বন ও বনবিজ্ঞান

Mukbil (আলোচনা | অবদান) কর্তৃক ১০:৫৪, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ তারিখে সংশোধিত সংস্করণ

বন ও বনবিজ্ঞান (Forest and Forestry)  পর্যাপ্ত জীবাশ্ম তথ্য পাওয়া না গেলেও বিভিন্ন সমীক্ষায় দেখা যায় যে, টারশিয়ারি যুগে (Tertiary period: ২.৬-৬.৬ কোটি বছর) বাংলাদেশের অংশবিশেষে বিস্তৃত গ্রীষ্মমন্ডলীয় অরণ্য ছিল। নিকটবর্তী অঞ্চলে মায়োসিন স্তরে প্রাপ্ত Glutaxylon, Dipetrocarpoxylon, Cynometroxylon জীবাশ্মসমূহের সঙ্গে গ্রীষ্মমন্ডলীয় অঞ্চলে বর্তমানে বিদ্যমান প্রজাতিগুলির সুস্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে। বাংলাদেশের নিকটবর্তী এলাকা থেকেও গুপ্তবীজ উদ্ভিদের বেশ কিছু জীবাশ্ম আবিষ্কৃত হয়েছে। টারশিয়ারি যুগের পর আসে হিমযুগ (Glacialion period), আর সেটা চলেছে প্লিসটোসিন যুগেও (Pleistocene period), যার শুরু এখন থেকে প্রায় ১০ লক্ষ বছর আগে আর শেষ ২৫,০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই পর্যায়ে মাঝে মাঝে উদ্ভব হয় আন্তঃহিমযুগের (Interglacial period) যখন জলবায়ুর শৈত্য হ্রাস পায়। তাপমাত্রা হ্রাস পাওয়ায় অধিকাংশ স্তন্যপায়ী অবলুপ্ত হয় এবং টারশিয়ারি ও সিওয়ালিক (Siwalik) যুগের উদ্ভিদকুলের ব্যাপক ক্ষতি হয়।

প্রাচীনকালে মানুষ প্রচুর কাঠ ব্যবহার করত। বাংলাদেশের বনসম্পদ সম্পর্কিত সে সময়ের কোন তথ্য পাওয়া যায় না। প্রায় ২০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে দ্রাবিড় সভ্যতার বিকাশ সম্পর্কে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সভ্যতার বিকাশে অরণ্য একটি বিরাট ভূমিকা পালন করে। গোড়ার দিকে আর্যরা পশুপালন করত এবং পরে কৃষিতে আগ্রহী হয়। তারা বসতি নির্মাণের জন্য নির্দিষ্ট এলাকার বন পরিষ্কার করত এবং অরণ্য ঘেরা পরিবেশে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলত।  বেদ, ব্রাহ্মণ, অরণ্যক ও পুরাণসমূহ এই উপমহাদেশের তৎকালীন বন ও বনায়ন সম্পর্কে কিছু কিছু আলোকপাত করে। বনের অবস্থান ও গঠন সম্পর্কে তথ্যাদি পাওয়া যায় বৈদিক উত্তর যুগের দুটি সাহিত্যকর্ম,  রামায়ণ ও  মহাভারত থেকে। এগুলিতে বাংলাদেশেরও সাধারণ বনবৃক্ষ শালগাছ (Shorea robusta), ধাওয়া (Anogeissus latifolia), বেল (Aegle marmelos), কিংশুক (Butea monosperma) প্রভৃতির উল্লেখ রয়েছে। মহাকাব্যে আরও উল্লেখ রয়েছে যে, গঙ্গা নদীর তীরে গভীর বন ছিল, কিন্তু সে বর্ণনা থেকে বনের সঠিক অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া কঠিন।

পরবর্তী বিবেচ্য যুগ হলো গ্রিকদের আগমন ও মৌর্যশাসন আমল। মেগাস্থিনিস তৎকালের বর্ণনায় লিখেছেন: ‘ফল ও বৃক্ষশোভিত অনেকগুলি সুউচ্চ পর্বত এবং অনেকটা সুদৃশ্য অত্যন্ত উর্বর বিশাল সমতল ভূমি, যা অসংখ্য নদ-নদী দ্বারা বিচ্ছিন্ন।’ সম্রাট আশোক বন ও বন্যপ্রাণী খুব ভালবাসতেন এবং তিনি বন সংরক্ষণের ব্যবস্থাও করেন।  হিউয়েন-সাং (Hinen Tsang) ৬২৯-৬৪৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভ্রমণে আসেন। তাঁর স্মৃতিকথায় তখনকার বনসমূহের অবস্থান সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়। তিনি শ্রাবস্তী, কপিলাবস্ত্ত ও রামগ্রামসহ নিকটবর্তী অঞ্চলে গভীর বনের কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি রামগ্রাম থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে অগ্রসর হন বিখ্যাত এক অরণ্য পথে, যা ছিল অপ্রশস্ত ও অত্যন্ত বিপদসংকুল। অরণ্য থেকে বেরিয়ে তিনি কৃষ্ণগড় নামক দেশে পৌঁছান। এই বিখ্যাত পর্যটক পুন-না-ফা-তান (PUN-NA-FA-TAN) বা পুন্ড্রবর্ধন (কানিংহামের মতে পাবনা এবং ফারগুসনের মতে রংপুর) অতিক্রম করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন যে, পুন্ড্রবর্ধন ছিল একটি নিম্নাঞ্চলীয় দেশ। সেখানকার ভূমি ছিল আর্দ্র, উর্বর ও সমৃদ্ধ; সেখানে ছিল প্রচুর কাঁঠাল গাছ। অতঃপর হিউয়েন-সাং সমতটে অর্থাৎ বর্তমান বৃহত্তর যশোর, ঢাকা ও ফরিদপুর অঞ্চলে পৌঁছান এবং এখানকার ভূমি নিম্ন, আর্দ্র জলবায়ু এবং পর্যাপ্ত গাছপালা ও হিংস্র জীবজন্তুর কথা উল্লেখ করেন।

মুগল সম্রাটদের আমলে কৃষিকাজের জন্য বনাঞ্চল আবাদে উৎসাহ দেওয়া হতো। বাবর তাঁর দিনলিপিতে বর্ণনা দিয়েছেন যে, উড়িষ্যার ৫টিসহ সুবে-বাংলার ২৪টি সরকার ছিল। স্যার জে.এন. সরকার প্রণীত তালিকায় আকবরের সময়কার সুবে বাংলায় ১৬টি সরকার এবং ব্রিটিশ আমলের শেষভাগের বাংলায় জেলার সংখ্যা প্রায় সমান বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমান বাংলাদেশ ভূখন্ডে এসব সুবার যেগুলি অবস্থিত সেগুলি হলো জান্নাতাবাদ- মালদহের অংশ যা এখন নবাবগঞ্জ নামে পরিচিত; ফতেহাবাদ- ফরিদপুর, দক্ষিণ বাখেরগঞ্জ এবং গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত দ্বীপাঞ্চল; মাহমুদাবাদ- উত্তর নদীয়া, উত্তর যশোর ও পশ্চিম ফরিদপুর; খিলা ফতেহাবাদ- দক্ষিণ যশোর ও পশ্চিম বাখেরগঞ্জ; বাকলা- উত্তর ও পূর্ব বাখেরগঞ্জ এবং দক্ষিণ ও পশ্চিম ঢাকা; ঘোড়াঘাট- দক্ষিণ রংপুর, দক্ষিণ-পূর্ব দিনাজপুর ও উত্তর বগুড়া, পিঞ্জিরা- দিনাজপুর এবং রংপুর ও রাজশাহীর অংশবিশেষ; বারবাকাবাদ- প্রধানত রাজশাহী, দক্ষিণ-পশ্চিম বগুড়া ও দক্ষিণ-পূর্ব মালদহ; বাজুহা- রাজশাহীর অংশ, বগুড়া পাবনা ও ঢাকার অংশবিশেষ; সোনারগাঁও- পশ্চিম ত্রিপুরা ও নোয়াখালী।

আবুল ফজল জান্নাতাবাদ, খলিফাবাদ ও বাজুহায় অবস্থিত বনের কথা উল্লেখ করেছেন। খলিফাবাদে প্রচুর বুনোহাতি এবং বাজুহায় মাস্ত্তল তৈরির জন্য লম্বা ও পুরু কাঠ পাওয়া যেত বলে উল্লেখ করা হয়েছে। জান্নাতাবাদের বিস্তৃত তৃণ ভূমিতে বুনো মহিষ চরে বেড়াতো। এই বর্ণনা অনুযায়ী বর্তমান সুন্দরবন উত্তরে আরও সম্প্রসারিত হয়ে উত্তর নদীয়া ও উত্তর যশোর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল এবং সেখানে পাওয়া যেত কুমির আর বাঘ।

বন সম্পর্কে মুগলরা ছিল অনেকটা উদাসীন। তারা বনকে প্রধানত সংরক্ষিত শিকার ভূমি হিসেবে ব্যবহার করত। উদ্যান ও ছায়ানিবিড় রাজপথ নির্মাণে গাছ ব্যবহূত হতো। মোটকথা, গাছ সম্পর্কে তাদের মনোভাব ছিল সৌন্দর্যবোধ প্রভাবিত, তাতে সংরক্ষণ, বিস্তার, উন্নয়নসহ বনায়নের সমস্যা সম্পর্কে কোন পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি ছিল না।

