বাংলা গদ্য

বাংলা গদ্য  প্রাক-বাংলা ভাষার কিছু নমুনা দশ শতক থেকে রচিত বৌদ্ধগান চর্যাপদে পাওয়া গেছে।  এ গানগুলি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার আংশিক কারণ হলো এগুলি শতকের পর শতক গাওয়া হয়েছে এবং অনেক পরে লিখিতরূপে রক্ষিত হয়েছে। তাছাড়া, ধর্মীয় সাহিত্য হিসেবে এগুলি সেই ধর্মের অনুসারীদের পৃষ্ঠপোষণা লাভ করেছে।  অপরপক্ষে, তখনকার গদ্যের কোনো নমুনা বলতে গেলে রক্ষা পায়নি। বাংলা কিছু শব্দ এবং অনুবাক্য এগারো শতক থেকে রচিত তাম্রলিপি এবং তাম্রশাসনে লক্ষ করা যায়। কিন্তু এসব উৎকীর্ণ লিপির সঠিক তারিখ সর্বত্র দেওয়া নেই। ১১৫৯ সালে সর্বানন্দ রচিত অমরকোষের টীকাসর্বস্বে তিন শতাধিক বাংলা শব্দ সংকলিত হয়েছে। এ থেকে বোঝা যায় যে, তখন কেবল বাংলা ভাষা বিকাশ লাভ করতে আরম্ভ করেছিল। উৎকীর্ণ লিপি বা টীকাসর্বস্বে অবশ্য বাংলা বাক্যের কাঠামো অথবা ব্যাকরণ সম্পর্কে কোনো ধারণা পাওয়া যায় না।

বাংলা গদ্যের বিলম্বিত বিকাশের কারণ সেন আমলে (আনু. ১০৯৫ থেকে ১২০৪) লিখিত গদ্য হিসেবে বাংলা কতটা চালু ছিল অথবা আদৌ ছিল কিনা, সন্দেহ আছে। সংস্কৃত ভাষা চর্চায় সেন-রাজারা খুব উৎসাহ দিতেন এবং প্রচুর সাহায্য করতেন, কিন্তু স্থানীয় ভাষা বাংলা চর্চায় তাঁরা আদৌ কোনো সাহায্য দিয়েছেন বলে জানা যায় না। বাংলা তখন একটা আঞ্চলিক মৌখিক ভাষার চেয়ে বেশি কিছু ছিল বলে মনে হয় না।  তদুপরি, তখন শিক্ষার হার খুবই সামান্য ছিল। সে কারণে বাংলায় ব্যক্তিগত চিঠিপত্র অথবা দলিলপত্র লেখার প্রয়োজনীয়তা খুব একটা ছিল না। যদি কেউ আদৌ বাংলা গদ্যে কিছু লিখে থাকেন, তা হলে তা লিখেছিলেন তালপাতায় এবং বঙ্গদেশের প্রতিকূল ও বৃষ্টিবহুল আর্দ্র আবহাওয়ায় সেসব রক্ষা পায়নি।

১২০৪ সালে মুসলিম আমল শুরু হওয়ার পর সংস্কৃতের জায়গায় রাজভাষা হলো ফারসি। ফলে মুসলিম শাসনের প্রথম দুশো বছরে বাংলা ভাষার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়নি। এ সময়ে রচিত বাংলা সাহিত্যের কোনো রকম নমুনা পাওয়া যায়নি; এমনকি, কাব্যেরও নয়। তবে পনেরো শতক থেকে মুসলমান সুলতানরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষণা করতে আরম্ভ করেন, যদিও তা দিয়ে উপকৃত এবং উৎসাহিত হয়েছিলেন কবিরা, গদ্যের বিকাশে তা বিশেষ কোনো সহায়তা করেনি। প্রকৃত পক্ষে, গদ্যচর্চা অথবা গদ্যে সাহিত্য রচনার জন্যে সে সময়টা মোটেই অনুকূল ছিল না।

লেখার সংস্কৃতি গড়ে ওঠার আগেকার কাব্যও রক্ষা পেতে পারে। কারণ ছন্দোবদ্ধ সে সাহিত্য মৌখিক এবং মুখস্থ সাহিত্য হিসেবে এক প্রজন্ম থেকে আর-এক প্রজন্মে প্রচারিত হতে পারে।  কিন্তু গদ্যের বিকাশের জন্যে লেখার সংস্কৃতি এবং ছাপাখানার বিশেষ প্রয়োজন। ইউরোপের তুলনায় এ ব্যাপারে বঙ্গদেশ, এমনকি, ভারতবর্ষই অনেক পেছনে ছিল।  জার্মেনিতে গুটেনবার্গ মুদ্রণ আরম্ভ করেছিলেন ১৪৫০ সালে; কিন্তু বাঙলায় ছাপাখানা এসেছিল তার প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পরে।

