বস্ত্রশিল্প

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১৩:৩৮, ২৬ মে ২০২৩ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ
(পরিবর্তন) ← পূর্বের সংস্করণ | সর্বশেষ সংস্করণ (পরিবর্তন) | পরবর্তী সংস্করণ → (পরিবর্তন)

বস্ত্রশিল্প বাংলার বিদ্যুৎ-চালিত আধুনিক বস্ত্রশিল্পের ইতিহাসের শুরু বিশ শতকের সূচনালগ্ন থেকে। ১৯৪৭-এর পূর্বে আধুনিক বস্ত্রশিল্প ছিল সুতা তৈরি ও বয়নের সুবিধাদিসহ নানা উপাদানে গঠিত যৌগিক বস্ত্র কারখানা। পরে এতে যুক্ত হয় বিশেষায়িত বস্ত্রবয়ন, সেলাই কাজ ও হোসিয়ারি শিল্প, রঞ্জন, মুদ্রণ ও ফিনিশিং। ১৯৪৭-এ দেশ ভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে ১১ লক্ষ টাকু ও ২৭ হাজার তাঁতসহ ১১টি যৌগিক বস্ত্র কারখানা ছিল। ১৯৫৬ সালে টাকুর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৩২ লাখে, কিন্তু ১৯৭২-এ পুরানো টাকুগুলি বিকল হয়ে যাওয়ায় এর সংখ্যা ৮০ হাজারে নেমে যায়। ১৯৭২ সালে বস্ত্রকলসহ সকল বৃহদায়তন উৎপাদন শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। ১৯৮২ সালের পরে, রাষ্ট্রায়ত্ত বয়ন কারখানাগুলি ক্রমশ বিরাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। ১৯৯৯-এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ৪০ হাজার টাকুর তুলনায় ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পে ২৪ লাখ টাকু সংস্থাপন করা হয়। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে সরকারি খাতে ২১টি কারখানায় ২৫ হাজারের মতো টাকু টিকে আছে; অন্যদিকে বেসরকারি খাতের ৩০১টি কারখানায় টাকুর সংখ্যা ৬০ লাখেরও বেশি।

২০২০ সালে বেসরকারি খাতে মিলসমূহে টাকু ছিল ১ কোটি ৪০ লক্ষ এবং (রোটর এর সংখ্যা ছিল ২ লক্ষ ৪০ হাজার। বর্তমানে সরকারি খাতে ২৫টি বস্ত্রকল রয়েছে এবং এসবের মধ্যে প্রতিটিতে ২৫০০০ এর বেশি টাকু আছে এমন মিল ১১টি এবং এর চেয়ে কম টাকু আছে এমন মিল ১৪টি। এসব সরকারি বস্ত্রমিলের ৮টি চালু রয়েছে এবং এগুলোর সবকটি পরিচালনার জন্য বেসরকরি খাতে ইজারা দেয়া হয়েছে অবশিষ্ট ১৭টি সরকারি বস্ত্রকল বন্ধ রয়েছে। সরকার ২টি বস্ত্রকল নিয়ে একটি বস্ত্রপল্লী গঠনের পরিকল্পনা করছে, যেসব বস্ত্রকল বন্ধ রয়েছে সেগুলো বেসরকারি খাতে হস্তান্তর করে লাভজনক ভাবে পরিচালনার কথা ভাবছে।

