বাউল গান

বাউল গান বাউল সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক গান। বাউল একটি ধর্মীয় লোক-সম্প্রদায়। তাঁরা দেহতত্ত্বাশ্রিত ও অধ্যাত্মমুখী এক প্রকার লৌকিক ধর্মমত পোষণ করেন; একে বাউল ধর্মমত বলা হয়। এর লিখিত কোনো সাহিত্য বা শাস্ত্র নেই। বাউলরা ধর্মীয় তত্ত্ব ও দর্শন, জীবনবোধ ও আদর্শের কথা গানের ভাষায় প্রকাশ করে সাহিত্যে। মৌখিক ধারার এ গানই বাউল সংগীত হিসেবে পরিচিত। বাউলরা তাঁদের গানকে ধর্মের অঙ্গ বলে মনে করেন। ধর্মীয় আসর, ওরস উৎসব, ভিক্ষোপজীবিকা ইত্যাদি আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক উপলক্ষে গান করে তারা ধর্মকর্ম পালন করে থাকেন। তাঁরা ‘দেহতত্ত্বে’র সাধনা দ্বারা পরমাত্মার সন্ধান করেন। মানুষ, মনের মানুষ, অচিন পাখি, মনুরায় প্রভৃতি প্রতীকের ভাষায় তারা পরমাত্মাকে অভিহিত করে। তিনি মানবদেহে বাস করেন। পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিলন সাধন তাদের দেহসাধনার মূল লক্ষ্য। অধ্যাত্মপ্রেম তথা ভক্তি দ্বারা এ মিলন সাধন সম্ভব। বাউলদের দেহকেন্দ্রিক অধ্যাত্ম সাধনা গুরু-নির্ভর; গুরুর কাছে দীক্ষা নিয়ে যোগাদি সাধনা এবং নানা আচার পালন ও রীতিনীতি করতে হয়। এ দেহ, আত্মা, পরমাত্মা, গুরু, প্রেম-ভক্তি, সৃষ্টিরহস্য ইত্যাদি বিষয়কে কেন্দ্র করে বাউল গান রচিত হয়েছে। এরই সূত্র ধরে আত্মতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব, প্রেমতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব, মানুষতত্ত্ব প্রভৃতি বাউল গানে স্থান পেয়েছে। বাউল গানের আত্মতত্ত্বে মনের প্রস্ত্ততি, দেহতত্ত্বে সাধনার রীতি-পদ্ধতি, গুরুতত্ত্বে গুরুর চরণ শরণ, সৃষ্টিতত্ত্বে জীবসৃষ্টির রহস্য এবং মানুষতত্ত্বে পরমাত্মার মিলনাকাঙক্ষা ব্যক্ত হয়েছে।

বাউল গানের স্রষ্টা লালন শাহ (১৭৭৪-১৮৯০)। তাঁর জন্মস্থান কুষ্টিয়ার ভাড়রা গ্রাম, মতান্তরে যশোরের হরিশপুর গ্রাম। কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় আস্তানা নিয়ে তিনি সাধক জীবন অতিবাহিত করে সেখানেই লোকান্তরিত হন। তিনি অনেক শিষ্য-প্রশিষ্য গ্রহণ করে বাউল সম্প্রদায়কে সংগঠিত করেন। লালন বাউল গান রচনা করে নিজে  গাইতেন, শিষ্যরাও গাইত। পরবর্তীকালে শিষ্য-প্রশিষ্যের নিকট থেকে লালনের গান সংগ্রহ করা হয়েছে। দুদ্দু শাহ, পাঞ্জু শাহ, পাগলা কানাই প্রমুখ তাঁর যোগ্য শিষ্য ছিলেন। তাঁরাও লালনকে অনুসরণ করে বহু বাউল গান রচনা করেছেন। লালনের গানের সংখ্যা আনুমানিক দুই থেকে আড়াই হাজার। শিষ্যরাও শত শত বাউল গান রচনা করেন।

