বাংলাদেশ বার কাউন্সিল
বাংলাদেশ বার কাউন্সিল বাংলাদেশ আইনজীবী ও বার কাউন্সিল আদেশ ১৯৭২ (রাষ্ট্রপতির ১৯৭২ সালের ৪৬ নং আদেশ)-এর অধীনে গঠিত একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন। কাউন্সিলের কার্যাবলির মধ্যে রয়েছে অ্যাডভোকেটদের তালিকাভুক্তি, তালিকাভুক্তির জন্য পরীক্ষা অনুষ্ঠান এবং পেশাগত অসদাচরণ বা বার কাউন্সিলকে প্রদেয় চাঁদা পরিশোধ না করার দায়ে অ্যাডভোকেটদের নিবন্ধন বাতিল।
লেটার্স প্যাটেন্ট বলে ১৭৭৪ সালে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট ও অ্যাটর্নিদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব লেটার্স প্যাটেন্টের ১১ ধারা অনুযায়ী ওই কোর্টের উপরই ন্যস্ত হয়। কলকাতায় কোম্পানির সর্বোচ্চ আদালত হিসেবে সদর দেওয়ানি আদালত ১৭৯৩ সালের ৭ নং প্রবিধান অনুযায়ী ঐ আদালতে ও অধস্তন কোম্পানি আদালতগুলিতে আইনপেশায় নিয়োজিত উকিলদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের কাজ করত। ১৮৬২ সালে সুপ্রিম কোর্ট, সদর দেওয়ানি আদালত ও সদর নিজামত আদালত তুলে দিয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়মে জজিয়তি হাইকোর্ট প্রতিষ্ঠার পর এ আদালত অ্যাডভোকেট, অ্যাটর্নি, উকিল, কৌঁশুলি ও মোক্তারদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা লাভ করে। অ্যাডভোকেটরা ছিলেন ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ড থেকে পাস করা ব্যারিস্টার অথবা স্কটল্যান্ডের ফ্যাকাল্টি অফ অ্যাডভোকেট্স-এর সদস্য। অ্যাটর্নিদের নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যাডভোকেটরা কলকাতা হাইকোর্টের মূল বিভাগে হাজিরা দিতে ও ওকালতি করতে পারতেন এবং ওই আদালতের আপিল বিভাগ ও অন্যান্য অধস্তন আদালতে ওকালতি করার অনুমতিও পেতেন। কিন্তু যোগ্যতাসম্পন্ন দেশীয় আইনজীবীদের মধ্য থেকে তালিকাভুক্ত কলকাতা হাইকোর্টের উকিলদের ওই আদালতের মূল বিভাগে কাজ করার অধিকার ছিল না। তাই দেশে একটি সর্বভারতীয় বার গঠন এবং অ্যাডভোকেট ও উকিলদের মধ্যে পার্থক্য নিরসনের দাবি ওঠে। এ দাবির পরিপ্রেক্ষিতে স্যার এডওয়ার্ড চ্যামিয়ারকে সভাপতি করে ১৯২৩ সালে ইন্ডিয়ান বার কমিটি গঠিত হয়। ১৯২৪ সালে সে কমিটি একটি প্রতিবেদন পেশ করে এবং ইন্ডিয়ান বার কাউন্সিল অ্যাক্ট ১৯২৬ কার্যকর হয়।
এ আইনে প্রথমবারের মতো প্রত্যেক হাইকোর্টে যৌথ সংগঠন হিসেবে একটি করে বার কাউন্সিল গঠনের বিধান রাখা হয়। ১৫ জন সদস্য নিয়ে গঠিত প্রতিটি বার কাউন্সিলে থাকতেন অ্যাডভোকেট জেনারেল, হাইকোর্ট কর্তৃক মনোনীত ৪ জন সদস্য এবং হাইকোর্টের অ্যাডভোকেটদের নিজেদের মধ্য থেকে নির্বাচিত ১০ জন সদস্য। হাইকোর্টের পূর্বানুমতিসহ বার কাউন্সিলকে হাইকোর্টের জন্য অ্যাডভোকেট নিবন্ধন ও তাদের নিয়ন্ত্রণের নিয়মকানুন তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তবে কোনও ব্যক্তিকে অ্যাডভোকেট হিসেবে গ্রহণ না করার ব্যাপারে হাইকোর্টের ক্ষমতাকে কোনভাবে খর্ব করার অধিকার বার কাউন্সিলের ছিল না। এ আইনে হাইকোর্টের মূল বিভাগে আইন ব্যবসায়ে আগ্রহী আবেদনকারীদের যোগ্যতা নির্ধারণের ক্ষমতা এবং তাদের গ্রহণ ও প্রত্যাখ্যান বা কী কী শর্তে বা পরিস্থিতিতে তারা ওই আদালতের অধীনে আইনব্যবসা করতে পারবেন তা নির্ধারণের ক্ষমতা হাইকোর্টের হাতেই ন্যস্ত থাকে। পূর্বতন অ্যাডভোকেট ও উকিলদের অ্যাডভোকেট হিসেবে একীভূত করা হয়, কিন্ত ব্যারিস্টার ও ব্যারিস্টার নন এমন অ্যাডভোকেটদের মধ্যকার পার্থক্য আগের মতোই থেকে যায়।