মুগল আমলের শেষে আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এবং পরে ব্রিটিশ শাসন। গোড়ার দিকে, অর্থাৎ অষ্টাদশ থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত জাহাজ নির্মাণ ও রেলের স্লিপার তৈরির জন্য ব্যাপক পরিসরে বন ব্যবহার শুরু হয় এবং এ সময় বন সংরক্ষণের কোন প্রচেষ্টা ছিল না। প্রথম বন রক্ষার উদ্যোগ নেওয়া হয় দক্ষিণ ভারতে। ভারতের তৎকালীন বড়লাট লর্ড ডালহৌসী ১৮৫৫ সালের ৩ আগস্ট এক বিবৃতি প্রকাশ করেন যাতে প্রথমবারের মতো সমগ্র ভারতবর্ষে বন সংরক্ষণের একটি রূপরেখা ছিল। স্ট্যাবিং (Stabbing) এটাকে ‘ভারতীয় বনসম্পদের সনদ’ হিসেবে অভিহিত করেন। ব্রানডিস ১৮৫৬ সালে মহাবনপরিদর্শক নিযুক্ত হন। ব্রিটিশ ভারতে সর্বপ্রথম বন বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা হয় ১৮৬৪ সালের ১ নভেম্বর।

ব্রানডিসের অধীনে এবং সহকারী হিসেবে ক্লেঘোরা’র (Cleghora) সহায়তায় ভারতে প্রথম বিজ্ঞানসম্মত বন ব্যবস্থাপনার সূচনা হয়। ১৮৬৫ সালে ভারতীয় বন আইন পাশ এবং ১৮৬৯ সালে ফরেস্ট সার্ভিস গঠিত হয়। বলা যায় যে, ১৮৭০ সাল নাগাদ ব্রানডিস বন বিভাগের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটি নিয়মিত ফরেস্ট সার্ভিস চালু হয় এবং ১৮৭১-১৯০০ সালের মধ্যে বনবিদ্যা সুনির্দিষ্ট অগ্রগতি অর্জন করে। অতঃপর বনের সীমানা নির্ধারণ এবং ১৮৭৮ সালে বন আইন (Act VII, 1878) সংশোধন করা হয়। ফরেস্ট সার্ভিসের নির্বাহী ও নিয়ন্ত্রণ শাখায় নিয়োগের জন্য ১৮৭১ থেকে ১৯০০ সালের কারিগরি শিক্ষা ও কর্মী প্রশিক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। প্রথম বন বিদ্যালয় স্থাপিত হয় ১৮৭৮ সালে উত্তর ভারতের দেরাদুন শহরে। ১৯০৬ সালে লর্ড কার্জন দেরাদুনে ইম্পিরিয়াল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউট স্থাপন করেন।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ (১৯১৪-১৮) এবং ভারতীয় স্বশাসন (Home Rule) ও অসহযোগ আন্দোলন বনাঞ্চলের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলে। এই সময় বনের ক্ষতিসাধন এবং বন আইন লঙ্ঘনের ফলে বিপুল পরিমাণ বনসম্পদ ধ্বংস হয়। ১৯১৯ সালে বিকেন্দ্রীকরণ সম্পর্কিত রাজকীয় কমিশন মহাবনপরিদর্শকের নিকট থেকে কর্ম পরিকল্পনা প্রস্ত্ততের পরামর্শ প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯২১ সালে বন প্রশাসন প্রদেশের নিকট হস্তান্তরিত হয়। ১৯২৬ সালে ভারত সরকার মহাবনপরিদর্শকের পদ ও বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রেসিডেন্টের পদ একত্রিত করে। ক্রমান্বয়ে প্রদেশগুলির প্রধান বন সংরক্ষকগণ নিজ প্রাদেশিক প্রশাসকদের নিকট দায়বদ্ধ থেকে স্বীয় অধিদপ্তরের স্বতন্ত্র প্রধান হন।

মহাবনপরিদর্শক ব্রানডিস ১৮৬২ সালে তৎকালীন বাংলার কতিপয় বন পরিদর্শন করেন। কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের সুপারিনটেনডেন্ট এম.টি অ্যান্ডারসন ১৮৬৪ সালে আসাম ও বাংলা প্রদেশের অস্থায়ী বন সংরক্ষক পদে নিযুক্ত হওয়ার পরই এই অঞ্চলে বনসংরক্ষণের প্রথম পদক্ষেপের সূচনা হয়। ১৮৬৫ সালে বন সংরক্ষকের অফিস কলকাতায় স্থাপিত হয়। শুরুতে সিকিম, ভুটান ও আসাম এই তিন স্থানে তিনটি বন বিভাগ স্থাপনের প্রস্তাব থাকলেও মাত্র একটি অনুমোদন লাভ করে। ১৮৬৫ সালে সিনকোনা চাষের দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী বনসংরক্ষক ম্যান (Mann)-এর নেতৃত্বে সিকিম বিভাগ স্থাপিত হয়। অ্যান্ডারসন পরিচালিত প্রাথমিক জরিপের ওপর ভিত্তি করে বনাঞ্চল সংরক্ষণের ব্যবস্থা পাকা হয়। দার্জিলিং বনাঞ্চলে ১৮৬৬ সালে বন সংরক্ষণের নোটিস জারি করা হয়। ১৮৭০ সাল নাগাদ দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি, কালিমপং ও বাকসারে (Buxa) সংরক্ষিত বনের জরিপ ও সীমানা নির্ধারণের কাজ সম্পূর্ণ হয়।

১৮৭৯ সালে সুন্দরবনের ৪৮৫৬ বর্গ কিলোমিটার (১৮৭৫ বর্গ মাইল) এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং ১৮৯৩ সালে হিনিং (Heining) সুন্দরবনের কর্মপরিকল্পনা প্রস্ত্তত করেন। ১৮৮০ সালে প্রথমবারের মতো এখানে গুলিছোঁড়া, শিকার ও মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করা হয়। অ্যান্ডারসন পদত্যাগ করার পর ১৮৬৭ সালে লিডস (Leeds) বন সংরক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৮৭২ সালে ড. সিলিচ (Dr Schlich) বন সংরক্ষক হিসেবে যোগদানের পর নিম্নবর্ণিত ৫টি বন বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়: ১. কুচবিহার বিভাগ কুচবিহার কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত (বনপাল, বন কর্মকর্তা ছিলেন বনসংরক্ষকের অধীন); ঢাকা বিভাগ (সিলেট ও কাছার) বনপাল ছিলেন বনসংরক্ষকের অধীন; আসাম বিভাগ আসাম কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত (বনপাল কমিশনারের অধীন থাকলেও পরিদর্শন ও হিসাব নিয়ন্ত্রণ ছিল বনসংরক্ষকের এখতিয়ারে); চট্টগ্রাম বিভাগ চট্টগ্রামের কমিশনারশিপের সীমানা নিয়ে গঠিত। কমিশনার ছিলেন বনসংরক্ষক। পরামর্শদান ছাড়া বাংলার বনসংরক্ষকের কোন এখতিয়ার ছিল না; ভাগলপুর বিভাগ পাটনা, ছোটনাগপুর ও ভাগলপুর নিয়ে গঠিত।

বন সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের জন্য ১৯০৭ সালে কুর্সঙের ডাওহিলে একটি বনবিদ্যালয় স্থাপিত হয় এবং ১৯২৪ সালে একজন বন বিশেষজ্ঞ সেখানে নিয়োগ লাভ করেন। ১৯৩১ সালে বন ব্যবহার কর্মকর্তার (Forest Utilization Officer) একটি পদ সৃষ্টি করা হয়। ১৯২৫ সালে ই.ও শেবারে (EO Shebbare) বেসরকারি বনের ব্যাপারে পদ্ধতিগত অনুসন্ধান শুরু করেন। ১৯১৯-২০ সালে কক্সবাজার বিভাগ গঠিত হলেও ঢাকা-ময়মনসিংহ বিভাগ গঠিত হয় ১৯২৫-২৬ সালে। ১৯২৭ সালে বেঙ্গল ফরেস্ট সার্কেল বিভক্ত হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ সার্কেল গঠিত হয়। একই বছর ১৮৭৮ সালের বন আইন (Act VII, 1878) সংশোধন এবং ১৯২৭ সালের বন আইন কার্যকর করা হয়। সুন্দরবন, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা, কক্সবাজার ও ঢাকা-ময়মনসিংহ নিয়ে গঠিত হয় দক্ষিণ সার্কেল, যা এখন বাংলাদেশের অংশ। সমগ্র উত্তর সার্কেলটি পড়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বঙ্গদেশ পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব বাংলায় (পূর্ব পাকিস্তান) বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ সার্কেলের বন বিভাগ (চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ ও খুলনা জেলাধীন সুন্দরবন) পূর্ব বাংলার বনাঞ্চলভুক্ত হয়। আসামের সিলেট বিভাগও পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।

একজন বনসংরক্ষকের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তানের বন প্রশাসন গঠন করা হয়। পরবর্তীকালে প্রথমে দুটি এবং পরে তিনটি বন সার্কেল পূর্ব সার্কেল, পশ্চিম সার্কেল ও উন্নয়ন সার্কেল গঠিত হয়। চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সিলেট পূর্ব সার্কেলে থেকে যায়। সুন্দরবন, ঢাকা ও ময়মনসিংহ পড়ে পশ্চিম সার্কেলে এবং কর্ম পরিকল্পনা ও ব্যবহার বিভাগ নিয়ে গঠিত হয় উন্নয়ন সার্কেল। বনপালদের (foresters) প্রশিক্ষণের জন্য সিলেটে একটি বন বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়।

