বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মার্কসীয় কমিউনিস্ট মতবাদ ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল। এটি নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির উত্তরাধিকারী সংগঠন। প্রথমে দলটি গঠিত হয় বিদেশের মাটিতে। ১৯২০ সালের ১৭ই অক্টোবরে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নের তাশখন্দে। প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন ভারতীয় বিপ্লবী এম এন রায়। পরবর্তীতে তা বাতিল হয়ে গেলে ১৯২৫ সালের ২৬ ডিসেম্বর কানপুরে অনুষ্ঠিত জাতীয়তাবাদী বিপ্লবীদের এক সম্মেলনে নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টি পুনরায় গঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি নির্বাচিত হন মাদ্রাজের সিঙ্গার ভেলু চেট্টিয়ার এবং সম্পাদক হন এস.ভি ঘাটে ও জি.পি বাগরহাট্টা।

নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টি জন্মলগ্ন থেকেই ভারতে ব্রিটিশ সরকারের দমন নীতির শিকার হয়। এই দল বেশির ভাগ সময়েই গোপনে এবং প্রায়শ নতুন নতুন অঙ্গ সংগঠন গড়ে তুলে এদের মাধ্যমে দলের কর্মকান্ড পরিচালনা করেছে। এসব অঙ্গ সংগঠনের মধ্যে ছিল ওয়ার্কার্স অ্যান্ড পিজেন্টস পার্টি (১৯২৫), প্রোগ্রেসিভ রাইটার্স অর্গানাইজেশন (১৯৩৬), নিখিল ভারত কিষাণ সভা (১৯৩৬) ও নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন (১৯৩৬)। ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ফলত নেতৃবৃন্দ পার্টির কর্মীদের ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দেন। অবশ্য ১৯৪২ সালে এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়।

কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৩৯ সালে বোম্বাইতে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে যুদ্ধবিরোধী ধর্মঘট সংগঠিত করে। এই ধর্মঘটে ৯০ হাজার শ্রমিক অংশ নেয়। বিশ শতকের চল্লিশের দশকে এই পার্টি সমগ্র ভারতে শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করে। ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালে দলীয় নেতৃত্বে সংগঠিত হয় তেভাগা আন্দোলন, নানকার আন্দোলন, টঙ্ক আন্দোলন, তেলেঙ্গনা আন্দোলন, কেরালায় পুন্নাপা ভায়ালা আন্দোলন ও কায়ুর আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক কৃষক আন্দোলন। ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে বাংলা থেকে দলের ১৩ জন প্রার্থীর মধ্যে ৩ জন বিজয়ী হন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয় এবং এতদুদ্দেশ্যে ঢাকায় ৭ সদস্যের একটি আঞ্চলিক কমিটি গঠন করা হয় (১৯৪৭)। ১৯৪৮ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেসে পূর্ববঙ্গ ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত কাউন্সিলররা ৬ মার্চ পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন। সাজ্জাদ জহিরকে সাধারণ সম্পাদক করে কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। একই দিনে পূর্ববঙ্গের কাউন্সিলরগণ ১৯ সদস্যের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হন খোকা রায়।

১৯৪৯-৫০ সালে মুসলিম লীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টির বিরুদ্ধে অবিরাম দমনমূলক ব্যবস্থা চালাতে থাকে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের খাপড়া ওয়ার্ডে কমিউনিস্ট বন্দিদের উপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে ৭ জন নেতা নিহত এবং ৩১ জন গুরুতর আহত হন। ১৯৫০ সালে রমেন মিত্র ও ইলা মিত্রের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক সাঁওতাল বিদ্রোহনাচোল বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে রাওয়ালপিন্ডি ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে এবং পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাদ জহির সহ কয়েকজন নেতা বিচারে কারাদন্ডে দন্ডিত হন। ফলত, পশ্চিম পাকিস্তানে পার্টির কর্মকান্ড প্রায় অচল হয়ে পড়ে। পূর্ববঙ্গে পার্টির নেতৃবৃন্দ সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পৃথক কর্মসূচি গ্রহণ করেন।

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সংগঠনে পূর্ব বাংলায় কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি যুক্তফ্রন্টকে সমর্থন দেয়। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে পার্টি কর্তৃক মনোনীত ৭ জন প্রার্থীর মধ্যে ৪ জন নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে ৯২-ক ধারা জারি এবং প্রদেশে গভর্নরের শাসন চালু হলে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। পার্টির কর্মীরা প্রথমে আওয়ামী মুসলিম লীগের এবং পরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (১৯৫৭) ছত্রছায়ায় তাদের কর্মকান্ড অব্যাহত রাখে। নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মীদের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানের সামরিক সরকার সুপরিকল্পিত নিগ্রহমূলক ব্যবস্থা নেয়। পার্টির কিছু নেতা আইয়ুব খানের গোটা শাসনামলে (১৯৫৮-৬৯) কারান্তরালে থাকেন।

চীন-সোভিয়েত দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টিতে অভ্যন্তরীণ মতানৈক্য দেখা দিলে ১৯৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে কমিউনিস্ট পার্টি ভাঙ্গনের শিকার হয়। ফলত পার্টি মণি সিংহের নেতৃত্বে মস্কোপন্থী গ্রুপ এবং মোহাম্মদ তোয়াহার নেতৃত্বে চীনপন্থী গ্রুপ এই দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কমিউনিস্ট পার্টি (‘মস্কোপন্থী’ অংশ) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচিকে (১৯৬৬) পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল।

