বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন
বাংলাদেশ ফ্রিডম ফাউন্ডেশন একটি স্বাধীন জাতীয়ভিত্তিক অনুদান প্রদানকারী ফাউন্ডেশন, যা বাংলাদেশের সামাজিক খাতের প্রতিষ্ঠানসমূহকে অনুদান প্রদান করে থাকে। প্রতিষ্ঠানটি নববইয়ের দশকের শেষের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ফোর্ড ফাউন্ডেশনের সাথে বাংলাদেশের প্রথিতযশা কয়েকজন নাগরিকের আলোচনার ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। ফোর্ড ফাউন্ডেশন বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নেওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশে একটি ফ্রিল্যানথ্রপি ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠায় অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনামকে এটি প্রতিষ্ঠায় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন হিসেবে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করার অনুরোধ জানায়। এ প্রক্রিয়ায় ১৯৯৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মাহফুজ আনামকে চেয়ারপারসন ও অধ্যাপক রেহমান সোবহানকে কোষাধ্যক্ষ করে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রতিষ্ঠাকালীন ট্রাস্টি বোর্ডের অন্যান্য সদস্যরা হলেন: সৈয়দ মনজুর এলাহী, ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, ড. মুহম্মদ ইউনুস, ড. নায়লা খান, মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল, কাজী ফজলুর রহমান, ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ এবং ড. মেঘনা গুহঠাকুরতা। বর্তমানে এর ১১ সদস্যবিশিষ্ট ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্যরা হলেন: সৈয়দ মনজুর এলাহী (চেয়াপারসন), মাহফুজ আনাম, দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য, সুলতানা কামাল, রোকেয়া আফজাল রহমান, পারভীন হাসান, ড. প্রতিমা পাল মজুমদার, স্যামসন এইচ চৌধুরী, অ্যাঞ্জেলা গোমেজ, অধ্যাপক জাফর ইকবাল এবং ইফতেখারুজ্জামান। তাছাড়া, অধ্যাপক মুহম্মদ ইউনুস অ্যামিরেটাস ট্রাস্টি হিসেবে রয়েছেন। বোর্ড ফাউন্ডেশনের ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের আলোকে ফাউন্ডেশনের কাজের নির্দেশনা, অনুমোদন, মনিটরিংস ও মূল্যায়ন করে থাকে। এছাড়া ফাউন্ডেশনের উন্নয়ন ও আর্থিক ক্ষমতা বৃদ্ধিতে বোর্ড সচেষ্ট থাকে। নির্বাহি পরিচালক বোর্ডের নির্দেশ মোতাবেক ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম পরিচালনা করে। বর্তমানে সাফি রহমান খান এর নির্বাহী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন।
ফাউন্ডেশন মূলত ফোর্ড ফাউন্ডেশন কর্তৃক প্রদত্ত এনডাউনমেন্ট ফান্ডে অর্জিত লভ্যাংশের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। ১৯৯৭ সালে এটি ট্রাস্ট আইন এবং এপ্রিল ১৯৯৮ বাংলাদেশ সরাকারের এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধিত।
ফাউন্ডেশন গত ১০ বছরের কাজের মূল্যায়ন করে বর্তমানে মাধ্যমিক পর্যায়ের বিজ্ঞানশিক্ষাকে জনপ্রিয়করণের জন্য অর্থায়ন করার বিষটি গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। কারণ ইদানীং লক্ষ করা যাচ্ছে নানবিধ কারণে দেশে শিক্ষার্থিরা বিজ্ঞান শিক্ষার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। ফলে তারা বিজ্ঞানের বদলে কলা কিংবা বাণিজ্য বিষয়ে পড়তে আগ্রহী হয়ে উঠছে। এ প্রবণতা শহরের থেকে গ্রামের বিদ্যালয়গুলিতে বেশি। এর অন্যতম কারণ হলো অপেক্ষাকৃত কম সুবিধাসম্পন্ন বিদ্যালয়ে ল্যাবরেটরি সুবিধা অপ্রতুলতা। শিক্ষার্থীদের নাগালের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বস্ত্ত দিয়ে তাদের বিজ্ঞানের পরীক্ষাগুলি তারা নিজেরাই করতে পারলে বিজ্ঞানের প্রতি তাদের ভীতি অনেকটা কমে যাবে এবং আগ্রহী হয়ে উঠবে। বিজ্ঞানশিক্ষা জনপ্রিয়করণে মাধ্যমিক বিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞানক্লাব প্রতিষ্ঠা করা এর অন্যতম কৌশল। একটি বিদ্যালয়ে এ ক্লাবের সাধারণ সদস্যরা ৯-১১ জনের একটি কার্যকরী পরিষদকে নির্বাচিত করে। এ বিজ্ঞানক্লাব সারা বছরব্যাপী বিজ্ঞান বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের প্রকল্প গ্রহণ, স্কুলভিত্তিক বিজ্ঞান মেলা ও আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলার আয়োজন করে। বিজ্ঞানক্লাবে শিক্ষক ও অভিভাবকদেরকেও সম্পৃক্ত করা হয়। ইতোমধ্যে ফউন্ডেশন থেকে ‘এসো বিজ্ঞান শিখি’ নামে মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের উপযোগী বিজ্ঞানের বই বের হয়েছে যার মাধ্যমে তারা সহজে তাদের শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ের অনেকগুলি পরীক্ষা নিজেরাই করতে পারবে।
ফাউন্ডেশন ১৯৯৯ সালের মে মাস থেকে বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়ন শুরু করে। শুরুতে এর মূল লক্ষ্য ছিল তিনটি মৌলিক স্বাধীনতা তথা দারিদ্র্য, অজ্ঞতা এবং নিপীড়ন থেকে মুক্তি। আর এ লক্ষ্য অর্জনে প্রথম থেকে পাঁচটি বৃহত্তর ক্যাটাগরিতে অভিনব ক্ষেত্রে অনুদান প্রদান করা হতো। এ পাঁচ ক্যাটাগরি হলো ১. নারী ও শিশু অধিকার; ২. সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে প্রতিবন্ধীতা মোকাবেলা; ৩. অবহেলিতদের জন্য সমাজভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা; ৪. ব্যতিক্রমধর্মী শিক্ষা, তথ্য ও সংস্কৃতি চর্চা এবং ৫. সামাজিক অংশগ্রহণমূলক উদ্যেগ। উপরুক্ত সকল ক্ষেত্রেই অনুদান প্রদানে ফিল্যানথ্রপিকে উৎসাহিত করা হতো। কারণ ফাউন্ডেশন বিশ্বাস করে স্থানীয় জনসাধারণের সাথে চলমান প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে ও প্রকল্পের স্থিতিশীলতা আনতে ফিল্যানথ্রপি একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে।
ফাউন্ডেশন জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়নে ক্ষুদ্র আকারে অনুদান প্রদান করে থাকে। তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক কিংবা জাতিগত বিভেদ সৃষ্টি করে, কোন ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি করে এমন ক্ষেত্রে অনুদান করে না। সামাজিক সেক্টরে সারাদেশব্যাপী সামাজিক সংগঠনকে অনুদান প্রদান করে থাকে।
ফাউন্ডেশন এলাকাভিত্তিক ও জাতীয় ওয়ার্কশপ, সেমিনার ও অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করে থাকে। এছাড়া ফাউন্ডেশনের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা ও স্টাডি পরিচালনা করে থাকে। ইতোমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়া প্রকল্প ফোরাম অন উইমেন ইন সিকিউরিটি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (ফাওসিয়া)-র অধীন ফাউন্ডেশন থেকে নারীর অবস্থান বিষয়ক ২২টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশে ফিল্যানথ্রপি চর্চা বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ফাউন্ডেশন থেকে ত্রৈমাসিক ফিল্যানথ্রপি নামে একটি নিউজলেটার নিয়মিত প্রকাশিত হয়। [মাজহারুল ইসলাম]