এক দশক আগে পর্যন্ত বাংলাদেশের অধিকাংশ বয়ন কারখানা নিম্নমানের সুতা তৈরি করতো। তৈরি পোশাক শিল্প-এর প্রয়োজন মেটানোর জন্য উন্নত মানের সূক্ষ্ম সুতা এবং পলিস্টার তুলা মিশ্রিত সুতা তৈরির সামর্থ্য ছিল অত্যন্ত সীমিত। কিন্তু তৈরি পোশাক শিল্পের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিশেষ করে বেসরকারিখাতে বয়নশিল্পের বিকাশে এ পরিস্থিতি এখন অনেকটাই বদলে গেছে। ১৯৯৯ সালে ১১২ মিলিয়ন কেজি সুতার উৎপাদন দেশের মোট সুতার প্রয়োজনের মাত্র ২২% ভাগ মেটাতে পেরেছিল। ২০১১ সাল নাগাদ বার্ষিক সুতার উৎপাদন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১,৩৪০ মিলিয়ন কেজি, যা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৯০ শতাংশ এবং রপ্তানিযোগ্য পোশাকখাতেরও বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম। বয়ন শাখায় উৎপাদিত তন্তুর মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন আদলের তুলট সুতা, পলিস্টার, সিনথেটিক সুতা, পশমি সুতা এবং তুলা ও পলিস্টার মিশ্রিত সুতা। এইসব সুতা বিভিন্ন সেলাই শিল্পে, যেমন বিশেষায়িত বস্ত্রশিল্প, তাঁতশিল্প এবং বুনন ও হোসিয়ারি শিল্পে ব্যবহৃত হচ্ছে। ১৯৪৭-৫৬ বছরগুলিতে বয়ন কারখানার তাঁতের প্রবৃদ্ধি হার ছিল শ্লথ (২% বাৎসরিক); কিন্তু ১৯৫৭-৭২ বছরগুলিতে এই হার কিছুটা বৃদ্ধি পায় (বাৎসরিক ৪.৬%)। বয়ন কারখানার মতো ৬৮ হাজার তাঁতবিশিষ্ট যৌগিক সেলাই শিল্প কারখানাও ১৯৭২-এ রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ১৯৮৩-তে রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানাগুলিকে বিরাষ্ট্রীয়করণের ব্যবস্থা নেওয়া পর্যন্ত তাঁতের সংখ্যা কমবেশি একই রকম ছিল। অপ্রচলিত পুরানো তাঁতগুলি অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় তাঁতের সংখ্যা ১৯৮৩ সনের ৬৩ হাজার থেকে ১৯৯৯-এ ৩৯ হাজারে নেমে যায়। ২০১১ সালে সরকারের মালিকানাধীন বস্ত্রকারখানা কমে দাঁড়ায় মাত্র ২০টিতে। এর মধ্যে ১৭টি কারখানার ২১টি ইউনিট চালু ছিল, যেগুলিতে ৩২/১ থেকে ৮০/১ কাউন্টের সুতা উৎপাদন হয়। এ সময় ৩টি নতুন কারখানা চালুর প্রক্রিয়া চলছিল। এসব কারখানায় মোট মাকুর সংখ্যা ৪ লাখ ৯০ হাজারেরও বেশি। তাঁতের সংখ্যা ১ হাজারের কিছু বেশি।

বাংলাদেশের আধুনিক বয়ন শিল্পে উৎপন্ন দ্রব্যগুলি হলো শাড়ি, ধুতি, লুঙ্গি, ব্লাউজ, শার্টের কাপড়, ড্রিল, লংক্লথ, পপলিন, সালু, গ্রে মার্কিন ইত্যাদি সুতি কাপড়। উৎপাদনের নিম্নমানের কারণে এক দশক আগেও এ শিল্পের অবস্থা ছিল করুণ। ১৯৯৯ সালে ২ কোটি ৫০ লক্ষ মিটার বস্ত্র উৎপাদন অভ্যন্তরীণ চাহিদার ১% ভাগও মেটাতে পারে নি। কিন্তু একুশ শতকের প্রথম দশকে বেসরকারিখাতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে দিয়েছে। ২০১১ সালে এসে প্রাথমিক বস্ত্রখাত মোট রপ্তানি চাহিদার ৫১ ভাগের মতো পুরণ করতে সক্ষম হয়েছে।