বাংলা গদ্যের আদি নিদর্শন বাংলা গদ্যে লেখা সবচেয়ে পুরানো যে-চিঠিটি সময়ের প্রতিকূলতা সত্ত্বেও রক্ষা পেয়েছে সেটি কোচবিহারের রাজা ১৫৫৫ সালে আসামের রাজাকে লিখেছিলেন বলে দাবি করা হয়। কোনো কোনো পন্ডিত এ বিষয়ে সন্দেহ করেন। তবে এ থেকে অন্তত বোঝা যায় যে, মোটামুটি ওই সময় থেকে কেউ কেউ যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে বাংলা গদ্যে চিঠিপত্র লিখতে শুরু করেন। সতেরো শতকে মুগল শাসন শক্ত ভিত্তি এবং সুবদ্ধ কাঠামোর ওপর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই বাংলা ভাষায় না হলেও, ফারসিতে লিখে রাখার রেওয়াজ চালু হয়–রাজকীয় আদেশ, রাজানুগ্রহ, দলিল-দস্তাবেজ, কাজীর আদেশ–সব কিছুই। লিখে রাখার এ রীতি বাঙালিদেরও প্রভাবিত করে। পরে বাংলা গদ্যে চিঠিপত্র এবং দলিল-দস্তাবেজ লেখা ধীরে ধীরে জনপ্রিয়তা অর্জন করে, যদিও তখনকার বাংলা ছিল ফারসি পরিভাষা দিয়ে প্রভাবিত।

উল্লিখিত কোচবিহারের রাজার চিঠির ভাষা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এর বেশির ভাগ শব্দই হয় সংস্কৃত, নয় সংস্কৃত থেকে উৎপন্ন অর্থাৎ তদ্ভব শব্দ; যদিও কয়েকটি আরবি-ফারসি শব্দও তাতে ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এর চেয়ে যা বেশি তাৎপর্যপূর্ণ, তা হলো: বাক্যগঠনে কর্তা-কর্ম-ক্রিয়ার কাঠামো তখনই প্রামাণ্য রীতিতে দাঁড়িয়েছিল। তা ছাড়া, ক্রিয়াবিহীন (অথবা ক্রিয়া উহ্য) বাক্যও প্রচলিত ছিল। সজনীকান্ত দাস তাঁর বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাসে ১৬৩১ সালে লিখিত আর-একটি চিঠির উল্লেখ করেন। এ চিঠি থেকেও ব্যাকরণ, বাক্যগঠন ও পদক্রম সম্পর্কে একই রকমের ধারণা জন্মে।

ব্যক্তিগত চিঠিপত্র এবং দলিল-দস্তাবেজ ছাড়া, পুরানো বাংলা গদ্যের নমুনা আয়ুর্বেদের পান্ডুলিপি এবং বৈষ্ণব ও সহজিয়াদের ধর্মীয় পুস্তিকা থেকে পাওয়া যায়। প্রশ্নোত্তরের আকারে লেখা এ পুস্তিকাগুলিকে বলা হতো কড়চা। এ ধরণের সতেরো শতকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈষ্ণব ধর্মীয় সাহিত্য হলো: নরোত্তমদাসের ‘দেহকড়চ’ (সতেরো শতকের প্রথম দিকের), রূপ গোস্বামীর ‘কারিকা’ (১৬৩১), চন্ডীদাসের ‘চৈত্যরূপ প্রাপ্তি’ (১৬৭৫) এবং কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘রাগময়ীকণা’।

বাংলা গদ্যের বিকাশ সতেরো শতকের গদ্যের খুব কম নমুনা রক্ষা পেলেও, আঠারো শতকের গদ্যের প্রচুর উপকরণ পাওয়া যায়। তদুপরি, এ শতকের গদ্য তুলনামূলকভাবে অনেক প্রামাণ্য রূপ লাভ করেছিল-বাক্যগঠন, বিস্তৃত শব্দাবলি এবং ভাষারীতির স্বাচ্ছন্দ্য ও সাবলীলতার দিক দিয়ে।

আগের শতকের মতো এ শতকেও বৈষ্ণব এবং সহজিয়াদের ধর্মীয় সাহিত্য রচিত হয়েছিল। আনুমানিক ১৭২০ সালে লেখা ‘স্বরোদয়’ অনেকটা ‘চৈত্যরূপ প্রাপ্তি’র মতো শোনালেও, ‘বৃন্দাবনলীলা’, ‘বৃন্দাবনপরিক্রমা’, ‘জ্ঞানাদি সাধনা’ ও ‘সাধনকথা’র গদ্য অনেক সরল এবং ভাবপ্রকাশের উপযোগী। এ শতকের মাঝামঝি সময়ে রচিত দর্শনমূলক গ্রন্থ ‘ভাষাপরিচ্ছেদ’ তার ভাষারীতির উৎকর্ষের জন্যে অন্যান্য রচনাকে ছাড়িয়ে স্বতন্ত্রভাবে চোখে পড়ে। বস্ত্তত, সতেরো শতকের মাঝামাঝি থেকে আরম্ভ করে আঠারো শতকের মাঝামাঝি পর্যন্ত বাংলা গদ্যের কতটা উন্নতি হয়েছিল, তা পরিষ্কার বোঝা যায় ‘দেহকড়চে’র একটি দৃষ্টান্তের সঙ্গে ‘ভাষাপরিচ্ছেদে’র একটি দৃষ্টান্তের তুলনা করলে:

