বলরামী

বলরামী একটি লোকসম্প্রদায়। বলাই হাড়ি নামে জনৈক সাধু এ সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠাতা। এটি ‘বলাহাড়ি’ বা ‘বলরাম ভজা’ নামেও পরিচিত। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, বীরভূম, বর্ধমান, কলকাতা প্রভৃতি অঞ্চলে এই সম্প্রদায় এক সময় বিশেষ প্রসিদ্ধি লাভ করে।

আঠারো শতকের শেষদিকে বলাই হাড়ি বর্তমান মেহেরপুর জেলার মালোপাড়ায় এক ঝাড়ুদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম গোবিন্দ হাড়ি এবং মাতার নাম গৌরমণি। ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে ৬৫ বছর বয়সে বলাই হাড়ি মৃত্যুবরণ করেন। বলাই হাড়ি ছিলেন নিরক্ষর। তিনি মেহেরপুর শহরের মল্লিক বাবুদের বাড়িতে চৌকিদারি করতেন। বাবুদের পারিবারিক বিগ্রহ এবং বিগ্রহের নিকট প্রদত্ত স্বর্ণালঙ্কার চুরি যাওয়ায় বলাইকে দায়ী করা হয়। এতে বলাই তীব্র মনঃকষ্টে চাকরি ত্যাগ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। দীর্ঘদিন পরে তিনি মেহেরপুরে প্রত্যাবর্তন করে শিষ্যাদিসহ বলাহাড়ি সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠা করেন।

বলরামী সম্প্রদায় কোনো বিগ্রহ মানে না এবং বিগ্রহের পূজাও করে না। এমনকি তারা জাতিভেদও মানে না। হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের অনেকেই এদের অনুসারী। বলরামীদের নিজস্ব কোনো পোশাকাদি নেই। সংসারত্যাগীরা ভিক্ষাজীবী, কিন্তু ভিক্ষা গ্রহণের সময় কোনো দেব-দেবতার নামোচ্চারণ করে না। তারা চুরি করা ও মিথ্যা বলাকে পাপ বলে মনে করে।

বলরামী সম্প্রদায় দুই শাখায় বিভক্ত। এক শাখা মেহেরপুরের মালোপাড়ায় বলাই হাড়ির মৃত্যুস্থানে সন্ধ্যায় প্রদীপ দেয় ও প্রণাম করে। অপর শাখা এ বিষয়ে বলাই হাড়ির নির্দেশ নেই বিধায় কোনো রীতিনীতি অনুসরণ করে না। তবে বলরামীরা দোল পূর্ণিমায় উৎসবাদি এবং সঙ্গীত পরিবেশন করে বলে এই সম্প্রদায়কে অনেকে বৈষ্ণবধর্মের শাখাবিশেষ মনে করে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে বলরামী সম্প্রদায়বৈষ্ণব মতাদর্শ থেকে ভিন্ন।

বলাই হাড়ির মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী বা সেবাদাসী হিসেবে কথিত ব্রহ্মমালোনী নামে একজন মহিলা বলাই হাড়ির আখড়ার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বলাই হাড়ির অনুসারীরা তাঁকে ‘গুরু মা’ বলে জানে। বলরামীরা মৃত্যুর পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ও শবদাহ করে না, তবে অনেকে মৃতকে কবর দেয়। মেহেরপুরে বলাই হাড়ি ও তাঁর স্ত্রীর কোনো কবর নেই। বলরামী সম্প্রদায়ের বেশ কিছু নিজস্ব গান  আছে। শিষ্যদের নিকট গানগুলি সাধনার অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত।  [আনোয়ারুল করীম]