বসু, সুভাষচন্দ্র
বসু, সুভাষচন্দ্র (১৮৯৭-১৯৪৫) কংগ্রেস দলের বামপন্থী নেতা, ফরওয়ার্ড ব্লক এর প্রতিষ্ঠাতা ও ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সর্বাধিনায়ক। সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন জানকীনাথ বসু ও প্রভাবতী দেবীর চৌদ্দ সন্তানের মধ্যে নবম। জানকীনাথ বসু পশ্চিমবঙ্গের চবিবশ পরগনা জেলার কোদালিয়া গ্রাম পরিত্যাগ করে কটকে গিয়ে বাস করতে থাকেন এবং সেখানেই ২৩ জানুয়ারি ১৮৯৭-এ সুভাষচন্দ্রের জন্ম হয়। কটকেই তিনি বড় হন এবং ম্যাধমিক স্তর পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে তাঁর উচ্চশিক্ষা শুরু হয়। তবে জনৈক ইউরোপীয় শিক্ষকের সাথে কথিত অসদাচরণের জন্য তাঁকে ঐ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করা হয়। এরপর তিনি কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই ডিস্টিংকশনসহ দর্শনশাস্ত্রে অনার্স ডিগ্রি লাভ করেন। আই.সি.এস পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য তিনি ১৯১৯ সালে ইংল্যান্ড যান এবং সাফল্যের সাথে কাঙ্ক্ষিত ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগদান করেন। কিন্তু অনতিবিলম্বে তিনি তাঁর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেন। তিনি সিভিল সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে চিত্তরঞ্জন দাশএর নেতৃত্বে ভারতের জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে যোগ দেন।
১৯২৪ সালে সুভাষ বসুকে কলকাতা কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। ঐ বছরই জঙ্গি জাতীয়তাবাদীদের সাথে ঘনিষ্ঠতার জন্য তাঁকে কারারুদ্ধ করা হয়। স্বাস্থ্যগত কারণে তাঁকে ১৯২৭ সালে মুক্তি দেওয়া হয়। এরপর তিনি বাংলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হন। ১৯২৮ সালে কলকাতায় কংগ্রেস দলের ঐতিহাসিক সম্মেলনে সুভাষ কংগ্রেস স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান (Commanding Officer) হিসেবে কাজ করেন। ঐ একই অধিবেশনে সুভাষ ও জওহরলাল নেহরু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার উদ্যোগে নেতৃত্ব দেন। অন্যদিকে, মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী ও মতিলাল নেহরু ভারতের ডোমিনিয়ন মর্যাদার অনুকূলে মত প্রকাশ করেন। ১৯২৯-এ সুভাষ ছিলেন বাংলা প্রাদেশিক কংগ্রেস সম্মেলনের সভাপতি। তিনি ঐ একই বছর নিখিল ভারত ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের সভাপতি ও পরের বছর কলকাতা কর্পোরেশন-এর মেয়র হন।
১৯৩০ সালে তিনি অত্যন্ত সক্রিয়ভাবে গান্ধীর লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন এবং এ জন্য তাঁকে আবার কারারুদ্ধ করা হয়। জেল থেকে মুক্তি লাভের পর তিনি ১৯৩১-এর গান্ধী-আরউইন চুক্তির বিরোধিতা করেন। ১৮১৮ সালের কুখ্যাত ১১১ প্রবিধানের (Regulation 111 of 1818) আওতায় তিনি তৃতীয়বারের মতো গ্রেপ্তার হন। কারাগারে তাঁর স্বাস্থ্যের এমন অবনতি ঘটে যে স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি মুক্তি লাভ করেন এবং চিকিৎসার জন্য ইউরোপ যান। ইউরোপে থাকাকালে ভারতের ব্যাপারে সহানুভূতি রয়েছে ইউরোপের এমন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ঘটে।
১৯৩৮ সালে সুভাষ সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন। পরের বছর তিনি ঐ একই পদে পুনঃনির্বাচিত হন। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তাঁর জঙ্গি অবস্থানের কারণে অচিরেই তাঁকে কংগ্রেসের মূল নেতৃত্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। স্বয়ং গান্ধী তাঁর বিরুদ্ধে চলে যান। এ পরিস্থিতিতে ১৯৩৯ সালের এপ্রিলে তিনি কংগ্রেস সভাপতি পদে ইস্তফা দেন। তাঁর রাজনৈতিক মতাদর্শ প্রচার ও জোরদার করার জন্য তিনি ঐ একই বছর কংগ্রেসের ভেতরেই ফরওয়ার্ড ব্লক প্রতিষ্ঠা করে সাধারণভাবে সারা ভারতে এবং বিশেষ করে বাংলায় বিপ্লবী শক্তিগুলিকে সুসংহত করতে প্রয়াসী হন।
