বলাকী শাহ
বলাকী শাহ সাবেক বাখরগঞ্জ জেলা সলিমাবাদ পরগনার বখারী মৌজার একজন সুফি। তিনি ১৭৯২ সালের ব্রিটিশবিরোধী কৃষক আন্দোলনের সংগঠক। আঠারো শতকের শেষ দশকে বাংলার উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য ছিল উপনিবেশিক শাসন অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্যে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত স্থানীয় আন্দোলন। এ আন্দোলনগুলি স্থানীয় অবস্থার প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত হলেও এর প্রত্যেকটির মূলে কিছু সামাজিক, ধর্মীয় ও অর্থনৈতিক অসন্তোষ সক্রিয় ছিল।
বলাকী শাহের প্রায় এক হাজার সশস্ত্র অনুসারী ছিল। তারা এত শক্তিশালী ছিল যে, স্থানীয় জমিদারদের পাইকগণ ভয়ে তাদের সম্মুখীন হতে সাহস করত না। বলাকী শাহ সুবানিয়াতে দুর্গ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং শাহ সুজার সুজাবাদ দুর্গ সংস্কার করে ব্যবহারোপযোগী করে তোলেন।
দীউয়ানি লাভের পর ১৭৬৫ থেকে ১৭৯৩ পর্যন্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভূমিরাজস্ব ব্যবস্থায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালায়, যার ফলে বাংলার মানুষ অবর্ণনীয় দুর্গতির শিকার হয়। এ থেকে বাখরগঞ্জও বাদ পড়ে নি। ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষজনিত দুঃখ-দুর্দশা এবং ১৭৮৭ সালের প্রলয়ঙ্করী ঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস বাখরগঞ্জবাসীদের অবস্থা আরও শোচনীয় করে তোলে। এ অবস্থার মধ্যে জমিদার ও তাদের গোমস্তাদের অত্যাচার ও অন্যায় দাবি রায়তদের করুণ অবস্থা বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়। উদ্ভূত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে বলাকী শাহ বাখরগঞ্জের কৃষকদের সংঘবদ্ধ করেন এবং ১৭৯২ সালের কৃষক বিদ্রোহ ঘটান।
বলাকী শাহের কার্যক্রমের দ্বিবিধ উদ্দেশ্য ছিল। একদিকে তিনি বাখরগঞ্জ থেকে ইংরেজ শক্তি উৎখাতের প্রচেষ্টা চালান, অন্যদিকে রায়তদের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কর্মকান্ড পরিচালনা করেন। এ সকল উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের নিরিখে তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সম্ভবত নিজ গুরু জনৈক জিওনকে সুলতান হিসেবে ক্ষমতায় বসান। যুদ্ধ করার জন্য প্রস্ত্তত এমন হাজার হাজার সশস্ত্র লোক জোগাড়ের পর তিনি ঘোষণা দেন যে, ফিরিঙ্গি রাজত্ব শেষ হয়ে গেছে। এছাড়া তিনি সলিমাবাদ, নাজিরপুর ও চন্দ্রদ্বীপ পরগনার জমিদারদের ব্রিটিশ আনুগত্য পরিহার, কর প্রদান বন্ধ এবং তাঁর নেতৃত্ব গ্রহণ করতে বাধ্য করেন।
রায়তদের সুবিধার্থে বলাকী শাহ ভূমিকর নির্দিষ্ট করেন এবং প্রচলিত কর ব্যাপকভাবে কমিয়ে দেন। তিনি জমিদারদের প্রতি কানিতে (১২০ শতক) দুই টাকার বেশি কর আরোপ না করার এবং ইতঃপূর্বে তার বেশি কর আদায় হয়ে থাকলে তা অনতিবিলম্বে ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেন। এতে কোন রকমের ব্যতিক্রম ঘটলে তাদেরকে কঠোর শাস্তির ভয় দেখানো হয়।
বলাকী শাহ এবং তাঁর লোকেরা প্রথমদিকে কোম্পানির বরকন্দাজদের হটিয়ে দেন। কোম্পানি পরে অবশ্য ইউরোপীয় কর্মকর্তার অধীনে শক্তিশালী সিপাহী বাহিনী পাঠায়। তাঁরা বলাকী শাহের মাটির দুর্গ ধ্বংস করে এবং বলাকী শাহ বন্দি হন। ঢাকার নিজামত আদালত বিদ্রোহ করা এবং রক্তপাত ঘটানোর জন্য তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে এবং সাত বছরের কারাদন্ড দেয়। [এম দেলওয়ার হোসেন]