হাইকোর্ট আইনজীবীদের কোনও অসদাচরণের অভিযোগের তদন্তকার্য বার কাউন্সিলের ট্রাইব্যুনালের উপর ন্যস্ত করতে পারত এবং অভিযোগ প্রমাণিত হলে ট্রাইব্যুনাল আইনজীবীকে তিরস্কার, তার আইন ব্যবসা সাময়িকভাবে স্থগিত বা স্থায়ীভাবে বাতিল করতে পারত। আইনজীবীদের নিবন্ধন ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা ছিল হাইকোর্টের হাতে, বার কাউন্সিল ছিল নেহাৎ একটি উপদেষ্টা সংগঠন। কালক্রমে কলকাতা হাইকোর্ট তার বিধিবিধান উদার করে এবং নন-ব্যারিস্টার অ্যাডভোকেটদের হাইকোর্টে মূল মামলা পরিচালনার অনুমতি দেয়। ১৯৬৫ সালের লিগ্যাল প্র্যাকটিশনার্স অ্যান্ড বার কাউন্সিল অ্যাক্ট কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থা চলতে থাকে। ওই আইনের ফলে সমগ্র দেশের জন্য একটি এবং পাকিস্তানের প্রতি দুই প্রদেশের জন্য একটি করে বার কাউন্সিল গঠিত হয়। এতে ছিলেন ১৪ জন নির্বাচিত সদস্য এবং পদাধিকারবলে একজন সভাপতি। এ আইনে ব্যারিস্টার ও নন-ব্যারিস্টার এবং অন্যান্য শ্রেণীর আইনজীবীদের মধ্যকার পার্থক্য লোপ পায় এবং দুই শ্রেণীর আইনজীবীর নিবন্ধনের বিধান চালু হয়; এক শ্রেণী হাইকোর্টের জন্য এবং অপর শ্রেণী অধস্তন আদালতসমূহের জন্য। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশবলে ১৯৬৫ সালের আইন বাতিল করে বার কাউন্সিল পুনর্গঠন করা হয়।
১৯৭২ সালের রাষ্ট্রপতির আদেশে গঠিত বার কাউন্সিলের সদস্য সংখ্যা ১৫; তন্মধ্যে পদাধিকারবলে বার কাউন্সিলের সভাপতি থাকেন বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল। অবশিষ্ট ১৪ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জন অ্যাডভোকেটদের মধ্য থেকে তাদের ভোটে নির্বাচিত, বাকি ৭ জন নির্বাচিত হন প্রতিটি গ্রুপ থেকে একজন করে ৭টি গ্রুপে বিভক্ত স্থানীয় আইনজীবী সমিতিগুলির সদস্যদের মধ্য থেকে। বার কাউন্সিলের সদস্যরা নিজেদের মধ্য থেকে একজন সহসভাপতি নির্বাচন করেন। বার কাউন্সিলের মেয়াদ ৩ বছর।
বার কাউন্সিলের কয়েকটি স্থায়ী কমিটি রয়েছে, যথা কাউন্সিলের প্রশাসন পরিচালনার জন্য নির্বাহী কমিটি, আইনজীবীদের সদস্যভুক্ত করার জন্য পরীক্ষা পরিচালনা ও নিবন্ধন কমিটি, কাউন্সিলের অর্থ বা তহবিল নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনার জন্য ফাইন্যান্স কমিটি এবং আইনজীবীদের আইনগত শিক্ষার মান নির্ধারণের জন্য আইনি শিক্ষা কমিটি। এছাড়া রয়েছে অন্য যেকোনও উদ্দেশ্যে বার কাউন্সিলের সদস্য সমন্বয়ে গঠিত অন্যান্য কমিটি।
বার কাউন্সিল এযাবৎ বার কাউন্সিরের দুজন সদস্য এবং আইনজীবীদের মধ্য থেকে একজন সদস্য সমন্বয়ে একাধিক ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। এসব ট্রাইব্যুনাল আইনজীবীদের বিরুদ্ধে অসদাচণের অভিযোগের শুনানি গ্রহণ এবং ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক পরিচালিত তদন্তে অভিযুক্ত আইনজীবী দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে গৃহীতব্য পদক্ষেপ সুপারিশ করে। ট্রাইব্যুনালের কোনও রায়ে সংক্ষুব্ধ যেকোনও আইনজীবী হাইকোর্ট বিভাগে আপিল পেশ করতে পারেন।
