বাংলাদেশ মহিলা সমিতি
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি পূর্ব নাম All Pakistan Women’s Association (APWA)। সাধারণত আপওয়া নামে পরিচিত ছিল। ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ফিরোজ খান নুন-এর স্ত্রী ভিকারুননিসা নুন, বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদ ও অধ্যক্ষ হামিদা খানমের নেতৃত্বে আপওয়া-র একটি শাখা খোলা হয়। সেই সময় এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিত্তবান নারীরা কিছু দাতব্য ও সমাজসেবামূলক কাজকর্ম করতেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এই সংগঠনটি বাংলাদেশ মহিলা সমিতি নাম ধারন করে। সকল পেশা ও সংগঠনের মহিলাদের জন্য এটি ছিল উন্মুক্ত। ১৯৭২ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের এক গেজেট নোটিফিকেশনের মাধ্যমে বেগম নূরজাহান মোর্শেদ (এম.পি)-এর নেতৃত্বে এই সংগঠনটি পরিচালনার জন্যে একটি অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু ১৯৭২ সালের ১২ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পুনঃগেজেট নোটিফিকশনের মাধ্যমে ২৮ ফেব্রুয়ারির আদেশ বাতিল করা হয় এবং ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে নতুন আরেকটি অস্থায়ী কমিটি গঠিত হয়। এই কমিটি কার্যকর হওয়ার ফলে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি নিখিল পাকিস্তান মহিলা সমিতির (আপওয়া) পূর্বপাকিস্তান শাখার সকল কার্যক্রম ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকানা লাভ করে।
পরবর্তীকালে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি একটি স্বেচ্ছাসেবী, সমাজকল্যাণমূলক ও অরাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে সোস্যাল ওয়েলফেয়ার অ্যাক্ট ও এনজিও ব্যুরোর অধীনে নিবন্ধিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের মূল লক্ষ্য মহিলাদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলা ও অনুদাসত্ব থেকে মুক্ত করা এবং মহিলা সমাজ বিশেষভাবে দরিদ্র মহিলাদের কল্যাণ করা। সমিতির উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে আছে মহিলাদের উন্নয়ন, আইনগত ও সামাজিক অধিকার সম্পর্কে মহিলাদের সচেতনতা বৃদ্ধি, মহিলাদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক ও স্বাস্থ্যগত সমস্যা সমাধান, কর্মরত মহিলাদের ছেলেমেয়েদের জন্য স্কুল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ক্ষুদ্রশিল্প প্রতিষ্ঠান, প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও শিশুসদন প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা, বয়স্ক মহিলা ও তরুণীদের জন্য পাঠাগার স্থাপন, দরিদ্র মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান ও তাদের উৎপাদিত পণ্য বিপণন ও তাদের সেবা গ্রহণ ইত্যাদি।
মহিলা সমিতির কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি পরিচালনা পরিষদ রয়েছে। প্রতি তিন বৎসর অন্তর সমিতির সদস্যদের ভোটের মাধ্যমে পরিচালনা পরিষদ গঠিত হয়। এই পরিচালনা পরিষদ ২৭ সদস্যবিশিষ্ট। সমিতির নিজস্ব গঠনতন্ত্র অনুসারে সকল কার্যক্রম পরিচালিত হয়। মহিলা সমিতির কেন্দ্রীয় অফিস ঢাকার ৪ নাটক সরণিতে (নিউ বেইলি রোড) অবস্থিত। ঢাকা ছাড়া ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, টাঙ্গাইল, রংপুর, ফরিদপুর, নীলফামারী, রাজশাহী, বরগুনা, বোয়ালমারী, কুষ্টিয়া, যশোর, পাবনা ও ভৈরবে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির শাখা রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ব্যক্তিগত এবং দেশিবিদেশি দাতাদের আর্থিক সহায়তায় বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ করে থাকে। সমিতি সাংস্কৃতিক উন্নয়নে কাজ করে, স্বাস্থ্য ও আইনসেবা প্রদান করে এবং উপার্জনমূলক কর্মকান্ডে কারিগরি ও অন্যান্য সহযোগিতা প্রদান করে। মহিলা সমিতির একটি নিজস্ব মিলনায়তন ও স্থায়ী নাট্য মঞ্চ রয়েছে। মিলনায়তনটির নাম নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তন। গণমুখী নান্দনিক নাট্যচর্চার সুযোগ বাড়ানোর জন্য ১৯৭৩ সালে সমিতি স্থায়ী মঞ্চটি তৈরি করে। এই মঞ্চে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় প্রযোজিত ও পরিচালিত তৈল সংকট নাটক সর্বপ্রথম মঞ্চায়িত হয়। মহিলা সমিতির মঞ্চটি বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। মিলনায়তন ও স্থায়ী নাট্য মঞ্চটি মহিলা সমিতির আয়ের একটি প্রধান উৎস।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি লিগ্যাল এইড শাখার মাধ্যমে নারী নির্যাতন দূরীকরণ ও নারী অধিকার সংরক্ষণে আইনগত সহায়তা প্রদান করে থাকে এবং এতদ্বিষয়ে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও কর্মশালার আয়োজন করে থাকে। ২০০৬ থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত কানাডিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট এজেন্সির সহায়তায় বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ‘বন্ধন’ নামে একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার সিদ্ধেশ্বরী গালর্স কলেজের সমাজকল্যাণ বিভাগের ছাত্রীদের আইন সংক্রান্ত বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনে সহযোগিতা করেছে।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতির দুটি অবৈতনিক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে। এই বিদ্যালয়গুলি ঢাকার আগা নওয়াব দেউড়ি ও বেইলি রোডে সমিতির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কাছে অবস্থিত। এই দুই স্কুলের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা তিনশত চল্লিশ জন। এছাড়া সমিতির একটি বালিকা বিদ্যালয়, ছেলেদের জন্য একটি এতিমখানা ও দুইটি উপ-আনুষ্ঠানিক বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম চালু আছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরে সমিতির কয়েকটি পরিবার পরিকল্পনা ও স্বাস্থ্য কেন্দ্র আছে। ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে সমিতির তিনটি স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করা হয়।