১০ থেকে ৫০টি তাঁতের কারখানা সম্বলিত বিশেষায়িত বস্ত্রশিল্প উপশাখা আরম্ভ হয়েছিল ১৯৭০-এর দশকের মধ্যভাগে। এই খাতে ১৯৭৬-এ ১৫.৬ মিলিয়ন মিটার বার্ষিক বস্ত্র উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন ৮ হাজার তাঁত ছিল। ১৯৮৩-তে এ জাতীয় তাঁতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১,৫০০। ১৯৮৩-৮৯ বছরগুলিতে এই খাতের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা কমে যায়। ২০২০ সালে এই খাতের তাঁতের সংখ্যা ৬০,০০০ এ উন্নীত হয় এবং কাপড় তৈরির পরিমাণও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি বেড়েছে। তৈরি সুতার উৎপাদন এসময় ৩২৭০ মিলিয়ন কেজিতে উন্নীত হয় যা দিয়ে নীট ফ্যাব্রিকস এর চাহিদা ৯০ শতাংশ এবং ওভেন ফ্যাব্রিকস এর চাহিদা ৩৫-৪০% পরিমাণ দেশীয়ভাবে মেটানো সম্ভব হয়। এই উপশাখায় উৎপন্ন বস্ত্রের মধ্যে বেশির ভাগ সুতি, পলিস্টার এবং সুতি পলিস্টার মিশ্রিত কাপড়। প্রধান উৎপাদিত বস্ত্র হচ্ছে নাইলন শাড়ি, গৃহে ব্যবহার্য লিনেন, পর্দার কাপড়, শার্টের কাপড়, স্যুটের কাপড়, মশারি, মখমল, ঝোলানো পর্দার কাপড়। ১৯৫২-তে ৩,০০০টি কল এবং ১৯৭৬-এ ১,৫৬২টি কলসহ বুনন ও হোসিয়ারি শিল্প-প্রতিষ্ঠানগুলি অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়েছিল। কেবল ১৯৮০-এর পরে এই শাখার উৎপন্ন দ্রব্যগুলি রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়। অভ্যন্তরীণ বাজারে যন্ত্র-সামর্থ্যের সন্তোষজনক বাৎসরিক বৃদ্ধি (১৯৭৬-৮৩ বৎসরগুলিতে প্রায় ৫.৩% ভাগ) পরবর্তীকালে ধরে রাখা যায় নি এবং ১৯৮৩-৯৯ সময়কালে তা ছিল মাত্র ২.১% ভাগ। ২০২০-২১ সালে সার্কুলার নিটিং মেশিনের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৩৮৪ এবং নিট বস্ত্র উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩৬৯০ মিলিয়ন মিটার। এই সময়ে রপ্তানি চাহিদা মেটাতে ১,৩৯০টি সার্কুলার নিটিং মেশিন নতুনভাবে যুক্ত করা হয়। এই শাখার প্রধান প্রধান উৎপন্ন দ্রব্য ছিল জামা, আন্ডারওয়্যার, টি-শার্ট, পোলো শার্ট, মেয়েদের অন্তর্বাস, মোজা, গলাবন্ধ ও সোয়েটার। তবে এরপর থেকে মূলত বেসরকারি খাতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশে পরিস্থিতি ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করেছে।