বাংলাদেশের নাগরিক ও ন্যূনতম ২১ বছর বয়স্ক আইনের স্নাতক বা ব্যারিস্টার, অন্যূন ৭ বছরের অভিজ্ঞ কোন অ্যাডভোকেটের অধীনে ৬ মাসের শিক্ষানবিসী সম্পন্ন করে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ফি পরিশোধের মাধ্যমে হাইকোর্ট বিভাগের অধীনস্থ আদালতসমূহে আইনব্যবসা করার লক্ষ্যে নিবন্ধনের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্য বলে বিবেচিত হন। লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর তাকে বার কাউন্সিলের লিগ্যাল এডুকেশন অ্যান্ড ট্রেনিং ইস্টিটিউট পরিচালিত প্রশিক্ষণেও অংশ নিতে হয়। অ্যাডভোকেট হিসেবে কোন অধস্তন আদালতে দুবছর আইনব্যবসার অভিজ্ঞতা লাভ (যদি শর্তমুক্ত না করা হয়ে থাকে) ও অন্যান্য শর্তাদি পূরণের পর তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধনের জন্য পরীক্ষায় অংশগ্রহণের যোগ্যতা অর্জন করেন। নিবন্ধনের জন্য বার কাউন্সিল কর্তৃক পরিচালিত লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে অতিরিক্ত ফি প্রদানের মাধ্যমে তিনি হাইকোর্ট বিভাগের অ্যাডভোকেট হিসেবে নিবন্ধিত হন। কয়েকটি নির্দিষ্ট শর্তে বার কাউন্সিল আইনজীবী সমিতি ও আইনজীবীদের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। নিবন্ধন লাভের পর প্রত্যেক অ্যাডভোকেটকে কোনো না কোনো আইনজীবী সমিতির সদস্য হতে হয়। আইন বিষয়ক জ্ঞান প্রসারের লক্ষ্যে বার কাউন্সিল ‘বাংলাদেশ লিগ্যাল ডিসিসন্স’ নামে একটি মাসিক আইন বিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ করে। এতে প্রধানত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের গুরুত্বপূর্ণ রায়গুলির বিবরণ প্রকাশিত হয়।
বার কাউন্সিল রুল্স ১৯৭২-এ বার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচন, বার কাউন্সিল ও এর কমিটিগুলোর সভা, নিয়মশৃঙ্খলা সম্পর্কিত ধারাবিবরণী, বার কাউন্সিলের সভাপতি ও সহসভাপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলি, বার কাউন্সিল কর্তৃক নিযুক্ত নির্বাহী কমিটির সভাপতি ও সেক্রেটারির ক্ষমতা ও কার্যাবলি, আইনজীবীদের সদস্যভুক্তি, কমিটিগুলোর কার্যাবলি, অর্থবিষয়ক ইত্যাদি বিশদ বিধিবিধান বর্ণিত রয়েছে। কল্যাণ তহবিল বিধিমালায় রয়েছে অবসরপ্রাপ্ত বা অক্ষম এবং প্রয়াত আইনজীবীদের পরিবার/মনোনীত ব্যক্তিদের অনুদান প্রদান ও কল্যাণ তহবিলের আয়ব্যয় পরিচালনা, চাঁদা সংগ্রহ ইত্যাদির বিশদ বিধান। কোনও দুঃস্থ বা প্রয়াত আইনজীবীর পরিবারকে আর্থিক সহায়তা প্রদান, চাঁদা আদায় ও তহবিল পরিচালনার বিধান রয়েছে ত্রাণ তহবিল বিধিমালায়। আইনজীবীদের মুহুরিদের নিবন্ধন বিধিমালায় মুহুরিদের যোগ্যতা, নিবন্ধীকরণ এবং নিবন্ধন স্থগিত ও বাতিল করা সংক্রান্ত নিয়মকানুন বর্ণিত রয়েছে। মুহুরিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের শুনানি সংক্রান্ত বিধিমালায় শুনানির প্রক্রিয়া সংক্রান্ত নিয়ম বর্ণিত আছে। বার কাউন্সিলের নির্বাহী কমিটি কর্তৃক আপিল শুনানি সংক্রান্ত বিধিমালায় কোনোও মুহুরির বিরুদ্ধে অভিযোগের ব্যাপারে নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের প্রদত্ত সিদ্ধান্ত এবং সে সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ মুহুরির পেশকৃত আপিলের শুনানি ও নিষ্পত্তি বিষয়ে নিয়ম বর্ণিত আছে। অন্যান্য আইনজীবী, মক্কেল ও সাধারণ মানুষের সঙ্গে আইনজীবীদের আচরণ, আদালতে তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য ইত্যাদি বিষয়ে অনুসরণীয় একটি পেশাগত আচরণ বিধিমালা বাংলাদেশ বার কাউন্সিল প্রণয়ন করেছে। বিশেষ তহবিল বিধিমালায় বিশেষ তহবিল যেমন লিগ্যাল এডুকেশন ফান্ড, CLEP ফান্ড ও এডুকেশন রিজার্ভ ফান্ডের মতো বিশেষ তহবিল পরিচালনার বিধিবিধান সন্নিবেশিত আছে। [কাজী এবাদুল হক]