বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন দেশের নাট্যদলসমূহের একটি কেন্দ্রীয় সংগঠন। ১৯৮০ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকায় এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এর প্রধান উদ্দেশ্যসমূহ: নাট্যকর্মীদের পেশাগত স্বার্থ সংরক্ষণ ও সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করা, নাট্যোন্নয়নের স্বার্থে আন্দোলন গড়ে তোলা, আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ থেকে নাটককে মুক্ত করা, মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনকারী কালাকানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে স্থায়ী রঙ্গমঞ্চ প্রতিষ্ঠার জন্য সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা, গ্রুপ থিয়েটারের আদর্শকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রামকে সংহত করা, নাটককে বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ডের সঙ্গে যুক্ত করা, নাট্যবিষয়ক পত্রিকা প্রকাশ ও সংগ্রহশালা প্রতিষ্ঠা করা, বিভিন্ন সময়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা এবং জাতীয় ভিত্তিক নাট্যোৎসবের আয়োজন করা।
ফেডারেশনের প্রধান কার্যালয় ঢাকায় অবস্থিত। প্রতিটি সদস্য গ্রুপ থিয়েটারকে একটি করে ইউনিট ধরে ফেডারেশনের সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে। সংগঠনের তিনটি পরিষদ সাধারণ পরিষদ, কেন্দ্রীয় পরিষদ ও নির্বাহী পরিষদ। সকল সদস্য গ্রুপ থিয়েটারের একজন করে প্রতিনিধি নিয়ে সাধারণ পরিষদ গঠিত হয়। এটি ফেডারেশনের সর্বোচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ। সাধারণ পরিষদ সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় পরিষদ নির্বাচিত করে। ৩৫ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় পরিষদের মধ্য থেকে ১৯ সদস্যবিশিষ্ট নির্বাহী পরিষদ গঠিত হয়। নির্বাহী পরিষদের ৬ সদস্যবিশিষ্ট সভাপতিমন্ডলীর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান এবং ১৩ সদস্যবিশিষ্ট সম্পাদকমন্ডলীর মধ্যে একজন সেক্রেটারি জেনারেল মনোনীত হন। ১৯৮১ সালের ২৩ আগস্ট ঢাকার মহিলা সমিতি মিলনায়তনে ফেডারেশনের জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে রামেন্দু মজুমদারকে চেয়ারম্যান এবং নাসিরউদ্দিন ইউসুফকে সেক্রেটারি জেনারেল করে প্রথম নির্বাহী পরিষদ গঠন করা হয়। পরে বিভিন্ন সময়ে আতাউর রহমান, মামুনুর রশীদ, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ, সারা যাকের ফেডারেশনের চেয়ারম্যান এবং লিয়াকত আলী লাকী, এস.এম সোলায়মান, দেবপ্রসাদ দেবনাথ সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কেন্দ্রীয় ও নির্বাহী পরিষদের স্থায়িত্বকাল দুবছর।
নাটক শুধু বিনোদন নয়, সামাজিক কর্মকান্ডেরও অংশ এ নীতিতে আস্থাশীল যেসব নাট্যদল বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নাট্যচর্চায় নিয়োজিত রয়েছে, সেসব দল নির্ধারিত ফরমে আবেদন করে নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনের ভিত্তিতে ফেডারেশনের সদস্য হতে পারে। প্রত্যেক অঙ্গদলকে নির্ধারিত হারে প্রবেশ ফি ও বার্ষিক চাঁদা প্রদান করতে হয়।
ফেডারেশনের নিয়মিত কার্যক্রমের মধ্যে রয়েছে নাট্যবিষয়ক কর্মশালা, সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, নাট্যোৎসব আয়োজন, মে দিবস পালন, বিজয় উৎসব উদ্যাপন, গুণী নাট্যজনদের সম্বর্ধনা প্রদান, দেশব্যাপী নাট্যবিষয়ক উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা ও তাতে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি। এছাড়া জন্মলগ্ন থেকেই ফেডারেশন সাধারণ মানুষের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উন্নয়ন, দেশব্যাপী একটি সুষ্ঠু নাট্য সংস্কৃতির ধারা প্রবর্তনের পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে আসছে। ১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে ফেডারেশন পথনাটক, মিছিল, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে জনগণের সচেতনতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও ফেডারেশনভুক্ত নাট্যকর্মীরা বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে আসছেন। অভিনয় নিয়ন্ত্রণ আইন বাতিলের ক্ষেত্রে ফেডারেশন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