সুভাষ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে (১৯৩৯-১৯৪৫) অক্ষশক্তিকে সমর্থন করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের পর সাতটি প্রদেশে কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠনের সমালোচনা করলে কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি সুভাষের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। তিনি ফরওয়ার্ড ব্লক ও কিষাণ সভার যুক্ত উদ্যোগে ১৯৪০ সালের মার্চে বিহারের রামগড়ে এক আপোসবিরোধী সম্মেলনের আয়োজন করেন। ১৯৪০ সালের জুন মাসে নিখিল ভারত ফরওয়ার্ড ব্লকের নাগপুর অধিবেশনে তাঁর নেতৃত্বে ভারতে অস্থায়ী জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি উত্থাপন করা হয়। ১৯৪০ সালের জুলাই মাসে সুভাষচন্দ্র বসুকে কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্ট অপসারণ আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়। কারাবন্দি থাকাকালে তিনি অনশন ধর্মঘট শুরু করেন এবং ডিসেম্বর মাসে তাঁকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৪১ সালের ২৬ জানুয়ারি সুভাষ গোপনে কলকাতা ত্যাগ করেন ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ দিয়ে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে কাবুল হয়ে রাশিয়ায় প্রবেশ করেন। রাশিয়া থেকে বার্লিনে পৌঁছানোর পর তিনি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন সংগঠনের জন্য জার্মানির সমর্থন লাভ করেন। তিনি ভারতের জন্য অস্থায়ী স্বাধীন সরকার গঠন করেন এবং বার্লিন থেকে নিয়মিত বেতার সম্প্রচারের মাধ্যমে তাঁর ধ্যানধারণা প্রচার করতে থাকেন। তিনি জার্মানি থেকে জাপানের সঙ্গেও যোগাযোগ স্থাপন করেন। জার্মানি ও জাপান সরকারের সমর্থন লাভ করে সুভাষ সিঙ্গাপুর অভিমুখে জলপথে একটি সাবমেরিনে তাঁর যাত্রা শুরু করেন এবং ১৯৪৩ সালের ২ জুলাই সেখানে পৌঁছেন। জাপানিদের হাতে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিরা সিঙ্গাপুরে তাঁর উপস্থিতিতে বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা প্রকাশ করে। ইতোমধ্যে জাপানে অবস্থানরত অন্যতম ভারতীয় বিপ্লবী রাসবিহারী বসু পূর্ব এশিয়ায় ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলন সংগঠিত করেন। তিনি আজাদ হিন্দ ফৌজ (Indian National Army) গঠন করেন। রাসবিহারী বসু আনুষ্ঠানিকভাবে আজাদ হিন্দ ফৌজের দায়িত্বভার সুভাষ বসুকে অর্পণ করেন। ১৯৪৩ সালের ২৫ আগস্ট সুভাষ আই.এন.এ-র (INA) সর্বাধিনায়ক হন এবং ঐ একই বছর ২১ অক্টোবর অস্থায়ী আজাদ হিন্দ সরকার গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ১৯৪৪ সালের জানুয়ারি মাসে তিনি রেঙ্গুনে আইএনএ-র সদরদপ্তর স্থানান্তর করেন। তিনি রেঙ্গুন থেকে ভারত-বার্মা সীমান্তে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করেন এবং ভারতের দিকে অগ্রসর হন। ১৯৪৪-এর মার্চ মাসে তিনি তাঁর এ অগ্রাভিযানে ইম্ফল ও কোহিমায় দুটি ব্রিটিশ সামরিক চৌকি দখল করেন ও সেখানে স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন করেন। ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে ফরমোজায় এক বিমান দুর্ঘটনায় সুভাষ নিহত হন বলা হয়ে থাকে। [চিত্তরঞ্জন মিশ্র]