১৯৫৬-৭৬ সময়কালে যৌগিক কারখানাগুলিতে আধুনিক রঞ্জন সুবিধাদি সীমিত ছিল এবং হস্তচালিত তাঁতশিল্পে সনাতন পদ্ধতিতে হাত দিয়ে রঞ্জনকাজ চলত। ১৯৭৬-এর পরে বেসরকারি খাতে স্বয়ংক্রিয় ও অর্ধ স্বয়ংক্রিয় রঞ্জন, মুদ্রণ ও ফিনিশিং সুবিধাদি সংস্থাপিত হয়। ১৯৭৬-৮৩ সময়ে অর্ধ স্বয়ংক্রিয় রঞ্জন ও ফিনিশিং যন্ত্রের বার্ষিক বৃদ্ধি ছিল ১৭.৪% এবং ১৯৮৩-৯৯ সময়ে কেবল ১.৯%। ঐ দুটি সময়সীমায় স্বয়ংক্রিয় রঞ্জন ও ফিনিশিং যন্ত্রের প্রবৃদ্ধি ছিল যথাক্রমে ৬.৩% ও ৭.৭%। ২০১১ সালে ৩১০টি ডায়িং প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানায় উৎপাদন ক্ষমতা দাঁড়ায় ২৮০ কোটি মিটার। এর বাইরে ২৮০০ নিটিং বা বুনন কারখানাতেও ডায়িং এর কাজ হয়। যার মধ্যে ২ হাজার কারখানা স্থানীয় বাজারের চাহিদা মেটায় এবং ৮০০ কারখানা রপ্তানিমুখী। এসব কারাখানার উৎপাদন ক্ষমতা ৪১০কোটি মিটার। হস্তচালিত তাঁতশিল্পে এখনও হাত দিয়ে রং করার প্রচলন রয়েছে। ২০১৯-২০ সালে রঞ্জন, মুদ্রন ও ফিনিশিং মিলের সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি হয়, ফলে এই খাতে উৎপাদন ক্ষমতা ৪০০ কোটি মিটারে উন্নীত হয়।

১৯৭৭-এ বাংলাদেশ তৈরি পোশাক শিল্প রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করে। গত দুই দশকে তৈরি পোশাকের রপ্তানি অতি দ্রুতহারে বেড়েছে। কিন্তু প্রসারণশীল রপ্তানি বাজারের জন্য তৈরি পোশাক শিল্পকে এক দশক আগেও প্রয়োজনীয় ৮৫ ভাগ বস্ত্র ও ৪০ ভাগ সুতা আমদানির ওপর নির্ভর করতে হতো। তবে বস্ত্র শিল্পের বিকাশের কারণে প্রাথমিক বস্ত্রখাত মোট রপ্তানিতে অবদান রাখে ৫১ ভাগের মতো। ২০১১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে সেলাই করা তৈরি পোশাক বা ওভেন পোশাকের ৪০ ভাগ চাহিদা মেটায় স্থানীয় বস্ত্রখাত। আর বুনন করা পোশাক বা নিট পোশাকের ৯৫ ভাগের বেশি চাহিদা মেটায় স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত সুতা ও কাপড়। সরকারি বেসরকারি বস্ত্র কারখানায় বার্ষিক সুতা উৎপাদন হয় ১৩৪ কোটি কেজি। যা স্থানীয় বাজারে সুতা ও কাপড়ের ৯০ শতাংশ চাহিদা পূরণ করে। রপ্তানি খাতেরও বেশিরভাগ চাহিদা পূরণ করে।

তবে এ প্রবৃদ্ধির বেশির ভাগই হয়েছে বেসরকারি খাতে। ২০১১ সালে দেশের বস্ত্রকারখানাগুলির ৬১ লাখ টাকুর মধ্যে ৬০ লাখই ছিল বেসরকারি খাতে। বড় মাপের ৪২০টি বেসরকারি কারখানায় ২৫ হাজারের বেশি যান্ত্রিক তাঁত রয়েছে। এগুলির উৎপাদন ক্ষমতা ১৪০ কোটি মিটার কাপড়। বেসরকারি খাতের বিশেষায়িত বস্ত্র কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৬৫, এবং এগুলিতে রয়েছে প্রায় ২৩ হাজার যান্ত্রিক তাঁত। এসব কারখানায় উৎপাদিত হয় ৩০ কোটি মিটার কাপড়। বেসরকারি খাতে হাতে চালিত ছোট তাঁত কলের মোট সংখ্যা ১ লাখ ৪৮ হাজারের বেশি। যাতে তাঁতের সংখ্যা ৪ লাখ ৯৮ হাজারের মতো। এসব হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদন হয় ৮৭ কোটি মিটার কাপড়। ২০২০ সালে দেশের ছোট-বড় মোট ৮২৮ টি বস্ত্রকল বছরে মোট ৪১০০ মিলিয়ন মিটার ওভেন কাপড় উৎপাদন করে। তবে এসব হস্তচালিত তাঁতে উৎপাদন কিছুটা কমে যায়।