‘তুমি কি। আমি জীব। তুমি কোন জীব। আমি তটস্থ জীব।  থাকেন কোথা। ভান্ডে। ভান্ড কিরূপে হৈল। তত্ত্ববস্ত্ত হইতে। তত্ত্ববস্ত্ত কি। পঞ্চ আত্মা। একাদশেন্দ্র। ছয় রিপু ইচ্ছা এই সকল য়েক যোগে ভান্ড হৈল।’

এ ভাষা অতি সরল বাক্যের নমুনা। কিন্তু ভাবপ্রকাশের বাহন হলেও, এর মধ্য দিয়ে কোনো সৌন্দর্য অথবা সাহিত্যিক গুণ প্রকাশ পায়নি। অপরপক্ষে, নিচে ‘ভাষাপরিচ্ছেদে’র ভাষায় জটিল বাক্যের ব্যবহার এবং তা থেকে এক ধরনের সরল সৌন্দর্য অনায়াসে লক্ষ করা যায়:

‘গৌতম মুনিকে শিষ্য সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন আমাদিগের মুক্তি কি প্রকারে হয় তাহা কৃপা করিয়া বলহ। তাহাতে গৌতম উত্তর করিতেছেন তাবৎ পদার্থ জানিলেই মুক্তি হয়। তাহাতে শিষ্যেরা সকলে জিজ্ঞাসা করিলেন পদার্থ কতো। তাহাতে গৌতম কহিতেছেন। পদার্থ সপ্ত প্রকার।’

এ অনুচ্ছেদে সাধারণ বর্তমান, ঘটমান বর্তমান, সাধারণ অতীত, ঘটমান অতীত এবং বর্তমান অনুজ্ঞাসহ কয়েকটি ক্রিয়ারূপ দেখা যায়। এতে একটি অসমাপিকা ক্রিয়ারও দৃষ্টান্ত আছে। ক্রিয়াবিহীন বাক্যও আছে। প্রায় সব বাক্যে একাধিক অনুবাক্য আছে এবং ব্যাকরণের পরিভাষায় বাক্যগুলি সবই ‘জটিল’। কিন্তু প্রতিটি বাক্যের কাঠামোর প্রকৃতি এক—প্রথমে কর্তা, ক্রিয়াপদ বাক্যের শেষে। মুসলমানদের সঙ্গে বিরূপ সম্পর্ক থাকায় এ ধর্মীয় পুস্তকে আরবি-ফারসি শব্দ সযত্নে এড়িয়ে চলা হয়েছে। কিন্তু এর সবচেয়ে সুন্দর দিক হলো এর সাবলীলতা এবং স্বচ্ছন্দ প্রবাহ।

সুকুমার সেন তাঁর বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্যে ১৭৫২ সালে রচিত একটি পুস্তক থেকে এমন একটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন, যা থেকে বোঝা যায় তখনই বাংলা গদ্য সব রকমের ভাব প্রকাশের বাহনে পরিণত হয়েছিল। এ পুস্তক যে-গদ্যরীতিতে লেখা হয়েছিল, তা পরবর্তীকালে সাধু ভাষা নামে পরিচিত হয়। দীনেশচন্দ্র সেন দৃষ্টান্ত দিয়েছেন ১৭৭৪ সালে রচিত একটি পুস্তক থেকে। সে ভাষা ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের যুগের ভাষা, এমনকি, তার এক দশক পরে লেখা রামমোহন রায়ের ভাষা থেকে কম উন্নত নয়। ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে রক্ষিত ন্যাথানিয়েল হ্যালহেডের যে-সংগ্রহ আছে (১৭৭২-৮৫), তাতে ‘বিক্রমাদিত্য উপাখ্যান’ নামে একটি ছোট কাহিনী আছে—অনেকটা বেতালপঞ্চবিংশতির মতো। এ রচনাটি সরল, সহজ এবং সাবলীল গদ্যের চমৎকার একটি নমুনা। সাধুরীতিতে লেখা হলেও, এর মধ্যে কয়েকটি ক্রিয়াপদ আছে, যা থেকে তখনকার চলিত রীতির আভাস পাওয়া যায়। ব্রাহ্মণ রোমান ক্যাথলিক সম্বাদ এবং কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ নামে প্রথম মুদ্রিত বাংলা বই দুটি ১৭৪৩ সালে ছাপা হয়েছিল রোম্যান হরফে এবং প্রকাশিত হয়েছিল লিসবন থেকে। পরে ১৭৮৪ থেকে ১৮০০ সালের মধ্যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইনের উনিশটি বাংলা অনুবাদ গ্রন্থ বাংলা হরফেই প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। এ ছাড়া, এ সময়ে ক্যালকাটা গেজেট পত্রিকায় প্রায় দু হাজার বাংলা বিজ্ঞপ্তি-বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। বাংলা গদ্যের এসব মুদ্রিত নমুনা ছাড়াও, হাতের লেখা চিঠিপত্র এবং দলিল-দস্তাবেজ পাওয়া গেছে বিস্তর। এসবের মধ্যে আছে কলকাতা মেয়ার্স কোর্টের কাগজপত্র (১৭৫৬-৭৪), হ্যালহেডের ব্যক্তিগত সংগ্রহ (১৭৭২-৮৫), জর্জ বোগল (১৭৭৪-৮১), জঁ ভের্লি (১৭৭৬-১৮৩০) এবং অগাস্তিন অসাঁতের (১৭৭৯-৮৫) ব্যক্তিগত সংগ্রহে। ঢাকা অঞ্চলের তাঁতিদের লেখা কম্পোনির চিঠিপত্রও (১৭৯০, ১৭৯২ ও কিছু পরবর্তী সময়ের) পাওয়া গেছে প্রায় দু হাজার। এগুলি থেকে বাংলা গদ্যের যে-নিদর্শন পাওয়া যায় তা থেকে বোঝা যায় যে, ক্রমবর্ধমান উন্নতির মাধ্যমে বাংলা গদ্য তখন এমন একটা পর্যায়ে পৌঁছে যাচ্ছিল, যাকে দীনেশচন্দ্র সেন এবং সুকুমার সেন পূর্ণবিকশিত বাংলা গদ্য বলে আখ্যায়িত করেন। সুতরাং বাংলা গদ্য চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে তার দীর্ঘ যাত্রা আরম্ভ করেছিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজ স্থাপিত হওয়ার পর—এ কিংবদন্তির আদৌ কোনো ভিত্তি নেই। ধীরগতিতে যাত্রা আরম্ভ করার পর বাংলা গদ্যের দ্রুত বিকাশের পেছনে যেসব প্রধান কারণ ছিল, সেগুলি- ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আইন-আদালত স্থাপন; কোম্পানির সব আইন ও বিজ্ঞপ্তি-বিজ্ঞাপন বাংলায় প্রকাশের সিদ্ধান্তত (১৭৭৩), আনুষ্ঠানিক প্রশাসনিক ব্যবস্থা ও লেখ্য সংস্কৃতির সূচনা; কোম্পানির কর্মচারীদের বাংলা শেখার উদ্যোগ; এবং ১৭৭০-এর দশকে বাংলা হরফ নির্মাণ ও ছাপাখানার প্রচলন।

