বলাকা

বলাকা ১৯১৬ সালে রচিত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গতিচেতনা বিষয়ক কাব্য। কাব্যটি রবীন্দ্র কবি মানসের বিবর্তন ধারাপথে আত্মপ্রকাশ করেছে। প্রাক্বলাকা কাব্যে কবির অনুভূতি আবেগের মধ্যে দিয়ে ব্যক্ত ছিল, কিন্তু বলাকা কাব্যে সেই অনুভূতির প্রকাশ হয়েছে বোধি ও বুদ্ধি, জ্ঞান ও অনুভবে এবং দ্রুতি ও দীপ্তির মাধ্যমে- বিষয়ের সঙ্গে একাত্মতায় ও নতুন চেতনায়। কাব্যটি রচনার পশ্চাতে তিনটি বিষয় কবিকে অনুপ্রাণিত করেছে; ক. কবির ইউরোপ ভ্রমণ, খ. কবির নোবেল পুরস্কার লাভ, গ. সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি ও প্রথম মহাযুদ্ধ। ১১ মে ১৯১২ সালে কবি সম্ভবত: তৃতীয়বারের মতো ইউরোপ যাত্রা করেন। ইংল্যান্ডে চার মাস থেকে গেলেন আমেরিকায়, সেখানকার নিউইয়র্ক, আর্বানা-শেম্পেন, শিকাগো, বোস্টন, কেমব্রিজ প্রভৃতি স্থানের মনীষী, সাধারণ মানুষ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের পন্ডিতদের সংস্পর্শে আসেন। ইউরোপ ও আমেরিকার নবজীবন প্রবাহ, প্রাণশক্তি ও আভ্যন্তরীণ আত্মিক শক্তি এবং আমেরিকাবাসীর বিজ্ঞান-রাষ্ট্র-সমাজচিন্তা তাঁর চিত্ত ও চেতনায় প্রবল আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। ফলে প্রতিভার সঙ্গে কবি মানসে সঞ্চারিত হলো গভীর এক অনুপ্রেরণা। দ্বিতীয়ত নোবেলপ্রাপ্তীর ফলে প্রাচ্য জীবনচেতনার গুরুত্ব ও গৌরব বিশ্বসভায় ও বিশ্বের মনীষীদের কাছে মূল্যায়ন হয়েছে-এই নব উপলব্ধি কবিকে নতুন প্রাণশক্তিতে উদ্বোধিত করেছে। তৃতীয়ত সমকালীন বিশ্বপরিস্থিতি ও প্রথম মহাযুদ্ধ। তাছাড়াও কবি মনে করেন-‘আমরা মানবের এক বৃহৎ যুগসন্ধিতে এসেছি, এক অতীত রাত্রি অবসান প্রায়। মৃত্যু, দুঃখ ও বেদনার মধ্য দিয়ে বৃহৎ নবযুগের রক্তাভ অরুণোদয় আসন্ন। সেজন্য মনের মধ্যে অকারণ উদ্বেগ ছিল।’

আলোচ্য কাব্যে মোট ৪৫টি কবিতা রয়েছে; ১০টি সমপঙক্তিক আর ১টি সনেট আকারবদ্ধ। অবশিষ্ট ৩৪টি বিষম ছন্দে রচিত এবং উক্ত ৩৪টি কবিতার ছন্দকেই ‘বলাকার ছন্দ’ বলা হয়। কাব্যটিতে কবি যেসব বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন-ক. নিসর্গ প্রকৃতি ও বিশ্ব প্রকৃতি এ দুটি রূপকে কবির প্রকৃতিচেতনা প্রকাশিত হয়েছে, খ. ‘চঞ্চলা’ ও ‘বলাকা’ কবিতা দুটিতে কবির বিশ্ব প্রকৃতিগত গতিচেতনার পরিচয় রয়েছে আর কবির নিসর্গ-প্রকৃতি তাঁর বিপ্লব চেতনার পরিপোষকরূপে রয়েছে ঝড়ের খেয়া কবিতা, গ. ৪১ ও ২৬ সংখ্যক কবিতা দুটি খাঁটি নিসর্গ চিত্রের কবিতা; এরমধ্যে ২৬ সংখ্যকটি প্রধান, ঘ. অন্যকোনো ভাবের অনুষঙ্গরূপে বা গতিচেতনা বা জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানিক বিশ্বচেতনার অভিব্যক্তিরূপে এ কাব্যে কবি প্রকৃতিকে অবিমিশ্র নিসর্গ প্রকৃতিরূপে সামান্যই অনুভব করেছেন।