১৯৬০ সালে প্রধান বনসংরক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়, এবং ফরেস্ট রেঞ্জারদের প্রশিক্ষণের জন্য চট্টগ্রামে একটি কলেজ স্থাপন করা হয়। বন গবেষণা ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রীয় সরকারের বিষয় হিসেবেই রয়ে যায় এবং তা মহাবনপরিদর্শক কর্তৃক রাওয়ালপিন্ডি (পশ্চিম পাকিস্তান) থেকে নিয়ন্ত্রিত হতো। পাকিস্তান সরকার বন গবেষণা ইনস্টিটিউটকে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের নিকট হস্তান্তর করে এবং এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তরের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ জোগায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর উদ্ভূত রাজনৈতিক পরিবর্তন দেশে একটি নতুন বননীতির সূচনা করে। ১৯৭২ সালে এই নীতি গ্রহণকল্পে নতুন প্রচেষ্টা শুরু হয়। ‘সকলের জন্য বন’ এই শ্লোগানকে ধারণা করে সংরক্ষিত বনের বাইরে বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধির ওপর অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয় এবং পতিত ও প্রান্তিক জমিতে এবং গ্রামের বনেবাদাড়ে বৃক্ষরোপণ জোরদার করা হয়। জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্যও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।

১৯৮০ সাল থেকে বাংলাদেশের বনের প্রশাসনিক কাঠামোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। সামাজিক বনায়নে অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং যেসব জেলায় বন নেই অথবা কম রয়েছে সেসব জেলা সামাজিক বনায়নের আওতায় আনা হয়। রংপুর, বগুড়া, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও পাবনায় নতুন বন বিভাগ এবং বগুড়া ও যশোহরে দুটি নতুন সার্কেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। একইভাবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বৃক্ষহীন অশ্রেণীকৃত সরকারি বনে গাছ লাগানোর জন্য খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কাপ্তাই ও রাঙ্গামাটিতে বন বিভাগ গড়ে তোলা হয়েছে। সদর দপ্তরে বন প্রশাসনের কর্মতৎপরতাও বৃদ্ধি পায় এবং প্রধান বনসংরক্ষককে সহায়তা প্রদানের জন্য ৩টি উপপ্রধান বনসংরক্ষকের পদ সৃষ্টি করা হয়। বর্তমানে ৭টি সার্কেল ও ৩১টি বিভাগ রয়েছে। সার্কেলগুলির প্রত্যেকটিতে একজন বনরক্ষক এবং বিভাগগুলিতে উপ-বনরক্ষক মর্যাদার একজন কর্মকর্তা নেতৃত্ব দেন। এছাড়াও জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেন, কাপ্তাইয়ের বন উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র এবং চট্টগ্রামস্থ বন মহাবিদ্যালয়ে সার্বক্ষণিক বনসংরক্ষক নিয়োগ করা হয়েছে।  [সৈয়দ সালামত আলী]

বনভূমির প্রকারভেদ' (Forest type)  বাস্ত্তসংস্থানিক বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশের বনভূমি নিম্নোক্ত শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে: ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ, ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ, ক্রান্তীয় আর্দ্র পত্রমোচী, জোয়ারধৌত বন ও কৃত্রিম বন।

ক্রান্তীয় আর্দ্র চিরসবুজ বন (Troppical wet evergreen forest)  সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যসহ এখানে চিরসবুজ গাছগাছালির প্রাধান্য। এই বনে কিছুটা আধাচিরসবুজ ও পত্রমোচী বৃক্ষও থাকে, কিন্তু তাতে বনের চিরসবুজ প্রকৃতি বদলায় না। চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চল, পার্বত্য চট্টগ্রাম, দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের কক্সবাজার ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মৌলভীবাজার জেলায় এ ধরনের বনভূমি রয়েছে। বৃক্ষসমূহ ৪৫-৬২ মিটার পর্যন্ত হতে পারে। আর্দ্র ছায়াঢাকা স্থানে পরাশ্রয়ী অর্কিড, ফার্ন ও ফার্নজাতীয় উদ্ভিদ, লতা, মস, কচু, বেত ইত্যাদি প্রায় সর্বত্রই জন্মে। গুল্ম, বীরুৎ ও তৃণ কম, এ জাতীয় বনে প্রায় ৭০০ প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। কালিগর্জন, ধলিগর্জন, সিভিট, ধুপ, কামদেব, রক্তন, নারকেলি, তালী, চুন্দাল, ঢাকিজাম ইত্যাদি সাধারণ চিরহরিৎ বৃক্ষ প্রজাতি যেগুলি সর্বোচ্চ ছাউনি (canopy) সৃষ্টি করে। চাঁপা, বনশিমুল, চাপালিশ, মাদার ইত্যাদি আধাচিরহরিৎ ও চিরহরিৎ বৃক্ষ বিক্ষিপ্তভাবে জন্মে। পিতরাজ, চালমুগরা, ডেফল, নাগেশ্বর, কাউ, গোদা, জাম, ডুমুর, করই, ধারমারা, গামার, তেজবল মদনমাস্তা, আসার, মুস, ছাতিম, তুন, অশোক, বড়মালা, ডাকরুম, বুরা ইত্যাদি দ্বিতীয় স্তরের ছাউনি সৃষ্টি করে। মাঝে মাঝে Gnetum ও Podocarpus নামক দুটি নগ্নবীজী উদ্ভিদ দেখা যায়। এ বনে কয়েক প্রজাতির বাঁশও রয়েছে।

চিরসবুজ বন

ক্রান্তীয় আধা-চিরসবুজ বন (Tropical Semi-evergreen forest)  বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে এ বন সাধারণত চিরহরিৎ, কিন্তু পত্রমোচী (deciduous) বৃক্ষেরও প্রাধান্য রয়েছে। এ বনভূমি সিলেট, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুরের পাহাড়ি এলাকা নিয়ে গঠিত। প্রধানত জুমচাষ করা হয়। এখানে আট শতাধিক প্রজাতির সপুষ্পক উদ্ভিদ রয়েছে। চিরসবুজ বন অপেক্ষা এ জাতীয় বনে গাছতলায় (undergrowth) উদ্ভিদ অধিক জন্মে। উঁচু আচ্ছাদন সৃষ্টিকারী বৃক্ষ ২৫-২৭ মিটার উঁচু। উপত্যকা ও আর্দ্র ঢালে চাপালিশ, তেলশুর, নারকেলি প্রজাতিগুলিই বেশি জন্মে। গুটগুটিয়া, তুন, পীতরাজ, নাগেশ্বর, উড়িআম, নালিজাম, গোদাজাম, পীতজাম, ঢাকিজাম ইত্যাদি মধ্যমাঞ্চলে ছাউনি সৃষ্টি করে। ডেফল ও কেচুয়ান নিম্নস্তরের আচ্ছাদক। অপেক্ষাকৃত অধিক উষ্ণ ও শুষ্ক ঢালে এবং খাঁজে বিভিন্ন প্রজাতির গর্জন, বনশিমুল, শিমুল, শিলকরই, চুন্দুল, গুজা বাটনা, কামদেব, বুরা গামারি, বহেড়া ও মুস উপরের ছাউনি সৃষ্টি করে। গাব, উদাল ও শিভাদি মধ্যম উচ্চতার ছাউনি সৃষ্টি করে, এবং আদালিয়া, বড়মালা, গোদা, অশোক, জলপাই ও দারুম নিচু ছাউনি সৃষ্টি করে। সাধারণ চিরসবুজ উদ্ভিদ প্রজাতিগুলি হলো গর্জন, শিমুল, বনশিমুল, বাটনা, চাপালিশ, তুন, করই ও জলপাই। এ বনভূমির উদ্ভিদের উত্তরাংশের সঙ্গে পূর্ব-হিমালয় ও দক্ষিণাংশের সঙ্গে আরাকানের উদ্ভিদের সাদৃশ্য রয়েছে। এই বনগুলির মোট আয়তন প্রায় ৬,৪০,০০০ হেক্টর যা বাণিজ্যিক কাঠের ৪০% যোগায়। পূর্বে প্রবর্তিত সেগুনের সঙ্গে সাম্প্রতিক রাবার চাষের ফলে এ বনভূমির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে।

গাজীপুর,শালবন

ক্রান্তীয় আর্দ্র-পত্রমোচী বন (Tropical moist deciduous forest)  শাল (Shorea robusta) গাছের প্রাধান্য বিধায় সাধারণত শালবন নামে পরিচিত। বর্তমানে ঢাকা, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর ও কুমিল্লা অঞ্চলে বিস্তৃত এ বনভূমির দুটি সুস্পষ্ট বলয় রয়েছে (প্রায় ১০৭,০০০ হেক্টর)। বৃহৎ অংশটি ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মধ্যবর্তী অঞ্চলে প্রায় ৮০ কিমি দীর্ঘ ও ৭-২০ কিমি চওড়া যা মধুপুরগড় নামে পরিচিত। ক্ষুদ্রতর অংশটি শেরপুর জেলায় ভারতের গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, ৬০ কিমি লম্বা ও ১.৫-১০ কিমি চওড়া। তাছাড়া রংপুর, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁ ও নওগাঁ জেলায় শালবনের কিছু বিচ্ছিন্ন অঞ্চল (প্রায় ১৪,০০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে) এবং কুমিল্লা জেলার শালবন বিহার, ময়নামতি ও রাজেশপুরে কিছু অবশেষ (২০০ হেক্টর) ছড়িয়ে রয়েছে। বিশ শতকের প্রথম দিকে কুমিল্লা থেকে ভারতের দার্জিলিং পর্যন্ত একটি অবিচ্ছিন্ন শালবন ছিল। বর্তমানে বনের অধিকাংশই দখল হয়ে গেছে। অবিশষ্ট বনের গাছের মজুদ ও গুণমান নিম্নস্তরের। বর্তমানে শালবন এলাকায় রয়েছে অসংখ্য ধানক্ষেত। বনের অবিচ্ছিন্ন ছাউনি ১০-২০ মিটার উঁচু, অধিকাংশই পত্রমোচী প্রজাতি। শাল (প্রায় ৯০%) ছাড়া অন্যান্য সাধারণ বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে পলাশ, হালদু, জারুল বা সিধা (Lagerstroemia parviflora), বাজনা, হাড়গজা, আজুলি (Dillenia pentagyna), ভেলা, করই, মেনদা (Litsea monopetala), কুসুম, উদাল, ডেফাজাম, বহেড়া, কুরচি, হরীতকী, পিতরাজ, শেওড়া, সোনালু, আসার, আমলকি ও অধগাছ (Croton oblongifolius)। লতার (অধিকাংশই কাষ্ঠলতা) মধ্যে রয়েছে কাঞ্চনলতা, আনিগোটা (Zizyphus rugusa), কুমারীলতা, গজপিপুল, পানিলতা, নানা জাতের মেটে-আলু (Dioscorea species), শতমূলী ও গিলা। গাছতলার প্রজাতির সংখ্যাও যথেষ্ট (৫০ গণের প্রায় ২৫০টি প্রজাতি) যাদের মধ্যে আসামলতা, ভাঁট, বৈঁচি, ময়নাকাঁটা, আসাল ইত্যাদিরই প্রাধান্য। ঘাসের মধ্যে ছনই বেশি। কিছু পরাশ্রয়ী উদ্ভিদও রয়েছে। শিম, সিজ ও কলমী গোত্রীয় উদ্ভিদও রয়েছে।