উনিশ শতকের বাংলা গদ্য বাংলা গদ্যে লেখা এবং বাংলা হরফে ছাপা প্রথম মৌলিক গ্রন্থ রামরাম বসুর রাজা প্রতাপাদিত্য চরিত্র ১৮০১ সালে প্রকাশিত হয়। মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারসহ ফোর্ট উইলিয়ম কলেজে তাঁর সহকর্মীরা তাঁর তুলনায় বেশি সংস্কৃত-প্রভাবিত ভাষায় তাঁদের গ্রন্থগুলি রচনা করেছিলেন। এসব গ্রন্থ ছিল ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের ছাত্রদের জন্যে লেখা পাঠ্যপুস্তক। এঁদের কয়েক বছর পরে রামমোহন রায় যখন পাঠ্যপুস্তকের বাইরে অন্যান্য গ্রন্থ লিখতে আরম্ভ করেন, তখন তাঁকে এমন একটা রীতিতে লিখতে হয়, যা দিয়ে ধর্মীয় বিতর্ক চালানো যায় এবং উপনিষদের অনুবাদ করা যায়। কিন্তু ফোর্ট উইলিয়ম কলেজের পাঠ্যপুস্তক এবং রামমোহন রায়ের রীতি—উভয়ই ছিল সংস্কৃত শব্দপ্রধান এবং আড়ষ্ট। বস্ত্তত, মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কারের লেখা গদ্যের কোনো কোনো অংশ ছাড়া, সবই ছিল প্রাঞ্জলতা এবং সাবলীলতাবর্জিত। এ গদ্য পড়তে গেলে পদে পদে হোঁচট খেতে হয়। এর একটা প্রধান কারণ, এ গদ্যে সুষ্ঠু যতিচিহ্নের ব্যবহার ছিল না। আঠারো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে বাংলা গদ্যে এক বা দুই দাঁড়ির মধ্যবর্তী কসি (  ,   ) বা বিন্দু (fullstop) ( . ,  . ) বা বৃত্ত (sphere) চিহ্ন  (  ,   ) এবং দাঁড়ি ও যুগল দাঁড়ি লক্ষ করা যায়।

শ্রীরামপুর মিশন থেকে ১৮১৮ সালের মে মাসে প্রকাশিত প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা সমাচার-দর্পণ এবং পরে রামমোহন রায়ের সম্বাদকৌমুদী (১৮২১) ও ভবানীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাচারচন্দ্রিকা (১৮২২) বাংলা গদ্যকে ভাবপ্রকাশের উপযোগিতা দিয়েছিল এবং খানিকটা সরল ও কেজো গদ্যে পরিণত করেছিল। আরো দুটি সাময়িকপত্রিকা—সম্বাদপ্রভাকর (১৮৩১) এবং তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা (১৮৪৩)—বাংলা গদ্যের বিকাশে সাহায্য করেছিল। বিশেষত, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় লিখে অক্ষয়কুমার দত্ত এবং দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সেকালের দুই শ্রেষ্ঠ গদ্যলেখক বলে পরিচিত হন। এক্ষেত্রে অক্ষয়কুমার দত্তের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁর দুটি গ্রন্থ—ভূগোল (১৮৪১) ও  শ্রীযুক্ত ডেভিড হেয়ার সাহেবের নাম স্মরণার্থে তৃতীয় সাম্বৎসরিক সভার বক্তৃতা (১৮৪৫) বাংলা গদ্যের আদর্শ রূপকে (Standerd Prose) চিহ্নিত করে।