তৈরি পোশাক প্রধান রপ্তানি পণ্য এবং দেশের মোট রপ্তানির ৭৭ শতাংশ হওয়ায় গত দুই দশকে সুতা ও কাপড়ের চাহিদা ব্যাপক হারে বেড়েছে। এই বড় চাহিদা সামাল দিতে বস্ত্রশিল্পের বিকাশ হয়েছে মূলত বেসরকারি খাতে। ২০১১ সালে বেসরকারি খাতে ১২৬৬টি কারখানা বস্ত্র শিল্পের মাধ্যমে মূলত তৈরি পোশাক খাতকে সমর্থনের পাশাপাশি স্থানীয় বাজারের পোশাকের ৯০ ভাগ চাহিদা মেটাতে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এসব কারখানার মধ্যে সুতা উৎপাদন ও কাপড় বুননের সাথে জড়িত কারখানার সংখ্যাই বেশি। বেসরকারি বস্ত্র কারখানাগুলির সংগঠন বিটিএমএর ২০১১ সালের হিসাব অনুসারে দেশে ব্যক্তিমালিকানাধীন সুতা উৎপাদনকারী কারখানার সংখ্যা ৩৬১টি। সুতা থেকে কাপড় উৎপাদন করে এমন কারখানার সংখ্যা ৬৮২টি, আর সুতা বা কাপড় রঙ করা ও প্রিন্ট করার কাজ করে এমন ডায়িং, প্রিন্টিং ও ফিনিশিং কারখানার সংখ্যা ৩১০টি। যার মধ্যে পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত ১৩০টি। আর অর্ধ-যন্ত্রচালিত কারখানার সংখ্যা ১৮০। সব মিলে ডায়িং ও প্রিন্টিং হয় ২৮০ কোটি মিটার কাপড়।

বাংলাদেশে মাসিক নিম্নমজুরি হার এবং বস্ত্রকল স্থাপনের উপযোগী অবকাঠামো তৈরিতে তুলনামূলকভাবে কম খরচের জন্য এই বিশেষ খাতে বিনিয়োগ আকর্ষণীয়। পক্ষান্তরে হংকং, কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, তাইওয়ানে মূলধন ও শ্রমের ব্যয় দ্রুতহারে বেড়ে চলেছে। বস্ত্র খাতে বিদেশি বিনিয়োগকে বিশেষ সুযোগ-সুবিধা ও অনুমোদন দান করে সরকার বাংলাদেশে বেসরকারি বিনিয়োগকে উৎসাহ দিয়ে থাকে। এসব সুবিধার মধ্যে আছে: ক. উন্নত, কম উন্নত, একেবারে কম উন্নত এবং বিশেষ শিল্প-বাণিজ্যিক এলাকায় স্থাপিত শিল্পে যথাক্রমে পাঁচ, সাত, নয় ও বারো বছর কর অবকাশ; খ. বিনিয়োগ প্রযুক্তির মূল্যমান ও পারিশ্রমিকের ওপর কর মওকুফ; গ. বিদেশি ঋণের সুদের ওপর কর মওকুফ; ঘ. মূলধনি লাভের ওপর কর মওকুফ; ঙ. দ্বৈত করারোপ পরিহার; চ. বিদেশি প্রযুক্তিবিদের জন্য তিন বছর পর্যন্ত আয়কর মওকুফ; ছ. বাংলাদেশে কর্মরত বিদেশির বেতনের ৫০% ভাগ পর্যন্ত অর্থ নিজ দেশে প্রেরণের সুবিধা; জ. বিনিয়োগকৃত মূলধন, লাভ ও লভ্যাংশ বিদেশে প্রেরণের সুবিধা; এবং ঝ. প্রেরণযোগ্য লভ্যাংশের পুনর্বিনিয়োগকে নতুন বিদেশি বিনিয়োগ রূপে গণ্য করা।