জোয়ারধৌত বন (Tidal forest)  খুলনা, পটুয়াখালী, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের এই উপকূলীয় বনগুলি (একত্রে প্রায় ৫২০,০০০ হেক্টর) বাংলাদেশের সর্বাধিক উৎপাদনশীল বনভূমি। প্রতিবার জোয়ারের সময় এ বনভূমি সমুদ্রের পানিতে প্লাবিত হয়। এখানকার চিরসবুজ গাছগুলির আছে বায়ুমূল এবং বংশবিস্তার জরায়ুজ ধরনের। সুন্দরি ছাড়াও পশুর, গেওয়া, কেওড়া, কাঁকড়া, বাইন, ধুন্দুল, আমুর ও ডাকুর দলবদ্ধভাবে জন্মে। উপকূলীয় পানির ঘোলাটে ভাব ও লবণাক্ততা সেখানকার প্রজাতিগুলির বিন্যাস ও বৈশিষ্ট্য নিয়ন্ত্রণ করে। সুন্দরবন ছাড়াও গাঙ্গেয় বদ্বীপের অনেকগুলি চরই ম্যানগ্রোভের গভীর বনে ঢাকা, নেই শুধু সুন্দরি। নদীর পলি জমে ওঠা তীর ও ফাটলেই এসব প্রজাতি দ্রুত বেড়ে ওঠে। নদী ও খালের পাড়ে ঠেসমূলীয় (rhizophoreceous) প্রজাতির প্রাধান্য দেখা যায়।

জোয়ারধৌত বন

কিছু বন কিছু নির্দিষ্ট বাস্ত্তসংস্থানে সীমিত থাকে। এসব বনের মধ্যে রয়েছে ১. বেলাভূমি বা তটীয় বন- চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বরিশাল ও পটুয়াখালী অঞ্চলের সমুদ্র উপকূল বরাবর বিস্তৃত। এখানে নানা ধরনের ও ঘনত্বের ঝোপঝাড়ের সঙ্গে জন্মে ঝাউ, কেরুং, পনিয়াল, কাঠবাদাম, মাদার, পিপুল ও নিশিন্দা; ২. স্বাদুপানির নিম্নভূমির বন- সিলেট, সুনামগঞ্জের হাওর ও পার্বত্য বনাঞ্চলের নিচু এলাকায় অবস্থিত। এসব এলাকা বর্ষায় প্লাবিত হয় ও মাটি অত্যন্ত পানিসিক্ত থাকে। সিলেট অঞ্চলে নিম্নভূমির বনে প্রচুর তৃণজাতীয় উদ্ভিদ- ইকড়, খাগড়া ও নল জন্মে। হাওরগুলির পাড়ে প্রায়শই শুধু হিজল বন দেখা যায়। এখানকার গাছতলার গাছগাছড়া হলো প্রধানত বেত, গুঁয়েবাবলা (Lantana species) এবং বড় জাতের ঘাস ও বেনা। বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে- কড়ই, শিমুল, কালউঝা (Cordia dichotoma), ভাটকুর (Vitex heterophylla) ও জারুল। গাছতলার প্রজাতি হলো তেরা (Alpinia), কেউমূল (Costus), মুর্তা ও দাঁতরাঙ্গা/লুটকি (Melastoma) ও নল। এসব বিশেষ ধরনের বন ছাড়াও পাহাড়ি ছোট নদী বা ছড়ার কিনারে স্বকীয় গাছগাছালিসহ আরও স্থানীয় কিছু বন রয়েছে যেখানে গাছের মধ্যে জন্মে চালতা, পিটালি, কাঞ্জল (Bischofia javanica), জারুল, অশোক, ভুবি (Baccaurea ramiflora), জলপাই, শেওড়া ও ডুমুর এবং এইসঙ্গে অনেক প্রজাতির পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ, ফার্ন ও মস।

পার্বত্য বন আবাদের পর নতুন বনায়ন এলাকায় প্রথমে জন্মে গোলসাগু (Cariota urens), বুরা (Macaranga species), বড়মালা (Callicarpa arborea), কাশিপালা (Hibiscus macrophyllus), গোদা (Vitex peduncularis), জীবন (Trema orientalis), নুনকচি (Glochidion species), আমলকি, কুরচি, এলেনা (Antidesma), কদম, ডেফাজাম (Cleistocalyx operculata), কড়ই, উদাল, বাজনা, কাঁটা কশই, তুন, ভাদি, গুটগুটিয়া (Proteium serratum), বাটা, হাড়গোজা ও বিভিন্ন প্রজাতির ঘাস। প্রাকৃতিক বনভূমির ক্রমাগত হ্রাসের কারণেও কিছু বিশেষ ধরনের বন সৃষ্টি হয়, যাকে তৃণজাতীয় অগোছালো জঙ্গল বলা যায় (প্রায় ৭৫০,০০০ হেক্টর)। বর্তমানে ছন চাষের জন্য এসব গৌণ জঙ্গল প্রায়ই পোড়ানো হয়।

আবাদি বন (Plantation forest)  প্রতিবছর রোপিত এই বন দুভাগে বিভাজ্য: ১. রোপিত রাষ্ট্রীয় বন- ১৮৭১ সালে বর্তমান মায়ানমার থেকে বীজ এনে পার্বত্য চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে সেগুন চাষের প্রাথমিক উদ্যোগ নেওয়া হয়। তখন থেকেই আবাদি বন গাছ কেটে নতুন করে বনায়নের অংশ হয়ে উঠে। ১৯২০ সাল পর্যন্ত এটি শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামেই সীমাবদ্ধ ছিল। তারপর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগেও সম্প্রসারিত হয়। বছরে বনায়নের হার ছিল ৪০০ হেক্টর। সেগুনের পর লাগানো অন্যান্য প্রজাতি হলো গামারি, চাপালিশ, গর্জন, মেহগনি, জারুল, তুন, পাইন ও জাম। পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি গৃহীত হয়। ১৯৭৪ সালে বন বিভাগ জ্বালানি কাঠ উৎপাদনের জন্য গামারি, Albizia falcata; কদম, Acacia species; Eucalyptus species ও পাইনের মতো দ্রুতবর্ধনশীল বৃক্ষ ব্যাপকভাবে রোপণ শুরু করে; ২. ব্যক্তিমালিকানাধীন আবাদি বন- চিরাচরিত প্রথা হিসেবেই বসতবাড়িতে সাফল্যের সঙ্গে বিভিন্ন বৃক্ষ ও ফসল জন্মানো হয়। এ জাতীয় বন রাষ্ট্রীয় বনভূমি ধ্বংসের বিপরীতে দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বসতবাড়ির বনভূমিতে প্রায় ১৬০ প্রজাতির বৃক্ষ পাওয়া যায়। এই ধরনের বন সরকারি বনের তুলনায় ১৫-২৫ গুণ বেশি উৎপাদনশীল। [মোস্তফা কামাল পাশা]

বনভূমির বিস্তৃতি (Forest distribution)  বাংলাদেশে অশ্রেণীবদ্ধ বনাঞ্চলসহ সর্বমোট রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত বনাঞ্চলের পরিমাণ প্রায় ২২ লক্ষ ৪২ হাজার হেক্টর। এই সম্পূর্ণ এলাকার একটি বিরাট অংশ বৃক্ষহীন। বিগত তিন দশক ধরে প্রতি বছর গড়ে ২.১% বনাঞ্চল বিলুপ্ত হয়েছে। বাংলাদেশের গ্রামীণ বনভূমিসমূহ দেশের অর্থনীতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দেশের প্রয়োজনীয় কাঠ ও জ্বালানি কাঠের চাহিদার উল্লেখযোগ্য অংশ পল্লি অঞ্চলের বনসমূহ থেকে পূরণ হয়। কাঠ উৎপাদন ছাড়াও পল্লি বনসমূহের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গুরুত্ব রয়েছে।

এ সকল বন থেকে আহরিত হয় ফলমূল, পশুখাদ্য, জ্বালানি, ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের কাঁচামাল, কৃষি সরঞ্জাম, গৃহনির্মাণের উপকরণসমূহ। এক হিসাবে দেখা গেছে যে, গ্রামীণ বন জঙ্গলের পরিমাণ প্রায় ২,০৭,০০০ হেক্টর। প্রকৃতপক্ষে গ্রামীণ বনকে বন বলা চলে না। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে গ্রামীণ বনকুঞ্জসমূহ বহুমুখী তাৎপর্য বহন করে।