অক্ষয়কুমার দত্তের ভূগোল ছিল ছাত্রপাঠ্য। এর ভাষা ছিল স্বচ্ছ ও সরল। তিন থেকে দশটি শব্দে বাক্য তৈরির দৃষ্টান্ত এতে লক্ষণীয়। তদুপরি এ গ্রন্থে ইংরেজির অনুসরণে প্রথম সুষ্ঠু যতিচিহ্ন ব্যবহূত হয়। ফলে ভাষা গতি লাভ করে এবং আপনাতে তৈরি হয় ছন্দ-সামঞ্জস্য। ভূগোল-এর ভাষায় লক্ষ করা যায়, বাক্যের শ্বাসপর্বগুলি অর্থপর্বের (symantic group) সঙ্গে একীভূত—যাতে যতিচিহ্ন বাক্যের অর্থকে স্পষ্ট করে। এটা অনুসৃত হয় তাঁর সম্পাদিত বিদ্যাদর্শন (১৮৪২) ও তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত রচনাগুলিতে এবং ডেভিড হেয়ার সম্পর্কে বক্তৃতায়। বাংলা গদ্যের নির্মাতা হিসেবে অক্ষয়কুমার দত্তের কৃতিত্ব হচ্ছে তিনিই প্রথম সুনিয়মিতভাবে দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন, আশ্চর্যবোধক চিহ্ন ও ড্যাস-এর ব্যবহার অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেন এবং সেটা ১৯৪৭ সালের আগেই। এটা সম্ভব হয়েছিল এ কারণে যে, তিনি লেখালেখির শুরু থেকেই বিজ্ঞানচর্চা করেন। বিজ্ঞানচর্চায় কোনো ভাবকে অস্পষ্ট রাখা চলে না। যুক্তি-শৃঙ্খলা বিজ্ঞানচর্চার প্রথম ও প্রধান শর্ত। বিষয় অনুযায়ী ভাববিন্যাস এবং যথাযথ ও নির্মেদ শব্দের ব্যবহার সেখানে অপরিহার্য। ডেভিড ডেয়ার সম্পর্কিত বক্তৃতায় দেখা যায়, অক্ষয়কুমার যতিচিহ্নের ব্যবহার syntax অনুযায়ী এমনভাবে করেছেন, যাতে মূল ক্রিয়ায় বা কর্তার সঙ্গে দূরান্বিত পদের সম্পর্ক সহজে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এ বক্তৃতায় তিনি যতিচিহ্নের ব্যবহার দীর্ঘ বাক্যের syntax-এর সঙ্গে সমতাল রক্ষা করতে পেরেছেন দক্ষতার সঙ্গে। যতিচিহ্নের সুষ্ঠ ব্যবহারের ফলে বাক্যের গাঁথুনি মজবুত হয় এবং ভাষায় আসে ছন্দবোধ। অক্ষয়কুমার দত্ত বাংলা গদ্যের শক্তিকে সেই পর্যায়ে উন্নীত করেন, যাতে বহির্বিশ্বের জ্ঞান ও ভাবের চর্চা অনায়াসে করা চলে। শুরু থেকে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় তিনি ধারাবাহিকভাবে সেরকম ছোট ছোট প্রবন্ধ লেখেন, যেগুলি পত্রিকাটিকে জনপ্রিয় করে তোলে। এ প্রবন্ধগুলির মধ্য দিয়ে তিনি কথাসাহিত্যের সৃষ্টির পথকেও সম্ভাবিত করে তোলেন। তবে এক্ষেত্রে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দান অসাধারণ।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৪৭ সালে বেতালপঞ্চবিংশতি প্রকাশ করলে বাংলা গদ্যের আরো একটি পর্বের সূচনা হয়। এর মধ্য দিয়ে প্রথমবারের মতো দেখা যায় বাংলা গদ্যের সত্যিকারের সৌন্দর্য এবং অন্যান্য সম্ভাবনা। বলা যেতে পারে এর মধ্য দিয়ে সাহিত্যিক গদ্যের সূত্রপাত। বিদ্যাসাগর বাক্যের মধ্যে শব্দ-সামঞ্জস্য, শব্দের অন্বয় এবং সঠিক পদক্রম খুঁজে পান। বিষয়বস্ত্তর উপযোগী শব্দাবলি, অনুপ্রাস এবং সাঙ্গীতিক শব্দ ব্যবহার করে তিনি ভাষায় এক অভূতপূর্ব সৌন্দর্য আরোপ করেন। সবচেয়ে কৃতিত্বের কথা তিনি শ্বাসযতির সঙ্গে অর্থযতির সমন্বয় ঘটান। এর ফলে তাঁর গদ্য এমন একটা স্বাচ্ছন্দ্য লাভ করেছে যে, তা পড়তে গিয়ে হোঁচট খেতে হয় না। বেতালপঞ্চবিংশতির দশম সংস্করণে (১৮৫৬) বিদ্যাসাগর ইংরেজি যতিচিহ্ন ব্যবহার করেন। তার আগে একমাত্র দাঁড়ি ছাড়া বেতালপঞ্চবিংশতিতে ইংরেজি যতিচিহ্ন ব্যবহার করেননি। বস্ত্তত, তাঁর আগে বাংলা গদ্য বহুবিধ ভাব প্রকাশের উপযোগী হলেও, তাঁর হাতে সে গদ্য সাহিত্যিক গুণে গুণান্বিত হয়ে ওঠে। শকুন্তলা (১৮৫৪), সীতার বনবাস (১৮৬২) এবং ভ্রান্তিবিলাসের (১৮৬৯) মাধ্যমে তিনি গদ্য লেখার প্রথম দিকে যেসব ছোটোখাটো সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিলেন, তারও যথার্থ সমাধান করেন।