বাংলাদেশ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য এবং এর তৈরি পোশাক শিল্পের বিভিন্ন দ্রব্যের রপ্তানি প্রধান প্রধান উন্নত দেশ কর্তৃক প্রদত্ত সর্বাধিক সুবিধাদানের নীতি দ্বারা উপকৃত হচ্ছে। বাংলাদেশ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের জেনারেলাইজড সিস্টেম অব প্রেফারেন্স জিএসপি-এর একটি অনুগ্রহপুষ্ট অংশীদার। দেশটি বস্ত্রশিল্প ও পোশাক বিষয়ক উরুগুয়ে সম্মেলন চুক্তিতে স্বাক্ষরদানকারী। এছাড়াও বাংলাদেশ বস্ত্রশিল্প ও পোশাকের বাণিজ্য বিষয়ে কানাডা, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক মাল্টিফাইবার চুক্তি (গঋঅ) সম্পাদন করেছে।

২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি আয়ে যে ৪.১ ভাগ প্রবৃদ্ধি ঘটেছে তাতে ৭৭ ভাগের বেশি অবদান ছিলো তৈরি পোশাকের। ১৬২০ কোটি ডলারের রপ্তানির মধ্যে ১২৪৯ ডলারই ছিলো তৈরি পোশাক। নিট পোশাক রপ্তানি হয় ৬৪৮ কোটি ডলার আর ওভেন পোশাক ৬০১ কোটি ডলারের। এর বাইরে হোম টেক্সটাইল ৩৫ কোটি ডলার, টেরি টাওয়েল ১৫ কোটি, স্পেশাল ওভেন কাপড় ৯ কোটি ডলারের। এর প্রত্যেকটি পণ্যের সাথে দেশে উৎপাদিত বস্ত্র ও সুতা জড়িত। সে সময়ে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে উচ্চতর প্রবৃদ্ধি এসেছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে জিএসপি সুবিধায় নতুন নিয়ম, চীন ভিয়েতনাম সহ প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে মজুরি বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিতে এই উচ্চ হারের প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ২০১১ সালের মে মাস পর্যন্ত মোট রপ্তানি হয়েছে ২ হাজার ৫৩ কোটি ডলার। রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি এসেছে ৪১ ভাগেরও বেশি। নিটপণ্যের রপ্তানি বেড়েছে ৪৬ ভাগ আর ওভেন পোশাক রপ্তানি ৩৯ ভাগের মতো। প্রধান এই দুই খাতের রপ্তানির পরিমাণ যথাক্রমে ৮৪৪ কোটি ও ৭৫১ কোটি ডলার। হোম টেক্সটাইলের রপ্তানি বেড়েছে ৯৭ ভাগ।

২০১৯-২০ অর্থ বছরে বস্ত্রখাত মোট ৩ হাজার ৩৭ কোটি মার্কিন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করে। সে বছর বিশেষায়িত পোশাক (টেরি ও বিশেষ জাতীয় নীট ও ওভেন পোশাক) রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রায় ১০৬ কোটি ডলার আয় করে এবং হোম টেক্সটাইল রপ্তানি থেকে আয় করে আরও প্রায় ৭৬ কোট ডলার। ২০২০-২১ সালে কোভিড-১৯ প্যানডেমিকের কারণে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৮.৫ শতাংশ কমেছে। [শামসুদ্দিন আহমদ এবং সানাউল হক]