চা বাগান এক ধরনের বন যা উল্লেখ করা প্রয়োজন। গুণগতমান বিচারে উৎকৃষ্ট বৃক্ষ সম্পদ পাওয়া যায় চা বাগান এলাকা থেকে। চা বাগানে উৎপন্ন বৃক্ষাদির পরিমাণও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। চা বাগানের বৃক্ষাদি বলতে চা বাগানের ছায়া প্রদানকারী বৃক্ষ ছাড়াও চা বাগান সংলগ্ন এলাকার অন্যান্য বৃক্ষকে বুঝানো হয়। এই ধরনের প্রায় ২,৮০০ হেক্টর আচ্ছাদিত ভূমি চট্টগ্রাম, সিলেট ও রাঙ্গামাটিতে বিস্তৃত। অতীতে এরূপ আরও অধিক পরিমাণ ভূমিতে ঘন বৃক্ষরাজি শোভা পেত।

তৃতীয় ধরনের বন দ্রুত প্রসার লাভ করছে। বন বহির্ভূত সরকারি খাস জমি যেমন রাস্তাঘাটের কিনার, রেল পথের বেড়ী, খাল বিলের পাড়ে বৃক্ষরোপণ। এই ধরনের প্রান্তিক ভূমিতে বনায়ন একদিকে ক্ষয়িষ্ণু গ্রামীণ বনের ঘাটতিপূরণ করছে, একই সঙ্গে পতিত জমির ব্যবহারে যোগ করছে এক নতুন মাত্রা।

সারণি রাষ্ট্রায়ত্ত বনভূমির অবস্থান (হেক্টরে)।

বনভূমির প্রকারভেদ সংরতি বনভূমি সংরতি বনভূমি অর্পিত বনভূমি অধিগৃহীত বনভূমি ওয়াপদা ও খাস অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বনভূমি মোট
পাহাড়ি ৫৯৪,৩৮৩ ৩২,৩০৩ ২,৬৩৬ ১১,০০৪ --- ৭২১,৩৪৪ ১৩৬১,৬৭০
অভ্যন্তরীণ ৬৮,১৪০ ২,৬৮৯ ১৯,৯৮৫ ৩১,১৯৮ --- --- ১২২,০১২
উপকূলীয় ৬৫৬,৫৭৯ --- --- ১০১,৫২৬ --- ৭৫৮,১১১
মোট ১৩,১৯,১০২ ৩৪,৯৯২ ২২,৬২১ ৪২,২০৮ ১০১,৫২৬ ৭২১,৩৪৪ ২২,৪১,৭৯৩

বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত বনসমূহ তিনটি অঞ্চলে বিস্তৃত: ১. বৃহত্তর চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটের পাহাড়ি বনাঞ্চল; ২. কেন্দ্রীয় ও উত্তরাঞ্চলীয় অভ্যন্তরীণ বনাঞ্চল; ৩. দ্বীপ ও চরাঞ্চলীয় এবং উপকূলবর্তী বনাঞ্চল।

সারণি  বিভিন্ন বন বিভাগের অধীন বিভিন্ন ধরনের বনের বর্তমান বিস্তৃতি ও আয়তন (হেক্টর)।

উৎস  বন মহাপরিকল্পনা (বন ব্যবস্থাপনা)।

উপরোক্ত সারণিতে উল্লেখিত ভূমির সবটুকু প্রকৃতপক্ষে বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে নেই। অধিকাংশ ভূমিতেই অবৈধ দখল ঘটেছে। অভ্যন্তরীণ শালবনভূমি অধিক মাত্রায় বেদখল হয়েছে। ১৯৮৫ সন থেকে পর্যবেক্ষণে লক্ষ্য করা গেছে যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে অবৈধ দখল এবং জুমচাষ বৃদ্ধি পেয়েছে।

পাহাড়ি বনভূমি দেশের মোট বনভূমির অর্ধাংশের অধিক জুড়ে বিস্তৃত। এই বনভূমিসমূহ অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। নিম্নে প্রদত্ত বর্ণনা মূলত বৃহত্তর চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সিলেটের বনভূমি চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনভূমিরই সম্প্রসারিত অংশ।

কাসালং সংরক্ষিত বনভূমি

পাহাড়ি অঞ্চলের সংরক্ষিত বনের মধ্যে রয়েছে কাসালং (মাইনি হেড ওয়াটার রিজার্ভসহ), রেনখিয়াং, সীতাপাহাড়, সাঙ্গু, মাতামুহুরী, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট সংরক্ষিত বন। এদের মধ্যে সীতাপাহাড় হচ্ছে প্রথম পাহাড়ি বনভূমি যা ১৮৭৫ সালে সংরক্ষিত ঘোষিত হয়। এ শতাব্দীর প্রথম দশকেই অধিকাংশ বনভূমিতে জরিপ ও সীমানা নির্ধারণ করা হয়। বন বিভাগ ১৮৭১ সালে সীতাপাহাড় এলাকায় বৃক্ষরোপণ শুরু করে। এরপর থেকেই সেগুনের বনায়ন প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। অনাচ্ছাদিত বনভূমিতে কৃত্রিমভাবে বনায়নের যে পরিকল্পনা সীতাপাহাড়ে সূচিত হয়েছিল, তা কাসালং ও রানখিয়াং এর সংরক্ষিত এলাকায় সম্প্রসারিত করা হয়। ১৯৬৩ সালে কাসালং ও রানখিয়াং এর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের বিস্তারিত জরিপ পরিচালনা করা হয়। এর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সরকারের আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডি (USAID) সাংগু ও মাতামুহুরীর সংরক্ষিত বনাঞ্চলের জরিপের কাজ পরিচালনা করে। কাসালং ও রানখিয়াং-এ গড়ে তোলা হয় ১,০০০ হেক্টর বনভূমি যেখানে সেগুনই প্রধান বৃক্ষ। কাঠ আহরণের জন্য ষাটের দশকের মাঝামাঝি বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠিত হয়। ষাটের দশকের শেষভাগে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা এবং উপজাতীয় অসন্তোষ সুষ্ঠু বন ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের বাধা হিসেবে দেখা দেয়। এ সময় রাখিয়াং এবং থেগা উঁচু ভূমির সংরক্ষিত বনসমূহের অধিকাংশ অবৈধ দখলে চলে যায়। অপরদিকে মাতামুহুরীর সংরক্ষিত এলাকায় ৫,০৩৭ হেক্টর নতুন বনায়ন করা হয়।

পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭০০ হাজার হেক্টরের অধিক অশ্রেণীভুক্ত রাষ্ট্রীয় বনাঞ্চলে (ইউএসএফ) জুম চাষ হয়। বান্দরবান ও খাগড়াছড়ি এলাকায় বিস্তৃত এই ধরনের অশ্রেণীভুক্ত বনাঞ্চল বন বিভাগের দখলে এনে বনায়ন করা হয়। ১৯৯০ সাল পর্যন্ত সেগুন ও অন্যান্য প্রজাতির বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে ৪৮,০০০ হেক্টর বনায়ন করা হয়।

১৯৮৭ সালে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার বনাঞ্চলের জরিপ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই জরিপের রিপোর্ট অনুযায়ী দেখা যায় যে ৫২,৪৭১ হেক্টর প্রাকৃতিক বনাঞ্চলের প্রায় ৩৮% উচ্চমানের বন ছিল ক্ষতিগ্রস্ত ও গৌণ ধরনের ক্ষুদ্র আচ্ছাদন, ১৩% উদ্ভিদে ছিল উন্নতমানের বৃহৎ আকৃতির বৃক্ষ আচ্ছাদন, ১% ভূমিতে গর্জন বৃক্ষ এবং অবশিষ্ট ৪৮ ভাগে ছিল ঝোপ-গুল্মসহ বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে থাকা বৃক্ষরাজি। ঐ জরিপে আরও দেখা যায় যে, বনায়নকৃত ৩৮,৮৫২ হেক্টরের মধ্যে আনুমানিক ২১,০০০ হেক্টর উজাড় হয়ে যায়। এই বন উজাড়ের জন্য অবৈধ দখল, অবৈধভাবে গাছকাটা, ১৯৪১-৪৫ সালের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন ধ্বংসযজ্ঞকে কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়।

কক্সবাজারের ২৪,৪৩৮ হেক্টর প্রাকৃতিক বনভূমির মধ্যে শতকরা ৫৭ ভাগে দেখা যায় ক্ষতিগ্রস্ত গৌণ ও ক্ষুদ্র মাপের বৃক্ষ আচ্ছাদন, ৪২ ভাগ অঞ্চলে তুলনামূলকভাবে উৎকৃষ্ট ধরনের বনভূমি এবং বাকি অংশ ছিল সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। আনুপাতিক হিসাবে গৌণ বনভূমির পরিমাণ বেশি হওয়ার কারণ হলো যুদ্ধকালীন সময়ে বড় বড় গাছ কেটে ফেলা। এই জরিপে প্রতিয়মান হয় যে, এই বন বিভাগে বনায়নকৃত ৩৮,০০০ হেক্টরের মধ্যে ১৯৯১ সালে মাত্র ২৪,২১০ হেক্টর বন আনুমানিক ৩০ শতাংশ টিকে থাকে। মায়ানমার (বার্মা) থেকে ব্যাপক হারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনের ফলে এবং কক্সবাজারের বনভূমিতে উদ্বাস্ত্তদের ক্যাম্প স্থাপিত হওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে।

১৯৪৭ সালের পূর্বে সিলেট বনাঞ্চল ছিল আসামের অংশ। এই অঞ্চলের বনভূমি সম্পর্কে সে সময়কার পর্যাপ্ত তথ্যাদি পাওয়া যায় নি। সিলেটে ১৩,৮০২ হেক্টর বনাঞ্চল রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

