বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)  বিজ্ঞান ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের আওতায় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করা এই সংস্থার মুখ্য দায়িত্ব। ১৯৯০ সালে জাতীয় সংসদে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল বিল গৃহীত হওয়ার পরপরই দেশের কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক সর্বোচ্চ নীতি-নির্ধারণী সংস্থাটির কার্যক্রম শুরু হয়। বিসিসি গঠনের বেশ আগে ১৯৮৩ সালে বাংলাদেশ কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ও যথাযথ প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় নীতি নির্ধারণ এবং কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে জাতীয় কম্পিউটার কমিটি (এনসিসি) গঠিত হয়েছিল। ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত এই কমিটি কার্যকর ছিল। এরপর এনসিসি অবলুপ্ত করে জাতীয় কম্পিউটার বোর্ড (এনসিবি) গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে এনসিবিকে পুনর্গঠন করার মাধ্যমে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের কার্যক্রম শুরু হয়।

বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল ভবন

১১ সদস্যবিশিষ্ট একটি কাউন্সিল কমিটির তত্ত্বাবধানে সংস্থাটির কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বিজ্ঞান, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী এ কমিটির চেয়ারম্যান, উক্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব ভাইস চেয়ারম্যান এবং বিসিসির কার্যনির্বাহী পরিচালক এর সদস্যসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া কমিটিতে থাকেন ৮ থেকে ১০ জন সদস্য। সংস্থাটির নির্বাহী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কার্যনির্বাহী পরিচালকের নেতৃত্বে মোট ১৭০০ জন কর্মকর্তা ও কর্মচারী কর্মরত রয়েছেন।

বিসিসির লক্ষ্যসমূহ হচ্ছে দ্রুত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটাতে কম্পিউটার ও তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও প্রয়োগের বিকাশ ঘটানো, কম্পিউটার শিক্ষা ও পরিকল্পনাসহ তথ্যপ্রযুক্তির প্রয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা, সরকারের তথ্যপ্রযুক্তির চাহিদা নিরূপণ করা এবং সরকারি প্রতিষ্ঠনসমূহের জন্য সংগৃহীতব্য কম্পিউটার ও সংশিষ্ট যন্ত্রপাতির মান ও স্পেসিফিকেশন চূড়ান্ত করা। বিসিসি সরকারি প্রতিষ্ঠান ও অন্যান্য সংস্থাগুলিকে আধুনিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণাগার ও গ্রন্থাগার স্থাপনে সহযোগিতা দিয়ে থাকে। এছাড়া এ সকল প্রতিষ্ঠানকে কম্পিউটারের প্রয়োগ ও তথ্যপ্রযুক্তি ভিত্তিক কর্মকান্ড বিষয়ে পরামর্শও দিয়ে থাকে। ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০৭-০৮ মেয়াদে বিসিসি প্রায় ৬৬১টি প্রতিষ্ঠানকে কম্পিউটারাইজ করার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সহায়তা এবং উপদেশ সেবা দিয়েছে। সেবাগ্রহীতা সংস্থার মধ্যে রয়েছে অনেকগুলি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ, সরকারের অধিদপ্তর ও প্রকল্প, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষায়তন, ব্যাংক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান। সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অসংখ্য কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অনেক শিক্ষক এবং বেসরকারি অংশগ্রহণকারীরা বিসিসি থেকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ পেয়ে নিজেদের সুদক্ষ করে তুলেছেন।

বিসিসি সরকার এবং অন্যান্য সংগঠনের প্রদত্ত অনুদানে পারচালিত হয়ে থাকে। ঢাকায় বিসিসির সদর দপ্তর অবস্থিত। এছাড়া রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, সিলেট ও ফরিদপুরে বিসিসির কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এ সব কেন্দ্রে নারী ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালিত হয়। বিসিসি-র অন্যান্য প্রশিক্ষণ কোর্সসমূহ হচ্ছে কম্পিউটার হার্ডওয়ার, মেইনটেন্যান্স ও ট্রাবলশুটিং, ওরাকল-এইট্টি ওয়ান উইথ ডেভেলপার টু থাউজেন্ড ফর ডাটাবেজ ডেভেলপমেন্ট, প্রোগ্রামিং ইন সি/সি++, অ্যাপলিকেশন ডেভেলপমেন্ট ইউজিং ভিজ্যুয়াল বেসিক, জাভা প্রোগ্রামিং, কম্পিউটার এইডেড ডিজাইন ইউজিং অটোক্যাড, মাল্টি মিডিয়া সিস্টেম ডেভেলপমেন্ট, ই-কমার্স এবং ও ওয়েবপেজ ডিজাইন।