ক্ষুদ্র শিল্পে মহিলা উদ্যোক্তা তৈরি করার জন্য মহিলা সমিতি সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীদের সেলাই, বাটিক, বুটিক, এমব্রয়ডারি ও নানা ধরনের কুটির শিল্প তৈরির প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। নারী উদ্যোক্তাদের তৈরি পণ্য বিপণনের জন্য মহিলা সমিতি নিউ বেইলি রোডে কেন্দ্রীয় অফিস সংলগ্ন একটি শাড়ির দোকান ও সাকুরা মার্কেটে একটি অলংকার তৈরির দোকান পরিচালনা করে থাকে। তবে কমিউনিটিভিত্তিক সকল কার্যক্রম ঢাকা ও চট্টগ্রামের কয়েকটি এলাকায় সীমাবদ্ধ রয়েছে।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি তাদের পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মায়েদের নিয়ে বৈশাখি ও ফাল্গুনি নামে দুইটি মাদার্স ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছে। মহিলা সমিতি মাদার্স ক্লাবের সদস্যদের সাক্ষরতা, স্বাস্থ্য, আইন ও শিশুকল্যাণের পাশাপাশি মেশিন এমব্রয়ডারি, ব্লক প্রিন্টিং ও টেইলারিংসহ বিভিন্ন ধরনের বিক্রয়যোগ্য খাবার তৈরি ও ঠোঙ্গা প্রস্ত্ততের উপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। সমিতি দেশীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইভেন্স গ্রুপ অব ইন্ড্রাস্ট্রিজ-এর সঙ্গে যৌথভাবে মহিলাদের তিনমাসব্যাপী কম্পিউটার এবং বেসিক ও অ্যাডভান্সড ইংরেজি কোর্স পরিচালনা করে থাকে।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি উচ্চমাধ্যমিক স্তরে দুঃস্থ ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের সহায়তা প্রদানে ‘নীলিমা ইব্রাহিম শিক্ষা সহায়তা প্রকল্প’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করে থাকে। এ ছাড়া এই প্রকল্পের মাধ্যমে শিক্ষাবিষয়ক সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন, মহিলা ও শিশুবিষয়ক বই ও সাময়িকী প্রকাশ করে। এই প্রকাশনাগুলির মধ্যে দীপান্বিতা ও স্মরণিকা উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ২০০১ সাল থেকে মহিলাদের জন্য ‘ব্রেস্ট ক্যান্সার সচেতনতা কার্যক্রম’ নামে একটি প্রকল্প পরিচালনা করে আসছে। সপ্তাহে তিন দিন এখানে বিনামূল্যে মহিলাদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। এই প্রকল্পের উদ্যোগে ঢাকার বাইরে বিভিন্ন স্থান ও শাখাসমিতিতে ব্রেস্ট ক্যান্সারের উপর আলোচনা ও ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। এই প্রকল্পটি কান্ট্রি উইমেন এসোসিয়েশন ইন তাসমেনিয়া অস্ট্রেলিয়া ও এসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ইউকে-র আর্থিক সহায়তায় চলছে।এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতি আন্তর্জাতিক নারী সংস্থার সহায়তায় শিশু আইসিইউ কেয়ারের জন্য সেবিকা এবং বিভিন্ন প্রতিবন্ধী সংগঠনের পুরুষ ও মহিলাদের বিদেশে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য স্পনসরশিপের ব্যবস্থা করে থাকে।
১৯৭৫ সালে মহিলা সমিতি, মহিলা আওয়ামী লীগ, মহিলা পরিষদ ও মহিলা ক্রীড়াসংস্থাসহ দেশের নারী সংগঠনগুলি ড. নীলিমা ইব্রাহিমের নেতৃত্বে গঠিত জাতীয় প্রস্ত্ততি কমিটির মাধ্যমে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করে।
বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ১৯৭৪ সালে হাঙ্গেরিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের প্রস্ত্ততি কমিটির বৈঠকে প্রতিনিধিত্ব করে। সমিতি ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে মেক্সিকো আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনের নেতৃত্ব দানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও যোগাযোগের ক্ষেত্রে অনেকদূর এগিয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে সমিতি এসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড ও ইন্টারন্যাশনাল এলিয়ান্স অব উইমেন-এর সদস্যপদ লাভ করে। নারী দশকে বেইজিং অ্যাকশন প্ল্যান বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ড. নীলিমা ইব্রাহিম বেইজিং প্লাস ফাইভ এনজিও কমিটির চেয়ারপারসন ছিলেন। ২০০১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত মহিলা সমিতির সভানেত্রী বেগম আইভী রহমান এসোসিয়েটেড কান্ট্রি উইমেন অব দ্য ওয়ার্ল্ড-এর এরিয়া প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করেন ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সাহারা খাতুন ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত ইন্টারন্যাশনাল এলিয়ান্স অব উইমেন-এর বোর্ড মেম্বারের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ মহিলা সমিতির সভানেত্রী ও সদস্যরা বিদেশে বিভিন্ন কনফারেন্স, সেমিনার ও ওয়ার্কশপে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে থাকেন। [নিবেদিতা দাশ পুরকায়স্থ]