অভ্যন্তরীণ শালবন  বর্তমানে ঢাকা, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও দিনাজপুর জেলায় শালবন বিস্তৃত। রংপুর, রাজশাহী ও কুমিল্লায় অল্প পরিমাণে বিক্ষিপ্ত আকারে ক্ষয়িষ্ণু শালবন রয়েছে। অতীতে ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল এবং ঢাকা জেলার বৃহৎ এলাকা শালবনে ঢাকা ছিল। অভ্যন্তরীণ শালবনসমূহ ১৯৫০ সাল পর্যন্ত ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল। অবশ্য মালিকদের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে কেন্দ্রীয় বনাঞ্চলের গাজীপুর জেলার ভাওয়াল এবং টাঙ্গাইল জেলার আতিয়া ছিল বন বিভাগের আংশিক ব্যবস্থাপনাধীন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত মালিকরাই বনভূমির ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে ছিল। প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা গৃহীত হয় ভাওয়াল বনাঞ্চলে ১৯১৭ এবং আতিয়া বনভূমিতে ১৩৩৪ সালে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর বন বিভাগ এই অঞ্চলকে দুটি ওয়ার্কিং সার্কেলে বিভক্ত করে। একটি ছিল কাঠ সংগ্রহ ও রূপান্তর কার্যক্রম সার্কেল, যেখানে ৭০-৮০ বছর আবর্তে বৃক্ষ কর্তনের পাশাপাশি কৃত্রিম বনায়ন করা হতো। দ্বিতীয়টি ছিল ২৫ বছর বয়সের আবর্তে গাছকাটা এবং গাছের গোড়া থেকে নতুন গাছ বেড়ে ওঠা, যা গজারির ক্ষেত্রে দেখা যায়।

১৯৫৯ সালের পূর্বে দিনাজপুর, রংপুর এবং রাজশাহী বনাঞ্চলসমূহ ব্যক্তিমালিকানায় ছিল এবং যথেচ্ছভাবে গাছকাটা হতো। ঐ বছর বন বিভাগ একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনায় তিনটি কর্ম-সার্কেলের সুপারিশ করা হয়, যেমন- রূপান্তরিতকরণ, গজারি উৎপাদন ও বনায়ন। এই প্রকল্প পুনঃপরীক্ষণপূর্বক ১৯৭৬ সালে দুটি কর্ম সার্কেল সৃষ্টি করা হয়: সামাজিক বনায়ন কর্ম-সার্কেল ও বাণিজ্যিক কর্ম-সার্কেল। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি। বর্তমানে ৬৫% বনাঞ্চল দারুণভাবে ক্ষয়িষ্ণু অথবা অবৈধভাবে দখলকৃত।

উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলসমূহ  উপকূলবর্তী ম্যানগ্রোভ বনভূমি দুটি পৃথক অঞ্চলে বিভক্ত। ক্ষুদ্রাকৃতির অঞ্চলটি হলো চকরিয়ার সুন্দরবন। এটি কক্সবাজার জেলার মাতামুহুরী নদীর অববাহিকায় বিস্তৃত। বিগত শতাব্দীর শেষভাগে এই অঞ্চলটিকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়, যদিও ১৯১১ সাল থেকেই এই অঞ্চল বন ব্যবস্থাপনার আওতায় ছিল। ব্যাপকহারে বনজ দ্রব্যের ও মৎস্য চাষের চাহিদা বৃদ্ধির ফলে অবৈধভাবে গাছকাটা ও কৃত্রিমভাবে জলাবদ্ধতা সমস্যা দেয়া দেয়। বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে ৩,২৩৩ হেক্টর বনভূমি চিংড়ি চাষের জন্য হস্তান্তর করেছে। অনিয়ন্ত্রিতভাবে চিংড়ি চাষ এবং লবণ উৎপাদনের জন্য মৌসুমে ঘের তৈরির ফলে অবশিষ্ট বনভূমি বিরান হয়েছে।

গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকায় হুগলী নদী থেকে রাবনাবাদ দ্বীপ এলাকায় গড়ে ওঠা সুন্দরবন কোথাও কোথাও উপকূল থেকে ১৬০ কিমি অভ্যন্তরভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত। সুন্দরবনের দুই-তৃতীয়াংশ পড়েছে বাংলাদেশে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই বনভূমির আয়তন ছিল বর্তমানের দ্বিগুণ। নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এবং জনবসতি স্থাপনের ফলে বনভূমি হ্রাস পেতে থাকে এবং ১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। আয়তনের (প্রায় ৫,৭৭,২৮৫ হেক্টর) দিক থেকে অপরিবর্তিত থাকলেও সুন্দরবনে পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি ও সুন্দরি গাছের আগামরা রোগে বৃক্ষসম্পদের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বন বিভাগ উপকূলবর্তী অঞ্চল ও বৃক্ষশূন্য দ্বীপসমূহে প্রতিরক্ষাবেষ্টনী গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রথমদিকে উপকূলীয় বনায়ন কর্মসূচি গ্রহণ করে। এভাবে উপকূলীয় অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বন গড়ে ওঠে।  [সৈয়দ সালামত আলী]

বনজসম্পদ (Forest resources)  বাংলাদেশে মোট বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৬ লক্ষ হেক্টর বা দেশের মোট ভূমির প্রায় ১৮%, যার ১০% (১৫ লক্ষ হেক্টর) বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সরকারি বনভূমির পরিমাণ ১৯৪৭ সালের প্রায় ২০% থেকে ১৯৭১ সালে প্রায় ১৬%-এ হ্রাস পায়; বর্তমানে তা ৫%-এর বেশি হবে না। সরকারি বনভূমির ৯০%-এর অধিক উত্তর ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় ১২টি জেলায় বিস্তৃত। বিগত ৫০ বছরে প্রায় ৫০% বনভূমি হ্রাস পাওয়ার ফলে বাংলাদেশে বর্তমানে মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ নেমে এসেছে ০.০১৮ হেক্টর-এ, যা ১৯৭০ সালে ছিল ০.০৩৫ হেক্টর, পৃথিবীর সর্বনিম্ন মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণগুলির একটি। এসব সরকারি মালিকানাধীন সংরক্ষিত বন ছাড়াও প্রধানত বহুবিধ ব্যবহার উপযোগী বিভিন্ন বৃক্ষ, বাঁশ, বেত ও নানা ধরনের গুল্মের বসতবাড়ির বন নিয়ে গঠিত প্রায় ১০.৬৯ লক্ষ হেক্টর গ্রামীণ বন রয়েছে।

বাংলাদেশের বনসম্পদের প্রধান শ্রেণিগুলি হচ্ছে: (ক) ম্যানগ্রোভ বন (৬.৭০ লক্ষ হেক্টর), (খ) পাহাড়ি বন (৬.৭০ লক্ষ হেক্টর), (গ) সমতল ভূমির বন (১.২০ লক্ষ হেক্টর), (ঘ) অশ্রেণীকৃত রাষ্ট্রীয় বন (৭ লক্ষ হেক্টর), (ঙ) বসতবাড়ির বন (১০.৬৯ লক্ষ হেক্টর)। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশে কৃষি, মৎস্যচাষ, ঘরবাড়ি নির্মাণ ও নগরায়ণ কর্মকান্ডে বেদখলের ফলে প্রায় এক লক্ষ হেক্টর বনভূমি হ্রাস পেয়েছে। বনভূমির মধ্যে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে চট্টগ্রাম পার্বত্যাঞ্চলীয় বনসমূহে ৪৭% এবং সুন্দরবন ও পটুয়াখালী উপকূলীয় বন মিলে ২৭% রয়েছে। দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী ও রংপুর জেলাসহ উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ১%-এরও কম সরকারি বনভূমি রয়েছে। পশ্চিমাঞ্চল যেমন যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর ও বরিশালে রয়েছে ১%-এর সামান্য বেশি। কৃষি খাতের পর বন একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কার্যক্রম, যা দেশের জিডিপিতে প্রায় ৩% অবদান রাখছে।

কমপক্ষে প্রায় ১,০০০ প্রজাতির বনজ উদ্ভিদ অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ; এদের মধ্যে প্রায় ৪০০ বৃক্ষ প্রজাতি হিসেবে বিবেচিত এবং প্রায় ৪৫০ প্রজাতির ভেষজ গুরুত্ব রয়েছে। প্রায় ৫০টি বৃক্ষ প্রজাতি এবং প্রায় ১০০টি বীরুৎ ও লতাগুল্ম বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে বন খাত প্রধানত প্রাথমিক বনজ দ্রব্য উৎপন্ন করে থাকে। মন্ড, কাগজ ও বোর্ড কারখানা ব্যতীত মাধ্যমিক খাত তেমন উন্নত নয়, মূলধন বিনিয়োগও কম। দুটি প্রধান শিল্প-কাঁচামাল কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশ পাওয়া যায় প্রধানত ব্যক্তিমালিকানাধীন বনভূমি ও সরকারি ব্যবস্থাধীন বনসমূহ থেকে। সরকারি সূত্রমতে সরকারি বনভূমি থেকে প্রতিবছর ৫,৫০,০০০ ঘন মিটার কাঠের গুঁড়ি ও ৬.৫ কোটি বাঁশ পাওয়া যায়। ১৯৯৭ সালে বন খাতের মোট আর্থিক মূল্য নির্ধারিত হয়েছে ২১০০ কোটি টাকা (৫৩৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার), যার ৮০% প্রাথমিক বনজ দ্রব্য, ১১% মাধ্যমিক কাঠের গুঁড়ি প্রক্রিয়াকরণ এবং ৩% অকাষ্ঠল দ্রব্য থেকে পাওয়া যায়। সবচেয়ে বেশি অবদান রাখে করাতে ফাঁড়া কাঠ, যার পরিমাণ ৪২% (৯০০ কোটি টাকা), আর জ্বালানি কাঠের অবদান ২৭% (৫৮০ কোটি টাকা)। বাঁশ উৎপাদন থেকে আসে ১৩% (২৯০ কোটি টাকা)। কঠিন কাঠ প্রক্রিয়াকরণ, প্রধানত স’মিলিং, প্রায় ৬% এবং মন্ড ও কাগজ উৎপাদন ৪%-এর অধিক মূল্য সংযোজনে অবদান রাখে। চূড়ান্ত কাষ্ঠল শিল্প দ্রব্য উৎপাদন, প্রধানত আসবাবপত্র ও কেবিনেট তৈরি প্রায় ১% অবদান রাখে। এসব উপখাতে বর্তমানে মোট প্রায় ৮ লক্ষ ব্যক্তি নিয়োজিত রয়েছে। অবশ্য কাজের মৌসুমভিত্তিক প্রকৃতি বিবেচনায় বনসম্পর্কিত কর্মকান্ড থেকে সরাসরি সুবিধাপ্রাপ্ত লোকের সংখ্যা প্রায় ১৩ লক্ষ। কাঠের পর জ্বালানি কাঠ সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ বনজসম্পদ। মোট বনজ উৎপাদনের মধ্যে ৬৫% জ্বালানি কাঠ হিসেবে ব্যবহূত হয়। ১৯৯৫ সালে মোট বিধিসম্মত সরবরাহ ছিল ৬৫ লক্ষ ঘন মিটার, যেখানে চাহিদা ছিল ৮২.৭ লক্ষ ঘন মিটার।

