বসু, স্বদেশ
বসু, স্বদেশ (১৯২৮-২০০৯) অর্থনীতি বিশেষজ্ঞ, বাম রাজনীতিক। পুরো নাম স্বদেশ রঞ্জন বসু। ১৯২৮ সালের ২ জানুয়ারি বরিশাল জেলার কাশিমপুর গ্রামে তাঁর জন্ম। স্বদেশ বসু বরিশাল বিএম কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে আইএ এবং ১৯৫৮ সালে চাখার এ.কে ফজলুল হক কলেজ থেকে বি.এ পাস করেন। তিনি ১৯৬০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন। স্বদেশ বসু ১৯৬২ সালে ফোর্ড ফাউন্ডেশন বৃত্তি নিয়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি কোর্সে ভর্তি হন, কিন্তু রাজনৈতিক কারণে তাঁর ভিসা বাতিল করা হয়। পরবর্তী সময়ে তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দক্ষিণ এশীয় দেশসমূহের মধ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা বিষয়ক গবেষণার উপর পিএইচ.ডি ডিগ্রি লাভ করেন।
স্বদেশ বসু বিএম কলেজে অধ্যয়নকালে ১৯৪৪ সালে ছাত্র রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হোন এবং স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির ছাত্রফ্রন্টের বরিশাল শাখার সদস্য ছিলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের সূচনা পর্বে তিনি বরিশালে ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করেন। ঐ বছর ১০ মার্চ ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে ম্যানিফেস্টো প্রকাশের অভিযোগে তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত কারাভোগ করেন। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ নেতা নুরুল আমিনের বরিশাল আগমনকালে বিক্ষোভ প্রদর্শনের অপরাধে তিনি গ্রেফতার হন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফন্ট্রের নির্বাচনের পর জেল থেকে ছাড়া পান স্বদেশ বসু। তিন মাস পর দেশে ৯২ (ক) ধারা জারি হলে পুনরায় তিনি গ্রেফতার হন।
১৯৫৬ সালের শেষদিকে তিনি জেল থেকে ছাড়া পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালে তাঁর উপর সরকারের সার্বক্ষণিক গোয়েন্দা নজরদারি বজায় ছিল এবং তাঁকে প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে লালবাগ থানায় হাজিরা দিতে হতো।
স্বদেশ বসু ১৯৬১ সালে করাচিতে পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকসে (পিআইডিই) যোগদান করেন। ১৯৬৬ সালের ছয়দফা আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এবং পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট ইকোনমিকস-এর মুখপাত্র হিসেবে পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে তাঁর বক্তব্য তুলে ধরেন। ১৯৭১ সালে মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের পরিকল্পনা সেলের সদস্য হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কাঠামোর রূপরেখা প্রণয়নের লক্ষ্যে মুজিবনগর সরকার কর্তৃক গঠিত পরিকল্পনা সেলে স্বদেশ বসু অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। এছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সম্ভাব্য খাদ্য সমস্যা এবং খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রণয়ন করেন।
স্বাধীনতার পর স্বদেশ বসু বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) প্রথম ডিরেক্টর জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৩ সালে তিনি কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশনের সদস্য মনোনীত হন। ১৯৭৪ সালে তিনি বিশ্বব্যাংকে যোগ দেন এবং নববইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত কর্মরত থাকেন। বিশ্বব্যাংকে দায়িত্ব পালনকালে আফ্রিকার অধিবাসীদের দারিদ্র সম্পর্কে গবেষণা করে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। তাঁর বেশ কিছু গবেষণামূলক প্রবন্ধ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
২০০৯ সালের ৩ ডিসেম্বর ঢাকায় তাঁর মৃত্যু হয়।
অর্থনীতিতে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল স্বদেশ বসুকে (মরণোত্তর) সম্মাননা স্বর্ণপদক প্রদান করে। [ঊর্মি হোসেন]