বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের পশ্চাৎপদ অর্থনীতির অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল রাজনৈতিক বৈষম্য এবং কৃষির উপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতা। এ প্রেক্ষাপটে শিল্পোন্নয়নের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীল হওয়ার লক্ষ্যে তৎকালীন যুক্তফ্রন্ট সরকারের শ্রম, বাণিজ্য ও শিল্পমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান প্রাদেশিক আইন পরিষদে East Pakistan Small and Cottage Industries Corporation (EPSIC) Act. XVII of 1957 উত্থাপন করেন। যা আইন হিসেবে পাশ হয় ঐ বছরের ১৪ মার্চ এবং কার্যকর হয় একই বছরের ৩০ মে। তৎকালীন EPSIC-এর উত্তরসূরী বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন যা রাষ্ট্রপতির Order No. 156 (2nd Amendment) মাধ্যমে পাশ হয় ১৯৭২ সালে। অক্টোবর ১৯৭৩ সালে সরকারি নোটিফিকেশন নং ২৮ এর মাধ্যমে বিসিককে Bangladesh Small Industries Corporation (BSIC) এবং Bangladesh Cottage Industries Corporation (BCIC) দুটি ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১৯৭৫ সালে সরকারি নোটিফিকেশনের মাধ্যমে উল্লেখিত করপোরেশন ২টি একত্রিত করে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন নামে নতুন একটি করপোরেশনের সৃষ্টি হয়। ঐ সময় এই করপোরেশন থেকে হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সিল্ক ইন্ডাস্ট্রিজ কে পৃথক করে বাংলাদেশ হ্যান্ডলুম বোর্ড এবং বাংলাদেশ সেরিকালচার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড গঠন করা হয়। বর্তমান বিসিক বেসরকারি খাতে ক্ষুদ্র, কুটির ও গ্রামীণ শিল্প খাতের উন্নয়ন ও বিকাশের দায়িত্বে নিয়োজিত সরকারি মুখ্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। একই সাথে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতের পোষক কর্তৃপক্ষ হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছে।
বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) সরকারি আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত এবং সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা প্রচারিত একটি সংবিধিবদ্ধ করপোরেশন। এ কর্পোরেশনের সাধারণ নির্দেশনা ও প্রশাসন-এর কার্যাবলী সরকার গঠিত একটি পরিচালনা বোর্ডের উপর ন্যস্ত। চেয়ারম্যান এ বোর্ডের নির্বাহী প্রধান। অন্যান্য পরিচালকবৃন্দ বিভিন্ন বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। বিভাগগুলি হলো: উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিভাগ; পরিকল্পনা উন্নয়ন ও গবেষণা বিভাগ; প্রকল্প বাস্তবায়ন এবং ব্যবস্থাপনা বিভাগ; অর্থ বিভাগ; নকশা, বিপণন ও হোল্ডিং কোম্পানি বিভাগ এবং প্রযুক্তি বিভাগ।
এই করপোরেশনে পরিচালকবৃন্দ ও সচিব স্ব-বেতনে সরকার কর্তৃক প্রেষণে নিয়োজিত। কর্পোরেশনে বিভিন্ন গ্রেডে ২০২৯টি রাজস্বখাতভুক্ত পদ রয়েছে। এছাড়া রাজস্বখাত বহির্ভূত বেশ কিছু প্রকল্পাধীন পদ রয়েছে। দেশের ৪টি বিভাগে ৪টি আঞ্চলিক কার্যালয়, ৬৪টি জেলায় ৬৪টি শিল্পসহায়ক কেন্দ্র, ১টি ইলেকট্রনিং কমপ্লেক্সসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭৪টি শিল্পনগরী, মানবসম্পদ উন্নয়নে ১৫টি নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্র, ও ১টি ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং ১টি নকশা কেন্দ্র রয়েছে।
১৯৫৭ সালে জন্মলগ্নে বিসিক কাঁচামাল ও যন্ত্রপাতি আমদানি এবং সেগুলি বেসরকারি উদ্যোক্তাদের মাঝে বিতরণের মত বাণিজ্যিক কর্মকান্ড পরিচালনা করতো। এই সময় বিসিক ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোক্তাদের দেশীয় মুদ্রায় স্বল্প পরিমাণ ঋণও বিতরণ করতো। বিসিকের কাজ ছিল বস্ত্তত এ দেশে শিল্পায়নের একটি প্রাথমিকভিত্তি গড়ে তোলা। সে প্রেক্ষিতে নিজসত তহবিল থেকে এবং ব্যাংকের সাথে কনসোর্টিয়াম গঠনের মাধ্যমে উদ্যোক্তাদেরকে ঋণদান, শিল্প পণ্যের নকশা ও নমুনা সরবরাহ, দক্ষতা উন্নয়ন, শিল্পনগরী স্থাপন করে প্লট বরাদ্দ, লবণ উৎপাদনে চাষীদেরকে প্রশিক্ষণ ও কারিগরি ইত্যাদি সহায়তা প্রদান। যেগুলি এখনও নানা আদলে অব্যাহত রয়েছে। পরবর্তীকালে এ সবের সাথে যুক্ত হওয়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কর্মকান্ডের মধ্যে রয়েছে বিশেষায়িত শিল্প নগরী স্থাপন। শিল্প-কাঁচামাল আমদানি ও সততন্ত্র ঋণ কর্মসূচি গ্রহণ, ব্যাপক পরিসরে উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও ট্রেডভিত্তিক দক্ষতা উন্নয়ন, দেশব্যাপী মেলা ও প্রদর্শনীর আয়োজন, আঞ্চলিক চাহিদা ও সম্ভাবনাভিত্তিক বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি।
