বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অধিকাংশ বাঙালি সদস্য বাহিনী ত্যাগ করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন। তাঁরাই বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে তোলেন এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর সরকার ১৯৭১ সালের ৮ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাহিনী গঠনের ঘোষণা দেয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগকালে রয়েল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের বিমান ও অন্যান্য সম্পদ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। রয়েল ইন্ডিয়ান এয়ার ফোর্সের সবগুলি প্রশিক্ষণ স্থাপনাই ছিল পাকিস্তানের সীমার মধ্যে। প্রায় সব মুসলিম বিমান সেনাই পাকিস্তানে চলে আসে এবং পাকিস্তান এয়ার ফোর্সে যোগ দেয়। তাঁদের মধ্যে বেশ কিছু বাঙালি বিমান সেনাও ছিলেন এবং তাঁদের কেন্দ্র করেই পাকিস্তান বিমানবাহিনীতে বাঙালি সেনাদল গড়ে ওঠে।
স্বাধীনতার পর পশ্চিম পাকিস্তানে আটকে পড়া পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও সৈন্যরা সিমলা চুক্তির শর্তানুসারে ১৯৭৩ সালের ডিসেম্বর নাগাদ মুক্তি পেয়ে বাংলাদেশে চলে আসেন। এঁদের সকলকে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে যোগদানের অনুমতি দেয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বিমানবাহিনীর সদস্যগণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীকে একটি আধুনিক বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলেন। একটি ডাকোটা বিমান, একটি ওটার ও একটি আলেটি হেলিকপ্টার নিয়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর যাত্রা শুরু হয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনীর ১৭ জন বাঙালি কর্মকর্তা ও ৫০ জন কারিগরি বিমানসেনা ছিলেন বিমানবাহিনীর প্রথম জনবল। এঁদের প্রধান ছিলেন এয়ার কমোডর এ.কে খন্দকার। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী পাকিস্তানি লক্ষ্যবস্ত্তর ওপর কমপক্ষে ১২ বার সফল আক্রমণ চালায়। এয়ার গানার ফ্লাইট সার্জেন্ট শহিদুল্লাহর (বীর প্রতীক) বীরোচিত রণকুশলতা বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর ইতিহাসে কিংবদন্তি হয়ে আছে। প্রতিটি অভিযানেই তিনি শত্রুর অবস্থান ও লক্ষ্যবস্ত্তর ওপর যথাযথভাবে গোলাবর্ষণ করেন। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীতে কয়েকটি মিগ-২৯ বিমান রয়েছে। বিমানবাহিনী যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পেয়েছে কয়েকটি সি-১৩০ প্যারাট্রুপার।
বিমানবাহিনীর পাইলট ও বিমানকর্মীদের পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য কয়েকটি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একাডেমীতে বিমানবাহিনীর পাইলটরা পাঁচটি পর্যায়ে আড়াই বছরের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। সাফল্যের সঙ্গে এই প্রশিক্ষণ শেষ হলে প্রত্যেক পাইলটকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি (বি এস-সি, অ্যারো) প্রদান করা হয়। ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টর্স স্কুলে সম্ভাবনাময় ফ্লাইং ইনস্ট্রাক্টরদের উড্ডয়নের ওপর ২২ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ফ্লাইট সেফটি ইনস্টিটিউটে উড্ডয়ন নিরাপত্তা বিষয়ে পাইলট ও অন্যান্য বিমানকর্মীদের তিন সপ্তাহ থেকে বারো সপ্তাহের বিভিন্ন মেয়াদি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অফিসার্স ট্রেনিং স্কুলে ডিগ্রি ইঞ্জিনিয়ার ছাড়া স্থল শাখার অপরাপর অফিসারদের ছয় থেকে নয় মাসের পেশাগত প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বর্তমানে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী একাডেমী বিমানবাহিনীর বিমান চালনা ইঞ্জিনিয়ারদের বি.এসসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে শিক্ষাদান করছে। এ কোর্সের ডিপ্লোমা দেয়া হয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের উচ্চতর পেশাগত প্রশিক্ষণের জন্য স্টাফ কলেজ ও ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে পাঠানো হয়। রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুলে সকল শাখার বিমানসেনাকে প্রথম অবস্থায় ৩৬ সপ্তাহের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। সাফল্যের সঙ্গে এই প্রশিক্ষণ শেষ করার পর তাদের বিমান চালনা প্রকৌশল ও অন্যান্য কোর্সে আরও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিমান চালনা সংক্রান্ত উচ্চতর কোর্স এবং বিমানবাহিনীর অন্যান্য কারিগরি কোর্স বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সহযোগী প্রকৌশলীর ডিপ্লোমার সমতুল্য। বর্তমানে রিক্রুটস ট্রেনিং স্কুলের প্রশিক্ষকদের ঐ স্কুল ও বিমানবাহিনীর অন্যান্য প্রশিক্ষণকেন্দ্রে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এ প্রতিষ্ঠান সিনিয়র টেকনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট ও অন্যান্য কোর্সও পরিচালনা করে থাকে।
প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক কমিশন, নন কমিশন বা জুনিয়র কমিশন পদমর্যাদার বিমানসেনা নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর শাখাগুলি হচ্ছে জিডি (পি)/জিডি (এন), ম্যানটিন্যান্স টেকনিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ম্যানটিন্যান্স টেকনিক্যাল কম্যুনিকেশন অ্যান্ড ইলেকট্রোনিক্স, ম্যানটিন্যান্স টেকনিক্যাল আরমামেন্ট, লজিস্টিক, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল, এডুকেশন, মিল্যান্ট, একাউন্টস, মেট্রোলজি, এম.ও.ডি.সি (এয়ার) ইত্যাদি। বিমানবাহিনীর কমিশন অফিসারদের পর্যায়ক্রমিক পদগুলি হচ্ছে পাইলট অফিসার, ফ্লাইং অফিসার, ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট, স্কোয়াড্রন লিডার, উইং কম্যান্ডার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন, এয়ার কমোডর, এয়ার ভাইস মার্শাল ও মার্শাল অব দি এয়ার ফোর্স। [সৈয়দ মোহাম্মদ সালেহ্ উদ্দিন]