বাঈজী
বাঈজী হিন্দী শব্দ বাঈ-এর সঙ্গে জী যুক্ত হয়ে বাঈজী কথাটি প্রচলিত হয়েছে। বাঈজী অর্থ পেশাদার নর্তকী ও গায়িকা। তারা নিজগৃহে আসর বসিয়ে অথবা বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে, মহফিল দরবারে আমন্ত্রিত হয়ে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে নৃত্যগীত পরিবেশন করেন। আগেকার দিনে নবাব, নৃপতি, রাজা, মহারাজা, জমিদার, আমলাবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় তাদের ঘরোয়া অনুষ্ঠানে, আসরে, রঙমহলে, বাগানবাড়িতে, প্রমোদবিহারে বাঈজীরা নাচ-গান করতেন।
খ্রিস্টীয় অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে বাংলায়, বিশেষ করে কলকাতায় বাঈজীদের আগমন ঘটতে থাকে। অযোধ্যার বিতাড়িত নবাব ওয়াজেদ আলী শাহ-এর (১৮২২-১৮৯৭) কলকাতার মেটিয়া বুরুজ এলাকায় নির্বাসিত জীবনযাপনকালে সেখানে যে সঙ্গীত সভার পত্তন ঘটে, তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক বাঈজীর আগমন ঘটে। বেশির ভাগ বাঈজীই রাগসঙ্গীত ও শাস্ত্রীয় নৃত্য বিশেষত কত্থকে উচ্চশিক্ষা নিতেন। বাঈজীদের নাচ-গানের আসরকে মুজরো বলা হয়, আবার তাকে মেহফিল বা মাহফেলও বলা হয়ে থাকে। মেহফিলে পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অংশগ্রহণ ছাড়াও কোন কোন বাঈজী রাজা-মহারাজা-নবাবদের দরবার থেকে নিয়মিত মাসিক বেতন পেতেন। বাঈজীদের নাচ-গানে মোহগ্রস্ত হবার কারণে কোন কোন নবাব-রাজা-মহারাজা বা ধনাঢ্য ব্যক্তির পারিবারিক ও আর্থিক জীবনে বিপর্যয়েরও সৃষ্টি হয়েছে। বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত বাঈজীদের জন্য পরিচিত ছিল লখনৌ, এলাহাবাদ, বেনারস, কানপুর, পাটনা, আগ্রা, বরোদা, কলকাতা, দিল্লি প্রভৃতি স্থান। প্রাথমিক যুগের নামকরা বাঈজীদের মধ্যে ছিলেন নিকি, আসরন, জিন্নাত, বেগমজান, হিঙ্গুলা, মীর্জাজান, নান্নীজান, সুপনজান প্রমুখ। এদের মধ্যে নিকি বাঈজী ১৮২৩ সালে রাজা রামমোহন রায় এর বাগানবাড়ীতে নৃত্যগীত পরিবেশন করে দেশি-বিদেশি রসিকজনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে খ্যাতিলাভকারী বাঈজীদের মধ্যে শ্রীজান, মুশতারী, মাশকাজান, গহরজান, জদ্দনবাঈ, জানকী বা ছাপ্পান্ন ছুড়ি, জোরোবাঈ, আবদনবাঈ, নাছমীবাঈ, নীলম, রোশনারা, আসতারী, রসুলুন, কালীবাঈ, হীরাবাঈ, কেশরবাঈ, সরস্বতী, মুন্নী, কানীজান, আমিরজান, গাঙ্গু, বিদ্যাধরী, সিদ্ধেশ্বরী প্রমুখের নাম সবিশেষ উল্লেখযোগ্য।