বিসিকের বিভিন্ন কর্মকান্ডের মধ্যে শিল্পনগরী স্থাপন কর্মসূচি উনিশ শতকের ষাটের দশক থেকেই শিল্পায়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। ১৯৬০ সাল থেকে এপ্রিল ২০০৯ পর্যন্ত সারাদেশে ৭৪টি বাস্তবায়িত শিল্পনগরীতে ইতোমধ্যে ৩৩৫২টি শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। এ সব কারখানগুলিতে বছরে ২,৪৬,৮৩০ কোটি টাকার পণ্যসামগ্রী উৎপাদিত হয়েছে। যার মধ্যে রপ্তানিযোগ্য পণ্য প্রায় ১,৩৩,২৪০ কোটি, যার ভ্যাট ও ট্যাক্সযোগ্য টাকা ১৭৮০ কোটি। শিল্প নগরীগুলিতে প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান হয়েছে ৩.৪২ লক্ষ জনের। এছাড়া শিল্প স্থাপনের ফলে Tartiary অর্থনৈতিক প্রভাব হিসেবে ব্যবসা-বাণিজ্য, নির্মাণ ও পরিবহণ খাত বিস্তৃত হয়েছে এবং এতে পরোক্ষভাবেও বহুলোকের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
বিসিকের সহায়তায় লবণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশে ইতোমধ্যে সতয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনে সক্ষম হয়েছে। ২০০৯-২০১০ অর্থ বছরের লবণের চাহিদা ১৩.৩৩ লক্ষ মেট্রিক টনের বিপরীতে দেশে ১৭.০৭ লক্ষ মেট্রিক টন উৎপাদিত হয়েছে। অপরদিকে আয়োডিন অভাবজনিত রোগব্যাধি মোকাবেলায় ইউনিসেফ-এর সহায়তায় বিসিক দেশের ২৬৭টি লবণ মিলে ইতোমধ্যে আয়োডিন সংমিশ্রণ প্ল্যান্ট (এসআইপি) স্থাপন করেছে। এর ফলশ্রুতিতে আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করে আয়োডিন ঘাটতির পরিমাণ ১৯৯৩ সালের ৬৯ শতাংশ থেকে ২০০৫ সালে ৩৩.৮০ শতাংশে নেমে এসেছে। বর্তমান দেশের ৮৪% পরিবার আয়োডিনযুক্ত লবণ ব্যবহার করছে।
সতাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে বিসিক কর্তৃক নতুন নতুন কর্মসূচি অন্তর্ভুক্ত হয়। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পখাতে বিসিক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এগুলি হলো শিল্প উদ্যোক্তা উন্নয়ন ও দক্ষতা উন্নয়ন বিষয়ক প্রশিক্ষণ, সাব-কন্ট্রাক্ট্রিং পদ্ধতিতে ক্ষুদ্র ও বৃহৎ শিল্পের মধ্যে অগ্র ও পশ্চাৎ সংযোগ স্থাপন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো অর্থ বিনিয়োগের ব্যবস্থাকরণ, আধা-নিবিড় প্রক্রিয়ায় চিংড়ি চাষ, বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ-চাষ ও শিল্পদ্যোক্তা উন্নয়ন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বিভিন্ন ঋণদান কর্মসূচি ইত্যাদি।
বিসিকের ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট (স্কিটি), ১৫টি নৈপুণ্য বিকাশ কেন্দ্র, ঢাকাস্থ বিসিকের নকশা কেন্দ্র এবং বিসিকের জেলা শিল্প সহায়ক কেন্দ্র প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প খাতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির লক্ষ্যে বিভিন্ন ট্রেডে এ পর্যন্ত ৪.৬২ লক্ষ জনকে দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রদান করেছে। অপরদিকে ১৯৯১ সাল থেকে এ পর্যন্ত ৩২টি সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বৃহৎ, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের সাথে সংযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে সমঝোতা সতাক্ষরের মাধ্যমে সাব-কন্ট্রাক্ট্রিং ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকার বিপণন সুবিধা সৃষ্টির মাধ্যমে আমদানি বিকল্প পণ্য ও সেবার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিসিকের নিয়মিত কর্মকান্ডের পাশাপাশি ১৯৭৪ সাল থেকে বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এগুলির মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের দুঃস্থ অধিবাসীদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্প উল্লেখযোগ্য। এ সকল প্রকল্পের মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে ২২.০০০ যুবকযুবতীকে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ২০৫০০ জনের। বিসিক এর সহযোগিতায় প্রায় ৭৬,০০০টি ক্ষুদ্র ও ৬,২৫,০০০টি কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় যেখানে প্রায় ৩২.২৮ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়ছে। [মাসুদ রেজা]