বিসিসি ১১টি বিশেষ সার্টিফিকেট কোর্স পরিচালনা করে। এর মধ্যে রয়েছে মৌলিক অফিস প্যাকেজ; কম্পিউটার হার্ডওয়ার মেইনটেন্যান্স ও ট্রাবলসুটিং; ই-গভর্ন্যান্স; ডাটাবেজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম; কম্পিউটার নেটওয়ার্কিং; প্রোগ্রামিং; মাল্টিমিডিয়া; ওয়েবসাইট ডিজাইন ও ওয়েব এ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি। এ ছাড়া এখানে সকল বিষয়ে এক বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা এবং স্নাতকোত্তর ডিপ্লোমা কোর্স চালু রয়েছে। ১৯৯০-৯১ থেকে ২০০৭-০৮ পর্যন্ত বিসিসি ১৫০৭৭ জন প্রশিক্ষার্থীকে এ সকল বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এর মধ্যে মহিলা ছিলেন ৩,১৩৫ জন। ২০০৭ সালে কোরিয়া সরকারের সহযোগিতায় বিসিসি ’বাংলাদেশ-কোরিয়া ইন্সটিটিউট অব ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি’ স্থাপন করে। ফলে ক্রমশ প্রশিক্ষণার্থীদের সংখ্যা এবং প্রশিক্ষণের মান বৃদ্ধি পেতে থাকে।

দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে কম্পিউটার শিক্ষা প্রবর্তনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহের লক্ষ্যে বিসিসি এ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০০০ পর্যন্ত এসকল প্রকল্পের আওতায় বিসিসি ৩৪৬টি মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মোট ৩৯৬টি কম্পিউটার প্রদান করেছে এবং ২০০ জন মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। জুলাই ২০০১ থেকে জুন ২০০৩ মেয়াদে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সহায়তায় ৮০ লক্ষ টাকা ব্যয়ে বিসিসি এক হাজার মাধ্যমিক স্কুলে কম্পিউটার ল্যাব স্থাপনের একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত অন্যান্য প্রকল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ‘ডেভেলপমেন্ট অব ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফর আইটি এ্যাপ্লিকেশন প্রজেক্ট (১৯৯৮-২০০৮)’, গাজীপুরের কালিয়াকৈরে ‘সাপোর্ট ফর ডেভেলপমেন্ট অব পাবলিক সেক্টর ইউজ অব আইসিটি আন্ডার দি ইকনোমিক ম্যানেজমেন্ট টেকনিক্যাল এ্যাসিন্ট্যাস প্রজেক্ট (২০০৬-২০০৯)’ এবং ৬৪ জেলার ১২৮টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ কর্মসূচী বাস্তবায়ন প্রকল্প (২০০৯-২০১০)। বিসিসি’র নতুন গৃহীত প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে খুলনার একটি ‘আইটি ভিলেজ’ স্থাপন এবং ন্যাশনাল ইনফ্রা নেটওয়ার্ক প্রজেক্ট ফর বাংলাদেশ (বাংলা গভ-নেট)। নিয়মিত কার্যক্রম এবং প্রকল্প সেবার আওতায় অধিকতর সংখ্যক সরকারী, আধা-সরকারী ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, এনজিও, ব্যাংক ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষতা অর্জন করে চলেছে। বিসিসি ইতোমধ্যে ইউনিকোড কমপ্লায়েন্ট (ভার্সন ৪.১), বাংলা কী-বোর্ডের লে-আউট ড্রাইভার, ফন্ট, কনভার্টারসহ বিবিধ কম্পিউটার সামগ্রী উদ্ভাবন ও উৎপাদন করেছে। এব ফলে দেশে কম্পিউটার ও আইটি ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে এবং আইটি ভিত্তিক রপ্তানি বাণিজ্য সম্প্রসারিত হয়েছে।  [মাহবুবুল আলম]