ঢাকায় বাঈজীদের নাচগান শুরু হয় মুগল আমলে। সুবাহদার ইসলাম খাঁর দরবারে (সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথম পর্ব) যারা নাচ-গান করতেন তাদেরকে ‘কাঞ্চনী’ বলা হতো। উনিশ শতকে ঢাকার নবাব নুসরাত জং, নবাব শামসুদ্দৌলা, নবাব কমরুদ্দৌলা এবং নবাব আবদুল গণি ও নবাব আহসানুল্লাহর সময় বাঈজীদের নাচ-গান তথা মেহফিল প্রবলতা পায়। তারা আহসান মঞ্জিল-এর রংমহল, শাহবাগের ইশরাত মঞ্জিল, দিলকুশার বাগানবাড়িতে নৃত্য-গীত পরিবেশন করতেন। ঢাকার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে যেসব বাঈজী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তাদের মধ্যে লখনৌর প্রখ্যাত গায়ক ও তবলাবাদক মিঠন খানের নাতি সাপান খানের স্ত্রী সুপনজান উনিশ শতকের শেষ দিকে ঢাকায় ছিলেন। ১৮৭০-এর দশকে ঢাকার শাহবাগে নবাব গণির এক অনুষ্ঠানে মুশতারী বাঈ সঙ্গীত পরিবেশন করে প্রখ্যাত সাহিত্যিক আবদুল গফুর নাসখানের নজরে পড়েছিলেন। ১৮৮০-এর দশকে শাহবাগে এলাহীজান নামে আরেক বাঈজীর নৃত্য ও করুণ পরিণতির দৃশ্য দেখেছিলেন হাকিম হাবিবুর রহমান। নবাব গণির দরবারে নাচ-গান করতেন পিয়ারীবাঈ, হীরাবাঈ, ওয়ামুবাঈ, আবেদী বাঈ, আন্নু নান্নু ও নওয়াবীন বাঈ। শেষোক্ত তিন বোন ১৮৮০-এর দশকে ঢাকার নাটক মঞ্চায়নের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। ঢাকার অন্যান্য খ্যাতিমান বাঈজীদের মধ্যে ছিলেন বাতানী, জামুরাদ, পান্না, হিমানী, আমিরজান, রাজলক্ষ্মী, কানী, আবছন প্রমুখ। এছাড়া কলকাতা থেকে মাঝে মধ্যে ঢাকায় মুজরো নিয়ে আসতেন মালকাজান বুলবুলি, মালকাজান আগরওয়ালী, জানকীবাঈ, গহরজান, জদ্দনবাঈ, হরিমতী প্রমুখ। এদের মধ্যে গহরজান (১৮৭৩-১৯২৯) ১৮৯০-এর দশকে ঢাকার কাজী বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছিলেন। তিনি উপমহাদেশে গ্রামোফোন রেকর্ডে কণ্ঠদানকারী প্রথম শিল্পী। তাঁর গানের রেকর্ড নং পি-০১ (হিজ মাস্টার ভয়েস)। জদ্দনবাঈ (মৃত্যু ১৯৪৯) পরবর্তীকালে চলচ্চিত্রে জড়িত হন। প্রখ্যাত ভারতীয় চিত্রাভিনেত্রী নার্গিস (১৯২৯-১৯৮১) তাঁরই কন্যা। বিশ ও তিরিশের দশকে ঢাকার আরেক নামকরা বাঈজী দেবী বাঈ ঢাকার প্রথম নির্বাক চলচ্চিত্র দ্য লাস্ট কিস (১৯৩১)-এ অভিনয় করেন। হরিমতী বাঈজী গ্রমোফোন রেকর্ডে গান, বিশেষ করে নজরুল গীতি গেয়ে তিরিশ ও চল্লিশের দশকে শ্রোতাচিত্ত জয় করেছিলেন।
বাঈজীদের জীবনে যেমন হাসি-আনন্দ আছে, তেমন আছে দুঃখ-বেদনারও ইতিহাস। কোন কোন বাঈজী সামাজিক কল্যাণমূলক কাজের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন। সময়, চাহিদা ও মূল্যবোধের পরিবর্তন, নবাব-রাজা-মহারাজাদের পতন ইত্যাদি কারণে বাঈজীদের অস্তিত্ব লুপ্ত হয়েছে। তাদের নৃত্য-সঙ্গীতে পারদর্শিতা, রূপলাবণ্য ও গুণের কথা কেবল বিধৃত হয়ে আছে বিভিন্ন লেখায়। [অনুপম হায়াৎ]