ফেডারেশন ‘সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট’ গঠন করে তার কর্মকান্ডকে সম্প্রসারিত করেছে। প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে সাংস্কৃতিক জোট আয়োজিত বিজয় দিবস উদ্যাপন অনুষ্ঠানমালায় মঞ্চনাটক প্রদর্শন ছাড়াও অন্যান্য সাংগঠনিক কর্মকান্ডে একযোগে কাজ করে আসছে। ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আই.টি.আই) বাংলাদেশ কেন্দ্র প্রতিবছর ফেডারেশনের সহযোগিতায় ‘বিশ্ব নাট্য দিবস’ উদ্যাপন করে। এ উপলক্ষে ফেডারেশনের সদস্য দলগুলির নাট্যকর্মীরা বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা, প্রীতি সম্মেলন, বিশ্ব নাট্যদিবস বক্তৃতামালা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদির আয়োজন করে। অঙ্গনাট্যদলগুলিও দেশব্যাপী এই দিবসটি স্বস্ব স্থানে পালন করে।
ফেডারেশন নাট্যশিল্পীদের অভিনয়দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ঢাকা ও বিভাগীয় পর্যায়ে বিভিন্ন কর্মশালার আয়োজন করে। এসব বিষয়ে ব্রিটিশ কাউন্সিল, জার্মান সাংস্কৃতিক কেন্দ্রসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও যৌথভাবে কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করে। মুক্তিযুদ্ধের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী ‘জাতীয় নাট্যোৎসব-১৯৯১’ আয়োজন করে। ১৯৯১ সালের ৩০ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯২ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অনুষ্ঠিত এই জাতীয় নাট্যোৎসবে সমগ্র দেশ থেকে ফেডারেশনের ৩০টি সদস্য-নাট্যদল স্বস্ব প্রযোজনা নিয়ে শিল্পকলা একাডেমী মঞ্চে নাটক প্রদর্শন করে। এতে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামেরও ব্যবস্থা ছিল। অনুরূপভাবে ফেডারেশন মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৯৯৫ সালের ১৭ নভেম্বর থেকে মাসব্যাপী ‘ঢাকা নাট্যোৎসব-১৯৯৫’ আয়োজন করে। এই নাট্যোৎসবে সেগুন বাগিচাস্থ কচি-কাঁচা মিলনায়তনে ফেডারেশনের ৩৩টি সদস্য-নাট্যদল নাটক মঞ্চস্থ করে। ২৪-৩০ ডিসেম্বর ১৯৯৬ স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী উপলক্ষে বর্ষব্যাপী অনুষ্ঠানমালার সমাপনী অনুষ্ঠান হিসেবে ফেডারেশন সপ্তাহব্যাপী নাট্যোৎসব পালন করে। ঢাকা মহানগরীর ৭টি নাট্যদল এই উৎসবে যোগ দেয়।
১৯৯৩ সালে ফেডারেশন আয়োজন করে নাট্যরচনাবিষয়ক কর্মশালা। ৮ ও ৯ জুন ১৯৯৫ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের ত্রয়োদশ সম্মেলন। ১৯৯৫-এর ২৭ নভেম্বর পূর্ণ হয় বাংলা মঞ্চনাটকের ২০০ বছর। ওই দিন ঢাকাস্থ রাশিয়ান কালচারাল সেন্টারে ফেডারেশনের উদ্যোগে ‘বাংলার মঞ্চনাটকের ইতিহাসে লেবেদেফের অবদান পুনর্মূল্যায়ন’ শীর্ষক একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হয় এবং লেবেদেফ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়।
১৯৯৫ সালের ২৯ নভেম্বর ফেডারেশনের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো ‘গ্রুপ থিয়েটার দিবস’ পালিত হয়। এ উপলক্ষে নাট্যকর্মীদের আনন্দ-মিছিল, মুক্ত আলোচনা, প্রীতি সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থানে সদস্য নাট্যদলগুলি দিবসটি একইভাবে উদ্যাপন করে। ১-৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের পাদদেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের ২৫ বছর’ শীর্ষক ‘পথনাট্য উৎসব-১৯৯৬’ অনুষ্ঠিত হয়। ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদ যৌথভাবে এ উৎসবের আয়োজন করে। এতে বিভিন্ন স্থান থেকে আগত মোট ১০টি নাট্যদল নাটক প্রদর্শন করে। ১৯৯৮ সালের ৫-৮ ফেব্রুয়ারি একই স্থানে ‘একাদশ জাতীয় পথনাট্য উৎসব-১৯৯৮’ অনুষ্ঠিত হয়। চার দিনব্যাপী এ উৎসবে ঢাকার বাইরের ৪টি দলসহ ঢাকা মহানগরীর ১৭টি দল নাটক প্রদর্শন করে।
১৯৯৭ সালের ৯ মে বরিশালের অশ্বিনীকুমার হলে অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের চতুর্দশ বার্ষিক জাতীয় সম্মেলন। সম্মেলনে দিনভর অনুষ্ঠানমালায় ছিল শোভাযাত্রা, আলোচনা, প্রতিনিধি সম্মেলন ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমী যৌথভাবে আয়োজন করে দ্বিতীয় ‘জাতীয় নাট্যোৎসব-১৯৯৮’। এতে শিল্পকলা, মহিলা সমিতি এবং গাইড হাউজ মঞ্চে ঢাকাসহ দেশের ৫৩টি নাট্যদল (ঢাকার ২৭টি এবং অন্যান্য জেলার ২৬টি) নিজ নিজ প্রযোজনা মঞ্চস্থ করে। ১৯৯৯ সালের ৩-৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত হয় ফেডারেশনের ‘পঞ্চম জাতীয় সম্মেলন’। এ সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য দিক ছিল শোভাযাত্রা, কাউন্সিল অধিবেশন, নাটক প্রদর্শন, নির্বাচন, গুণিজন সম্বর্ধনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদি। এ সম্মেলনে বিশিষ্ট নাট্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা, নিষ্ঠা, ত্যাগ ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন পদক ১৯৯৭’ প্রদান করা হয়। গ্রুপ থিয়েটার নামে ফেডারেশনের একটি ত্রৈমাসিক পত্রিকা আছে। [জিল্লুর রহমান জন]