অবশ্য তাঁর গদ্যরীতিতে যে-অপূর্ণতা ছিল, তা হলো এ গদ্য সাধারণ লোকের অথবা প্রতিদিনের কাজকর্মের উপযোগী নয়। তিনি যে গদ্য তৈরি করেছিলেন, তা ছিল মূলত লিখিত ভাষা। ধরা যাক, এ ভাষা উপন্যাসের সংলাপের উপযোগী ছিল না। প্যারীচাঁদ মিত্র ১৮৫৪ সালে মাসিক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রথম বাংলা উপন্যাস আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৮) প্রকাশ করতে গিয়ে লক্ষ করেন যে, বিদ্যাসাগরের ভাষায় আলালের কোনো কোনো চরিত্রের সংলাপ লেখা যায় না, যেমন নাপিত এবং নাপিতানীর চরিত্র, অথবা দুটি মুসলিম চরিত্র—ঠকচাচা এবং ঠকচাচী। এমনকি, এ ভাষা দিয়ে ব্যাঙের ডাকে মুখরিত একটা বর্ষা দিনের বর্ণনা দেওয়াও শক্ত। প্যারীচাঁদ সেজন্যে একটি ভিন্ন ধরনের গদ্যরীতি নিয়ে পরীক্ষা করেন। এতে ছিল চলিত ভাষার ক্রিয়া-বিভক্তি, চলিত ভাষার কিছু অশালীন শব্দ এবং ধ্বন্যাত্মক শব্দ। ফলে তিনি বাংলা গদ্যে একটা অব্যবহূত দিগন্ত এবং সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেন। কয়েক বছর পরে হুতোম প্যাঁচার নকশার (১৮৬১-৬২) লেখক সাফল্যের সঙ্গে এ রীতির পূর্ণ এবং সদ্ব্যবহার করেন। হুতোমের গদ্যরীতি এমন অসাধারণ ছিল যে, অন্য কারও পক্ষে তার সুন্দর অনুকরণ অসম্ভব ছিল। আলালের ভাষা ছিল মূলত সাধু ভাষার ওপর প্রতিষ্ঠিত, কেবল কিছু বর্ণনা এবং কোনো কোনো সংলাপ চলিত রীতির; অপরপক্ষে, হুতোম লেখা হয়েছিল পুরোপুরি চলিত রীতিতে। পরিস্থিতি অনুযায়ী জুতসই শব্দ, ধরতাই বুলি, চটকদার ধ্বন্যাত্মক শব্দ এবং কলকাতার জীবনযাত্রার বিচিত্র এবং জীবন্ত বর্ণনা দিয়ে তিনি একে নির্মাণ করেছিলেন। তার ওপর এতে ছিল কথার মারপ্যাঁচ, হাস্যকৌতুক এবং তীব্র রঙ্গব্যঙ্গ। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এর সঙ্গে তুলনীয় কোনো গ্রন্থ নেই।

প্রকৃতপক্ষে, আলাল এবং হুতোমের ভাষা সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে এতোই অসাধারণ ছিল যে, পরবর্তী লেখকরা কেউ প্যারীচাঁদ অথবা হুতোম প্যাঁচার লেখকের (অনেকের মতে কালীপ্রসন্ন সিংহ) ভাষা অনুকরণ করেননি। কিন্তু বিদ্যাসাগরের ভাষা অন্য ধরনের রচনার উপযোগী হলেও, উপন্যাসের উপযোগী না-হওয়ায় বাংলা গদ্য তখনও অপূর্ণ ছিল। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সে অভাব পূরণ করেন তাঁর প্রথম উপন্যাস দুর্গেশনন্দিনীর (১৮৬৫) মাধ্যমে। এ ভাষা মূলত বিদ্যাসাগরী ভাষার ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও, বঙ্কিমচন্দ্র একে এমন পরিশীলিত রূপ দেন যে, তা বিশ শতকের গোড়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অন্য একটি রীতি প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত সকলের কাছে প্রামাণ্য আদর্শ বলে বিবেচিত হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের গদ্যরীতি এমন সৌন্দর্য এবং বৈচিত্র্যমন্ডিত ছিল যে, তা দিয়ে অত্যন্ত গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে আরম্ভ করে অতি হাস্যকর বিষয়, অতি রোম্যান্টিক প্রেমের অন্তরঙ্গ বর্ণনা থেকে নিবিড় বিরহ ও বেদনার মর্মন্তুদ বর্ণনা, অস্ত্রের ঝনঝনানি থেকে প্রশান্তির বর্ণনা দেওয়া সম্ভব ছিল। তদুপরি, তিনি বাকচাতুর্য ও হাস্যকৌতুকের আলোকে প্রতিটি দৃশ্য অথবা বর্ণনাকে সরস করে তুলেছিলেন।

