগ করে। সুন্দরবনের বর্ষপঞ্জি এবং প্রশাসনিক কর্মপদ্ধতি অনুসারে বাওয়ালিদের জীবন পরিচালিত হয়।

কাঠ কাটার প্রশাসনিক প্রস্ত্ততি সম্পন্ন হয় বর্ষাকালে। আষাঢ় মাসের মধ্যে ফরেস্টারগণ কর্তনযোগ্য কাঠের পরিমাণ নির্দিষ্ট করেন এবং গোড়ায় নম্বর দিয়ে সেসব গাছ চিহ্নিত করা হয়। এরপর বাওয়ালিরা ছয় জন, আট জন বা দশ-বারো জন মিলে একেকজন সরদারের অধীনে কাঠ কাটা শুরু করে। সমগ্র শীত মওসুম, বিশেষ করে সেপ্টেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সুন্দরবনে এই কাঠ কাটার মৌসুম চলে।

কাঠ কাটার সময় বাওয়ালিরা টোঙে বাস করে। বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মাটি থেকে প্রায় ছয় ফুট ওপরে এই টোঙ তৈরি করা হয়। টোঙের এক তৃতীয়াংশে থাকে রান্নার ব্যবস্থা। তারা যে কাঠ কাটে তা ওখান থেকে চলে যায় খুলনার হার্ডবোর্ড ও নিউজপ্রিন্ট মিলে এবং দাদা ম্যাচ ওয়ার্কস ও বাংলাদেশ ম্যাচ কোম্পানিতে। তাছাড়া পার্শ্ববর্তী গ্রামেগঞ্জের স’মিল ও ট্রলিগুলিতেও এ কাঠ সরবরাহ করা হয়।

সুন্দরবনে বাওয়ালিরা প্রচন্ড বিপদের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করে। তারা বাঘের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য রাতে যেমন টোঙে বাস করে, তেমনি কুমির-কামোটের ভয়ে ডিঙি নৌকায় চড়ে ঘটিতে পানি ঢেলে গোসল করে। তারা ধোয়া-মোছার জন্য নোনা পানি ব্যবহার করে, কিন্তু রান্না ও খাওয়ার জন্য মিঠা পানি সংগ্রহ করে রাখে। কাঠ কাটতে যাবার সময় তারা প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যাদি সঙ্গে করে নিয়ে যায় এবং নদী থেকে মাছ ধরে খায়।

নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত তিন মাস বাওয়ালিরা গোলপাতা কাটে। এগুলি ঘর ছাওয়া এবং পাটি বোনাসহ বিভিন্ন কাজে ব্যবহূত হয়। এ সময় তারা জলদস্যুদের ভয়ে বড় বড় নৌকায় দলবদ্ধভাবে অবস্থান করে। জীবনের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বাওয়ালিরা সুন্দরবনে এক দ্বীপান্তরের জীবন যাপন করে। সারা দিন কাজের পর সন্ধ্যাবেলায় তারা সুর করে গাজীকালু-চম্পাবতী, বনবিবির জহুরনামা, মনসামঙ্গল ও রায়মঙ্গল-এর বাঘ ও সাপের উপাখ্যান পাঠ করে চিত্তবিনোদন করে। গাজী-কালু-চম্পাবতীর পুথিতে গাজীর বাঘবাহিনী কালু রায়ের কুমির বাহিনীর সঙ্গে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে। এই কাহিনীর নায়ক দক্ষিণ রায় ও গাজীকালু বাওয়ালিদের মনে সাহস জোগায়।  [মাহমুদ নাসির জাহাঙ্গীরি]