১৯৬৮ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত পার্টির চতুর্থ সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে একটি স্বতন্ত্র কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় এবং একেই পরবর্তীতে ”বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম কংগ্রেস” হিসাবে বিবেচনা করা হয় । বারীন দত্ত (আবদুস সালাম) দলের সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থানে কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। ১৯৭১ সালের গণজাগরণ ও অসহযোগ আন্দোলনেও পার্টির সক্রিয় ভূমিকা ছিল।

‘পূর্ব পাকিস্তানের’ কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ও কর্মিগণ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। পার্টির সভাপতি কমরেড মণি সিংহ প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ছিলেন। কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের সরাসরি পরিচালনায় একটি বিশেষ গেরিলা বাহিনী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্টির নতুন নামকরণ হয় বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) এবং পার্টি তার ইতিহাসে এই প্রথম প্রকাশ্যে ও নির্বিঘেœ দলীয় কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ লাভ করে। বিপ্লবী ধারায় শ্রমিক সংগঠন ও শ্রমিক আন্দোলন সংগঠিত করার লক্ষ্যে কমিউনিস্ট পার্টি ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে। দেশে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য ১৯৭৩ সালের ১৪ অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ও ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফফর) সমন্বয়ে গণঐক্যজোট গঠন করা হয়। সিপিবি থেকে ৩ জন সদস্য সহ ১৯ সদস্যবিশিষ্ট জোট-কমিটি গঠিত হয়। ১৯৭৩ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে দলের একটি নতুন গঠনতন্ত্র গৃহীত হয়। কংগ্রেসে মণি সিংহকে সভাপতি ও মোহাম্মদ ফরহাদকে সাধারণ সম্পাদক করে ২৬ সদস্যের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি নির্বাচিত হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকা-ের পর পার্টির নেতা ও কর্মীরা সরকারের কঠোর নিপীড়নের শিকার হন। পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃবর্গ এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা গ্রেফতার হন। অনেকের বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি হয় (১৯৭৬) এবং ১৯৭৭ সালের অক্টোবর মাসে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়। অবশ্য ১৯৭৮ সালে পার্টির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং পার্টির নেতা ও কর্মীদের মুক্তি দেয়া হয়। সিপিবি ১৯৭৮ সালের সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ঐক্যফ্রন্টের সদস্য হিসেবে এই দল জেনারেল এম.এ.জি ওসমানীকে সক্রিয় সমর্থন দিয়েছিল।

সিপিবি ১৯৮৩ সালে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গঠিত ১৫ দলীয় জোটে যোগ দেয়। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কমিউনিস্ট পার্টি ৫টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৯০ সালে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সিপিবি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

সোভিয়েত ইউনিয়নসহ পূর্ব-ইউরোপে সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের ফলে ১৯৯১ সালে সিপিবি এক কঠিন সংকটের মুখোমুখি হয়। পার্টির নেতৃবৃন্দ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েন। এক পক্ষ পার্টির বিলোপ সাধন করে তদস্থলে গণতান্ত্রিক ধারার একটি নতুন দল গঠনের পক্ষে সোচ্চার হয় এবং অপর পক্ষ পার্টিকে মূলধারায় টিকিয়ে রাখার পক্ষে অনড় থাকে। ১৯৯৩ সালে পরস্পরবিরোধী দুই গ্রুপ কর্তৃক ঢাকায় পৃথকভাবে সম্মেলনের আয়োজন করলে এই দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। মার্কসবাদী-লেলিনবাদী গ্রুপ ১৫ জুন (১৯৯৩) অনুষ্ঠিত তাদের সম্মেলনে বাংলাদেশে কমিউনিস্ট পার্টির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এ সম্মেলনে শহীদুল্লাহ চৌধুরীকে সভাপতি এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিমকে সাধারণ সম্পাদক করে নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়।

১৯৯৫ সালের ৭-৮ এপ্রিল ঢাকায় অনুষ্ঠিত পার্টির কংগ্রেসে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্যে ১৭-দফা কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিপিবি মনোনীত মোট ৩৫ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কমিউনিস্ট পার্টি ১৯৯৮ সালে দলের ৫০ বছর পূর্তির সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করে।

১৯৯৯ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সপ্তম কংগ্রেস এবং ২০০৩ সালে অষ্টম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। ২০০৮ সালের ৭-৯ আগস্ট অনুষ্ঠিত নবম কংগ্রেসে পার্টির নতুন কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটি গঠিত হয়। মনজুরুল আহসান খান সভাপতি এবং মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কমিটির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পরবর্তীতে ধারাবাহিকভাবে চার বছর পর পর সিপিবি আরো চারটি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত করে। সর্বশেষ ২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ কংগ্রেসে গৃহীত ঘোষণা ও কর্মসূচি-তে লক্ষ্য হিসাবে বলা হয়েছে, ‘সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে বিপ্লবী পরিবর্তন করুন’। আর রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হয়েছে- ‘দুই জোটের বাইরে (আওয়মী লীগ ও বিএনপি নেতৃত্বাধীন দুই রাজনৈতিক জোট) বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প গড়ে তুলুন, কমিউনিস্ট পার্টিকে শক্তিশালী করুন’।

কমিউনিস্ট পার্টি ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকে বরাবরই প্রাধান্য দিয়ে থাকে। পাশাপাশি বর্তমানে লুটেরা বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির জোট দুইটির বাইরে বিকল্প শক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তির সমন্বয়ে সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য পার্টি কাজ করে যাচ্ছে। সকল গণতান্ত্রিক সংগ্রামে কমিউনিস্ট পার্টি সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। [এম.এম আকাশ]