অবশ্য তাঁর পূর্বসূরিদের সঙ্গে তাঁর গদ্য এক জায়গাতে অভিন্ন, সে হলো : উভয়ই সাধু রীতির গদ্য; তা ছিল মুখের ভাষা থেকে আলাদা এবং খানিকটা কৃত্রিম। তিনি কথ্য ভাষার সম্ভাবনা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করে দেখেননি। যদিও তাঁর প্রতিষ্ঠা এবং খ্যাতি যখন তুঙ্গে তখনই আঠারো বছর বয়স্ক তরুণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কথ্য বাংলায় লিখতে আরম্ভ করেন। চলিত রীতি হলে সে গদ্য দিয়ে ভদ্রজনের অথবা শিষ্ট সাহিত্য রচিত হতে পারবে না বলে আলালী অথবা হুতোমী গদ্য থেকে যে-ধারণা গঠিত হয়েছিল, ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর ইংল্যান্ড থেকে লেখা চিঠিগুলি (১৮৭৮-৭৯) থেকে সে ধারণা পুরোপুরি পাল্টে যায়। তবে আলালী এবং হুতোমী গদ্যের মতো রবীন্দ্রনাথের চিঠিগুলির ভাষাও সময়ের তুলনায় এতো প্রাগসর ছিল যে, তা সাধারণ পাঠক অথবা অন্য সাহিত্যিকরা গ্রহণ করতে পারেননি। ফলে তিনি আবার বঙ্কিমচন্দ্রেরই রীতিতেই ফিরে যেতে বাধ্য হন। কিন্তু ১৮৯১ সাল থেকে লেখা তাঁর ছোটোগল্পে তিনি সাধু রীতির ক্রিয়া-বিভক্তি বজায় রাখলেও, সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার অনেকাংশে কমিয়ে দেন এবং এ কারণে তাঁর এ সময়কার ভাষাকে তেমন গুরুগম্ভীর মনে হয় না। তা ছাড়া, তিনি চলিত রীতির সর্বনাম ব্যবহার করেন এবং কোনো কোনো জায়গায় সংলাপ লেখেন চলিত ভাষায়।

বিশ শতকের গদ্য এ শতকের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ বাংলা গদ্যে আরও সরলতা আনেন এবং তাকে এমন একটা রূপ দান করেন যা সাধু গদ্যের ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও চলিত ভাষার কাছাকাছি। ভাষাকে আগেকার গদ্যের মতো পন্ডিতি অথবা আড়ষ্ট মনে হয় না। বিশেষ করে সাধু রীতিতে বর্ণনা এবং চলিত রীতিতে সংলাপ রচনা করার যে-রীতি তিনি প্রবর্তন করেন এবং সেসঙ্গে যে সূক্ষ্ম বাকচাতুর্য এবং হাস্যকৌতুক মিশিয়ে দেন, তাতে তাঁর কাহিনীমূলক রচনা এবং প্রবন্ধ—উভয়ই তুলনামূলকভাবে লঘুভার এবং সুখপাঠ্য হয়ে ওঠে। অবশ্য চলিত গদ্যের নানা উপকরণ ক্রমবর্ধমান মাত্রায় ব্যবহার করলেও, ১৯১৭-১৮ সাল পর্যন্ত তাঁর বেশির ভাগ লেখাই ক্রিয়াবিভক্তির দিক দিয়ে সাধুরীতির।