কবির জীবন-চেতনা ভাব থেকে ভাবান্তরে, রূপ থেকে রূপান্তরে প্রতিনিয়তই পরিবর্তনশীল। আলোচ্য কাব্যের প্রত্যেকটি কবিতা আলাদাভাবে এক একটি বিশিষ্ট বক্তব্যকে ধারণ করেছে; কোনো কবিতার মূল বক্তব্য নবীন-বরণ (১ সংখ্যক), কোনোটিতে মহাযুদ্ধের প্রলয়ঙ্কর পূর্বাভাস (২ সংখ্যক), কোনোটি ব্যক্তির প্রেম-প্রেরণার রূপতত্ত্ব (৬ সংখ্যক) আবার কোথাও বা তা সর্বমুক্ত ব্যক্তিসত্তার জন্ম-জন্মান্তরের মধ্য দিয়ে মহাপ্রয়াণের ইঙ্গিতবহ (৭ সংখ্যক), কোথাও বা বিশ্বজাগতিক গতির বন্দনা (৮ সংখ্যক), কোথাও বা রাষ্ট্রীয় পঙ্কমুক্তির জন্য বিপ্লবের আহবান বাণী (৩৭সংখ্যক), কোনো কবিতায় মানুষের প্রতিনিধিরূপে কবির ঈশ্বরের প্রতি প্রেমের অর্ঘ্য প্রদান বা ফেলে আসা যৌবনের স্মৃতিচারণ প্রভৃতি। আপাতদৃষ্টিতে কবিতাগুলি বিচিত্র ও বিচ্ছিন্ন হলেও এমন একটি সামগ্রিক বক্তব্যকে ধারণ করে আছে যার সঙ্গে তুলনা চলে বলাকা পঙক্তির উড়ে চলার ব্যঞ্জনার। কবিতাগুলি বিচ্ছিন্নভাবে এক একটি বলাকা এবং সামগ্রিকভাবে গতিচেতনার বাণী বহনকারী চলমান বলাকা। এ কারণেই এ কাব্যের নামকরণ বলাকা সার্থক হয়েছে। যা শুধু গতির তত্ত্বকেই ব্যক্ত করে না, অপূর্ব সৌন্দর্যকেও প্রকাশ করে। সৌন্দর্যসত্তা ও গতিচেতনা ছাড়া এ গ্রন্থে আছে কবির মৃত্যুচেতনা ও শিল্পদর্শন।

আলোচ্য কাব্যের ভাবধৃত পঙক্তিগুলি সীমার বন্ধন ছিন্ন করে সব রকমের স্থিরতাকে আঘাত করে গতির আনন্দে কখনো দীর্ঘ ধারায় প্রবাহিত, কখনো সংযুক্ত চরণ থেকে সরে গিয়ে স্বাধীন, কোথাও বেগের আবেগে পরবর্তী চরণের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ছন্দ-হিল্লোল সৃষ্টি করেছে। কোনে কোনো চরণ মুক্তির আনন্দে নিজে কেটে গিয়ে দ্বিধাবিভক্ত, আবার একটি বিশেষ আবেগে একটিমাত্র শব্দে একটি নতুন চরণের সৃষ্টি। এরকম অসমমাত্রিক ছন্দই বলাকা কাব্যের বৈশিষ্ট্য। বিচিত্র পঙক্তির সমন্বয়ে রচিত একটি স্তবক-

হে বিরাট নদী,

অদৃশ্য নিঃশব্দ তব জল

অবিচ্ছিন্ন অবিরল

চলে নিরবধি।

স্পন্দনে শিহরে শূন্য তব রুদ্র কায়াহীন বেগে;

বস্ত্তহীন প্রবাহের প্রচন্ড আঘাত লেগে

পুঞ্জ পুঞ্জ বস্ত্তফেনা উঠে জেগে;

আলোকের তীব্রচ্ছটা বিচ্ছুরিয়া উঠে বর্ণস্রোতে

ধাবমান অন্ধকার হতে;

ঘূর্ণাচক্রে ঘুরে ঘুরে মরে

স্তরে স্তরে

সূর্যচন্দ্রতারা যত

বুদবুদের মতো। (৮ সংখ্যক কবিতা)

এছন্দের বৈশিষ্ট্যকে  বোঝাতে গিয়ে কেউ কেউ ছন্দের এরূপ মুক্ত স্বভাবকে নাম দিয়েছেন ‘মুক্তক ছন্দ’ বা ‘মুক্তবন্ধ ছন্দ’। আবার কেউ কেউ এছন্দকে অমিত্রাক্ষর ছন্দেরই রবীন্দ্রনাথকৃত অভিনবরূপ বলে মনে করেন যা অন্ত্যানুপ্রাসযুক্ত। পাশ্চাত্য সাহিত্যে বহুল ব্যবহূত এছন্দকে free verse  বা verse-libre বলে।

এ কাব্যের ভাষা তীক্ষ্ণ, দীপ্ত, শাণিত ও উজ্জ্বল। এ কাব্যের ছন্দের গতিময়তা ও ভাষার সংহতি এবং নবতর বক্তব্যকে রূপ দেওয়ার কারণে এর আঙ্গিক একটি বিশিষ্টরূপ লাভ করেছে। এর আঙ্গিকের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য বৈপরীত্যের মধ্যে দিয়ে বক্তব্যকে তীক্ষ্ণ করে তোলা। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়-রূপহীন মরণেরে মৃত্যুহীন অপরূপ সাজে/ যে মুহূর্তে পূর্ণ তুমি সে মুহূর্তে কিছু তব নাই/ মৃত্যুর অন্তরে পশি অমৃত না পাই যদি খুঁজে প্রভৃতি। বৈজ্ঞানিক-দার্শনিক গতিচেতনা  বিশেষ করে উপনিষদীয় গতিচেতনা এবং তাঁর সঙ্গে পৃথিবীর শোষিত-নিপীড়িত মানবের পক্ষাবলম্বনকারী মানবিক চেতনার সম্মিলনে তাঁর একাব্য গ্রন্থটি বিশিষ্টরূপ লাভ করেছে। [শামীমা আক্তার]