রবীন্দ্রনাথ লালন ও গগন হরকরার গান সংগ্রহ করে প্রকাশ করেন। পাগলা কানাইয়ের শতাধিক গান সংগৃহীত ও সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছে। উপেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বাংলার বাউল ও বাউল গান (১৩৬৪) গ্রন্থে  ৯০ জন বাউল কবির ৬৭৯টি গান সংকলিত করেছেন; এগুলির মধ্যে কিছু অজ্ঞাত কবির গানও আছে। ‘মন রে, তুমি কৃষিকাজ জান না। /এমন মানব জমিন রইল পড়ে,/চাষ করলে ফলত সোনা।’ এটাই বাউলদের বিশ্বাস। যেহেতু পরমাত্মা মানবদেহে বাস করেন, সেহেতু  বাউলরা বিশ্বাস করেন যে, নিজেকে জানলে সেই পরম পুরুষকে জানা যায়। লালনের ভাষায়- ‘আপনারে চিনলে পরে যায় অচেনারে চেনা।’ লালন মানবদেহ ও মানবজীবনকে সবার ঊর্ধে স্থান দিয়েছেন। তাঁর উক্তি: ‘শুনি মানবের উত্তম কিছু নাই/দেব-দেবতাগণ করে আরাধন/জন্ম নিতে মানবে।’ তিনি জাতিভেদের ঘোর বিরোধী ছিলেন। ‘জাত হাতে পেলে পুড়াতাম আগুন দিয়ে।’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাউলদের জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদমুক্ত জীবনবোধ ও ধর্মাদর্শের  প্রশংসা করে একে ‘মানবধর্ম’ বলে উল্লেলখ করেছেন।

বাউল গানের প্রধান বাদ্যযন্ত্র একতারা। কোনো কোনো বাউল কোমরে বাঁয়া বাঁধে। ডান হাতে একতারা এবং বাম হাতে বাঁয়া বাজিয়ে বাউলরা একা অথবা দলবদ্ধভাবে গান-নাচ করে। গান, নাচ, বাদ্য- তিনের সমন্বয়ে বাউল গান স্বতন্ত্র আবেগ ও সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। গানই তাদের ধর্মসাধনার অঙ্গ। বাউল ভাটিয়ালি অঙ্গের গান; এতেও টানা সুর আছে। কীর্তনের টানা ও লঘু সুরের মিশ্র আঙ্গিকেও বাউল গান রচিত হয়েছে। এ ছাড়াও অন্য অনেক গুণে বাউল স্বতন্ত্র সংগীত ধারা সৃষ্টি করেছে। মরমিয়াপন্থী বাউল গানের বেদনাবিধুর সুর সর্বশ্রেণীর মানুষের চিত্ত জয় করতে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশের কুষ্টিয়া বাউল গানের কেন্দ্র-ভূমি, কালক্রমে তা পার্শ্ববর্তী যশোর, ফরিদপুর, পাবনা, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট পর্যন্ত বিস্তার লাভ করেছে। অনুরূপভাবে এ গান পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বর্ধমান ও বীরভূম জেলায় প্রসার লাভ করেছে। বাউল গানকে এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের  একটি বড় উপাদান হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। ফলে বাউল গানের চর্চা কেবল বাউল সাধকদের মধ্যে সীমিত না থেকে এখন তা দেশের সকল শ্রেণির শিক্ষিত শিল্পীর কণ্ঠে গীত হয়ে দেশে এবং দেশের বাইরে বিদেশে প্রশংসিত হচ্ছে। অপরদিকে বাউল গানের মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ও সংগীত-মাধুর্য অধুনা বিশ্ববাসীর মন জয় করেছে। সম্প্রতি জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ইউনেস্কো বাউল গানকে মানবজাতির ঐহিত্যের স্মারক রূপে সংরক্ষণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।  [ওয়াকিল আহমদ]