রবীন্দ্রনাথ ১৯১৩ সালে যখন সাহিত্যের জন্যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেন, তখন বাঙলায় তাঁর প্রভাব অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। এ সময়ে  প্রমথ চৌধুরী সবুজপত্র (১৯১৪) প্রকাশ করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সব ধরনের সাহিত্যে চলিত রীতি চালু করা এবং সে রীতিকে জনপ্রিয় করে তোলা। তাঁর ধারালো ভাষায় তিনি বলেন যে, মুখের ভাষাকে কলমের কালি দিয়ে লেখা যায়, কিন্তু উল্টোটা করা যায় না, কারণ কলমের কালি মুখে দিলে মুখ কলঙ্কিত হয়। যে-সময়ে সবাই সাধু ভাষায় লিখতেন। কাজেই তখন পাঠক এবং লেখকেরা এটা মেনে নিতে রাজি হবেন কিনা সন্দেহ থাকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এ ব্যাপারে প্রমথ চৌধুরীকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। ফলে  এ সময় থেকে বাংলা সাধু রীতি পরিত্যক্ত হয়ে চলিত রীতি চালু করার আন্দোলন শুরু হয়। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মতো প্রভাবশালী লেখক প্রমথ চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হয়ে চলিত ভাষায় লিখতে শুরু করলে অন্য লেখকেরাও তাঁকে অনুসরণ করতে আরম্ভ করেন। ধীরে ধীরে অন্য লেখকেরা এবং পাঠকেরাও এ রীতি গ্রহণ করেন। তবে এ ভাষাকে পুরোপুরি কথ্যভাষা বলা যায় না; একে বলতে হয় কথ্যভাষার শালীন এবং সাহিত্যিক রূপ। এ ভাষা কোনো বিশেষ অঞ্চলের কথ্য ভাষা নয়, এমন কি, কলকাতারও নয়; এ ভাষা হলো কলকাতা, পড়শি জেলা নদিয়ার শান্তিপুর এবং রবীন্দ্রনাথদের পরিবার—জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অভিজাত কথ্যভাষার সমন্বিত রূপ। এক অর্থে এ ভাষাও ছিল কৃত্রিম—বিশেষ করে চলিত রীতির যে-গদ্য প্রবন্ধের জন্যে ব্যবহূত হয়।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এ ভাষা যতটা ভিন্ন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, আসলে  ততোটা ভিন্ন নয়। সাধু ভাষার সঙ্গে এর পার্থক্য প্রধানত দু রকমের। প্রথমত, ব্যাকরণের দিক দিয়ে এর ক্রিয়া-বিভক্তি এবং সর্বনাম আলাদা; দ্বিতীয়ত, শব্দাবলির দিক দিয়ে এতে সংস্কৃত শব্দের পরিবর্তে সংস্কৃত শব্দ থেকে উৎপন্ন শব্দ (যেমন, চন্দ্র থেকে চাঁদ) অনেক বেশি। তা ছাড়া, উনিশ শতকের সাধু রীতির গদ্য থেকে যেসব আরবি, ফারসি শব্দ একেবারে নির্বাসিত হয়েছিল, তার অনেকগুলি এ ভাষার মাধ্যমে ফিরে এলো। এভাবে রবীন্দ্রনাথের সহায়তায় প্রমথ চৌধুরী একটা সাহিত্যিক চলিত ভাষা প্রবর্তন করেন এবং বাংলা গদ্যের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসেন। ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আগেই এ ভাষা কাহিনীমূলক রচনা এবং প্রবন্ধ—উভয়ের জন্যে প্রামাণ্য ভাষা হিসেবে বিবেচিত হয়। তা সত্ত্বেও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বিখ্যাত ঔপন্যাসিকরা সাধু ভাষার সর্বনাম এবং ক্রিয়া-বিভক্তি অাঁকড়ে থাকেন, যদিও তাঁরা বঙ্কিমচন্দ্রের সাধু ভাষা থেকে অনেকটা দূরেই চলে এসেছিলেন।

বিশ শতকের দ্বিতীয় ভাগে সাধু রীতি ধীরে ধীরে অপ্রচলিত হয়ে পড়ে এবং তার জায়গা দখল করে চলিত গদ্য। ১৯৪৭ সালের দেশ-বিভাগের প্রভাবও পড়েছিল বাংলা গদ্যের ওপর।  প্রথমত, পূর্ববঙ্গে  আরবি-ফারসি শব্দ অনেক বেশি মাত্রায় ব্যবহূত হয়। বিশেষ করে স্বাধীন বাংলাদেশের লেখকরা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে পূর্ববঙ্গীয় শব্দ এবং মুসলিম সমাজের সঙ্গে জড়িত প্রতিদিনের শব্দ ব্যবহার করছেন। অনেকে মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের ভাষার প্রতি আনুগত্য দেখানোর কোনো প্রয়োজন নেই। অপরপক্ষে, যেসব লেখক পূর্ববঙ্গ থেকে সেখানে গেছেন, তাঁরা জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে পূর্ববঙ্গীয় অনেক শব্দ, এমনকি, আঞ্চলিক শব্দ ব্যবহার করেছেন। আর পশ্চিমবঙ্গের যেসব লেখক রাঢ় অথবা গৌড় অঞ্চল থেকে এসেছেন, তাঁরাও ক্রমবর্ধমান মাত্রায় সেসব জায়গার আঞ্চলিক শব্দ বিশেষ করে গল্প, উপন্যাস এবং নাটকে ব্যবহার করছেন। এভাবে বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের ভাষায় খানিকটা পার্থক্য ইতোমধ্যেই দেখা দিতে আরম্ভ করেছে, বিশেষ করে কাহিনীমূলক রচনা এবং মুখের ভাষায়। [গোলাম মুরশিদ]

গ্রন্থপঞ্জি  আনিসুজ্জামান, আঠারো শতকের বাংলা গদ্য (ঢাকা, বাংলা একাডেমী, ১৯৮৪); গোলাম মুরশিদ, কালান্তরে বাংলা গদ্য, কলকাতা, আনন্দ পাবলিশার্স, ১৯৯২; আঠারো শতকের গদ্য, ঢাকা, অন্যপ্রকাশ, ২০০৯; Das, Shishir Kumar, Early Bengali Prose: Carey to Vidyasagar, Kolkata : Bookland, 1966;  S. K. De, Bengali Literature in the Nineteenth Century, Kolkata: Firma KL Mukhopadhya, 1962; সজনীকান্ত দাস, বাংলা গদ্য সাহিত্যের ইতিহাস; সুকুমার সেন, বাঙ্গালা সাহিত্যে গদ্য, কলকাতা, আনন্দ পালিশার্স, ১৯৯৮; প্রথম প্রকাশ ১৯৩৪; মুহম্মদ সাইফুল ইসলাম, অক্ষয়কুমার দত্ত ও উনিশ শতকের বাঙলা, ঢাকা, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০০৯।