পাহাড়ি বন বনজসম্পদে পরিপূর্ণ। এসব বনকে অউষ্ণমন্ডলীয় চিরহরিৎ বন, অর্ধ-চিরহরিৎ বন ও বাঁশবনে শ্রেণি বিভক্ত করা যায়। অত্যন্ত ব্যাপকভাবে জন্মানো গুরুত্বপূর্ণ কাষ্ঠল বৃক্ষের মধ্যে রয়েছে গর্জন, সেগুন, চাপালিশ, গামার, তেলসুর, জাম, জারুল, সিভিট, রক্তন, চম্পা, নারকেলি, তেলি, চন্ডাল, চিকরাশিয়া ও করই। পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বনসম্পদ রয়েছে সুন্দরবন বনাঞ্চলে। ১৮৭০ সালের দিকে নির্বাচিত বৃক্ষের কর্তন ও প্রাকৃতিক বংশ বৃদ্ধির মাধ্যমে এসব বনের সরকারি ব্যবস্থাপনা শুরু হয়।

পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের দিকে বন কেটে বৃক্ষরোপণের উদ্যোগ নেওয়া হয়। বনজ দ্রব্যের বর্ধিত চাহিদা মেটানোর জন্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এসব বন ব্যাপক হারে কাটা হয়, যা ১৯৪৭ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরও অব্যাহত থাকে। তখন দীর্ঘ (৪০ বছর) ও সংক্ষিপ্ত (২০ বছর) আবর্তন চক্র ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৯ সালে খুলনা নিউজপ্রিন্ট মিল এবং খুলনায় আরও অনেক বনশিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার পর বন ব্যবস্থাপনার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পায়। এখানের প্রধান প্রধান বনজ দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে গাছের গুঁড়ি, কাঠ, জ্বালানি কাঠ ও গোলপাতা যা সাধারণত অনুমতিপত্রের ভিত্তিতে আহরণ করা হয়।

বর্তমানে শালবনের প্রধান দুটি বিচ্ছিন্ন ক্ষয়িষ্ণু অঞ্চল অবশিষ্ট রয়েছে। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলায় রয়েছে প্রায় ১,০৫,০০০ হেক্টর আর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাসমূহকে নিয়ে গঠিত বরেন্দ্র অঞ্চলে বিচ্ছিন্নভাবে রয়েছে ১৪,০০০ হেক্টর। বন বিভাগের নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য বনাঞ্চলের সঙ্গে পার্থক্য হচ্ছে, এসব বন ১৯৫০ সালের দিকে জাতীয়করণ করা হলেও দীর্ঘকাল সরকারি ব্যবস্থাপনায় আনা হয় নি। বর্তমানে সরকারিভাবে ঘোষিত শালবন এলাকার মাঝে মাঝে রয়েছে বসতবাড়ি ও ধানক্ষেত। এসব বন প্রধানত শাল কাঠ ও গাছের গুঁড়ির সঙ্গে অন্যান্য নরম কাঠ ও জ্বালানি কাঠ সরবরাহ করে থাকে।

বাঁশ বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অকাষ্ঠল বনসম্পদ। প্রাকৃতিকভাবে বনে জন্মানো প্রায় ১০টি বাঁশ প্রজাতি একত্রে জাতীয় বনসম্পদের প্রায় ২০%। এদের মধ্যে মুলি বাঁশ (Melocanna baccifera) সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সবচেয়ে বেশি বাঁশ জন্মে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বনাঞ্চলে, তারপরই রয়েছে সিলেট পাহাড়ি বনাঞ্চলের স্থান। সারাদেশের গ্রামীণ বনাঞ্চল থেকে আসে অবশিষ্ট বাঁশ।

অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অকাষ্ঠল বনজসম্পদ প্রাকৃতিক বনকে ব্যাপক বৈচিত্র্য দিয়ে থাকে। প্রাকৃতিক বনে এসব অকাষ্ঠল বনজদ্রব্যের ব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি মোটেই সন্তোষজনক নয়। স্থানীয় লোকজন বন থেকে প্রতিদিন এ ধরনের শত শত উপাদান ব্যাপক পরিমাণে আহরণ করছে। চাল ছাউনি ও চাটাই বুননের জন্য গ্রামাঞ্চলে ছন ব্যাপকভাবে ব্যবহূত হয়। দেশে প্রায় ২০ লক্ষ বান্ডিল ছন উৎপন্ন হয়। প্রধানত পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড়ি বনের অনাচ্ছাদিত ও তৃণ অরণ্যে (savannah forests) ছন প্রচুর পরিমাণে জন্মে। সুন্দরবনের গোলপাতা (Nypa fruticans) দক্ষিণাঞ্চলীয় জেলাসমূহে ব্যাপকহারে চাল ছাউনিতে ব্যবহূত হয়। বার্ষিক উৎপাদনের পরিমাণ প্রায় ৭০ হাজার মে টন। পাহাড়ি বনে জন্মানো গুরুত্বপূর্ণ বনজসম্পদ বেত (rattan), যা বসতবাড়িতেও লাগানো যায়, আসবাবপত্র, ঝুড়ি ও সৌখিন দ্রব্যাদি তৈরিতে বেত ব্যবহূত হয়। বেতের আহরণ মাত্রা এক লক্ষ রানিং মিটার (running metre)।

প্রাকৃতিক বন ও বসতবাড়ির বন-বাদাড়ে জন্মানো নলখাগড়াজাতীয় এক ধরনের উদ্ভিদ মুর্তা (murta) শোয়ার মাদুর, থলে, ঝুড়িসহ প্রয়োজনীয় অনেক জিনিষপত্র তৈরিতে ব্যবহূত হয়। আজকাল ঝাড়ু তৈরির জন্য পাহাড়ি বনে জন্মানো ফুলঝাড়ু (Thesalonaena maxima) নামে এক ধরনের ঘাসের পুষ্পমঞ্জরি অর্থনৈতিক বনজদ্রব্য হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে। ভেষজ গুণাগুণ সম্পন্ন প্রায় ৫০০ প্রজাতির উদ্ভিদ বাংলাদেশের বনসমূহে জন্মে। উদ্ভিজ্জ রাসায়নিক (phytochemical) উপাদানের ওপর নির্ভর করে বিভিন্ন দেশজ ও লোকজ ঔষধ ফর্মুলেশন তৈরিতে এসব গাছের বিভিন্ন অংশ সংগ্রহ ও ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশে প্রায় ৫০০ ইউনানি ও আয়ুর্বেদিক ঔষধ প্রস্ত্ততকারী প্রতিষ্ঠান রয়েছে। দেশজ ঔষধের জন্য বর্তমানে প্রায় ৮০০ মে টন উদ্ভিজ্জ উপাদান ব্যবহূত হয়। বাংলাদেশের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল মোহনার বিভিন্ন ধরনের মাছ, চিংড়ি ও কাঁকড়ার আবাসস্থল। প্রতি বছর সুন্দরবন এলাকা থেকে প্রায় ১০,০০০ মে টন মাছ আহরণ করা হয়। মধু সংগ্রহকারীরা (মৌয়াল) এ বন থেকে মধু ও মোম সংগ্রহ করে; কেবল সুন্দরবন থেকেই প্রায় ১৫০ মে টন মধু সংগৃহীত হয়।  [মোস্তফা কামাল পাশা]

বনজাত দ্রব্য (Forest product)  বন থেকে প্রাপ্ত অর্থকরী সামগ্রী। পরিবেশ বিচারে বনজ সম্পদ দুই প্রকার: ১. স্থলজ বনসম্পদ; ২. উপকূলীয় বনসম্পদ। এগুলি পুনরায় কাষ্ঠল বনসম্পদ ও অকাষ্ঠল বনসম্পদ হিসেবে বিভাজ্য।

বনজ সম্পদের ভিত্তিভূমি  বনজ পরিবেশ হলো বাংলাদেশের কাষ্ঠল ও অকাষ্ঠল বনজ সম্পদের মূল উৎস। পাহাড়ি বন, সমতলভূমির বন ও উপকূলীয় বন থেকে এসব বনজ সম্পদ আহরণ করা হয়। বনজ দ্রব্যের মধ্যে রয়েছে:

গৃহনির্মাণ ও নির্মাণসামগ্রী  এ কাজে চেরা কাঠ, গাছের খুঁটি ও বাঁশ ব্যবহূত হয়। প্রায় ২৫ বছর টিকে থাকবে এই হিসেবে বাড়ি নির্মাণে মাথাপিছু বার্ষিক কাঠের ব্যবহার হলো ০.০০৬৮ ঘন মিটার।

আসবাবপত্র ও নিবন্ধ সামগ্রী  এক্ষেত্রে রয়েছে নানা ধরনের অজস্র সামগ্রী। আসবাবের মাথাপিছু আজীবনের জন্য পরিমাণ হলো ০.০৬৬৪ ঘন মিটার এবং আসবাব ২৫ বছর টেকসই থাকবে এই হিসেবে বার্ষিক মাথাপিছু কাঠ ব্যবহারের পরিমাণ হলো ০.০০২৬ ঘন মিটার।

পরিবহণ সরঞ্জাম  গরুর গাড়ি, মহিষের গাড়ি, নৌকা, রিক্সা, ভ্যান, ঠেলাগাড়ি, পালকি, ডুলিসহ প্রায় সকল গ্রামীণ পরিবহণ তৈরিতে কাঠই প্রধান উপকরণ। বাস, ট্রাক, লঞ্চ ও জাহাজের মতো আধুনিক যান্ত্রিক পরিবহণ নির্মাণেও কাঠ ব্যবহূত হয়। এতে মাথাপিছু বিন্যস্ত গড় ওজন ০.০০৭২ ঘন মিটার। এসব যানবাহনের আয়ুষ্কাল ২০ বছর ধরলে মাথাপিছু বার্ষিক পরিভোগ ০.০০০৩৬ ঘন মি।

কৃষিসরঞ্জাম  প্রচলিত কৃষি যন্ত্রপাতির ও হাতিয়ারের প্রায় সবই কাঠনির্মিত। বিন্যস্ত গড় পরিমাপ ০.০২৭৬ ঘন মিটার। এগুলি ২০ বছর টিকবে ধরলে মাথাপিছু বার্ষিক পরিভোগ দাঁড়ায় ০.০০১৪ ঘন মিটার।

মন্ড, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট  বনভিত্তিক শিল্পের মধ্যে মন্ড, কাগজ ও নিউজপ্রিন্ট উৎপাদনের গুরুত্ব সর্বাধিক। বাংলাদেশে রয়েছে ৩টি কাগজকল: কর্ণফুলি কাগজকল (KPM), উত্তরবঙ্গ কাগজকল (NBPM) ও সিলেটের সোনালী কাগজ ও বোর্ড মিল, মন্ড ও কাগজ কল। এসব মিল মানসম্মত কাগজ ও কাগজবোর্ড উৎপাদন করে। দেশের একমাত্র নিউজপ্রিন্ট মিল খুলনায় অবস্থিত। উত্তরবঙ্গ কাগজকল ছাড়া বাকি সবগুলি কাগজকলে কাঁচামাল হিসেবে কাঠ ও/বা বাঁশের মন্ড ব্যবহূত হয়। নিউজপ্রিন্ট ও অন্যান্য কাগজের বার্ষিক মাথাপিছু ব্যবহার যথাক্রমে ০.৪৩৭৫ কেজি ও ০.৫৬০২ কেজি।

কাঠভিত্তিক প্যানেল সামগ্রী  এগুলি হলো কাঠ বা কাঠের উপজাত (কাঠের গুঁড়া) দিয়ে তৈরি হার্ডবোর্ড, পার্টিকেল বোর্ড, প্লেইন উড-টেক্সট, ভ্যানিয়ার বোর্ড, প্লাইউড, ফ্লাশ দরজা-জানালার মতো নানা ধরনের প্রায় পূর্ণাঙ্গ ও মাধ্যমিক কাঠসামগ্রী। সরকারি ও বেসরকারি উভয় খাতেই এগুলি উৎপন্ন হয়। এসব ইউনিটে চেরা কাঠের বার্ষিক গড় চাহিদা প্রায় ৯৭,০০০ ঘন মিটার।

জ্বালানি ও জ্বালানি কাঠ  মোট জ্বালানি ও জ্বালানি কাঠের ৮০%-এর অধিক বন থেকে সংগ্রহ করা হয়। জ্বালানির ৮৫% গ্রামাঞ্চলে ও ১৫% শহরাঞ্চলে ব্যবহূত হয়। জ্বালানি কাঠ ছাড়া সব ধরনের কাঠই ইটভাটার মতো ক্ষুদ্র শিল্পের চুল্লিতে জ্বালানো হয়। দেশের জ্বালানি কাঠের নির্ধারিত চাহিদা বছরে প্রায় ৭,৯৭৫.৪৯ হাজার ঘন মিটার।

রাবার  রাবার একটি একজাতীয় (monotype) বনজ উৎপাদ। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, সিলেট ও মধুপুর এলাকায় কয়েকটি রাবার বাগান রয়েছে। বাংলাদেশে ১৯৯৭-৯৮ ও ১৯৯৮-৯৯ সালে রাবার উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ২,৯৬৬.৫৮ ও ৩,১০১.২১ হাজার কিলোগ্রাম।

অন্যান্য কাঠ ও বনজসামগ্রী  কাঠজাত অন্যান্য দ্রব্যের মধ্যে দেশলাই শিল্প অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও রয়েছে পেন্সিল, শ্লেট, স্কেল ও পুতুল তৈরির শিল্প এবং বিদ্যুৎ ও টেলিফোনের খুঁটি, বস্ত্র ও পাট কলের যন্ত্রাংশ ইত্যাদি। তদুপরি, কিছু বনভিত্তিক ক্ষুদ্র কারখানা কুটির শিল্পসামগ্রীও প্রস্ত্তত করে।  আহরিত মধুর ৫০ শতাংশের অধিক আসে বন থেকে। সুন্দরবন থেকে আসে প্রচুর পরিমাণে চাল ছাউনি দেওয়ার গোলপাতা।

নন-টিম্বার বনজ উৎপাদন  বনের কাঠ ছাড়াও নানা ধরনের গাছ, গাছের অংশ এবং অন্যান্য দ্রব্য কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহূত হয়। অনেকগুলি ক্ষুদ্রশিল্প, সরকারি ও বেসরকারি হস্তশিল্প এবং কুটিরশিল্প নন-টিম্বার বনজ দ্রব্যের ওপর নির্ভরশীল। এসব উৎপন্ন দ্রব্যের অনেকগুলি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করা হচ্ছে। প্রতিবছর এ রপ্তানি থেকে অর্জিত হচ্ছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। এসব শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে বহুলোক। কতিপয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নন-টিম্বার বনজ উদ্ভিদ ও উদ্ভিদদ্রব্যের মধ্যে রয়েছে বাঁশ (ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র ও ব্যবহার্য দ্রব্য নির্মিত হয়), বেত (আসবাবপত্র এবং অন্যান্য বিলাস দ্রব্য তৈরি হয়), ছন (ঘরের চাল/ছাউনি দেওয়া হয়), পাটিপাতা ও হোগলা (মেঝের মাদুর তৈরি হয়), গোলপাতা (ঘরের ছাউনি দেওয়া হয়), মধু (প্রধানত সুন্দরনে পাওয়া যায়), গেওয়া কাঠ (খুলনা কাগজকলে নিউজপ্রিন্ট তৈরি হয়) এবং বহুবিধ ঔষধি গাছ (যেমন আমলকি, বহেড়া, হরীতকী, সর্পগন্ধা, কুরচি, অর্জুন, বাসক, শতমূলী, আকন্দ, ডুমুর, উলট চন্ডাল, অনন্তমূল, তুলসী, নিসিন্দা ইত্যাদি)।  [মোঃ মাহফুজুর রহমান]

আরও দেখুন দারুবৃক্ষ; মন্ড

বন ব্যবস্থাপনা (Forest managenent)  ব্রিটিশ শাসন শুরুর আগে উপমহাদেশের কোথাও বন সংরক্ষণের বিজ্ঞানসম্মত কোন উদ্যোগ গৃহীত হয় নি। এমনকি ব্রিটিশ শাসনের গোড়ার দিকেও সাধারণের চাহিদা মিটানোর জন্য বনকে যথেচ্ছভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে। ব্রানডিস ১৮৬২ সালে বার্মা (মায়ানমার) থেকে দিল্লি যাবার পথে বঙ্গদেশের অরণ্যের একাংশ পরিদর্শনকালে এই অঞ্চলের বনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একটি বক্তব্য প্রস্ত্তত করেছিলেন, আর এ থেকেই বাংলাদেশের বনব্যবস্থাপনার সূত্রপাত। কলকাতা বোটানিক গার্ডেনের তত্ত্বাবধায়ক অ্যান্ডারসন ১৮৬৪ সালে বাংলার নিম্নাঞ্চলীয় প্রদেশসমূহ ও আসামে (বর্তমানে যার একাংশ বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত) প্রথম বনসংরক্ষক নিযুক্ত হন। তাঁর পরিচালিত প্রাথমিক অনুসন্ধান থেকেই প্রথম বনাঞ্চল সংরক্ষণ ব্যবস্থা গৃহীত হয়। ১৮৭১ সালে পার্বত্য বনের প্রায় ১৪,৬৮৫ বর্গ কিলোমিটার নিয়ে সরকারি বন এবং ১৮৭৫ সালে প্রথম সংরক্ষিত বন ঘোষণা করা হয়। প্রথম সংরক্ষিত বন হলো সীতাপাহাড় (বর্তমানে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বিভাগের অধীন) ও সুন্দরবন।

বন বিভাগ বার্মা থেকে আনা বীজের সাহায্যে ১৮৭১ সালে প্রথম সেগুন বন সৃষ্টির উদ্যোগ গ্রহণ করে। স্যার উইলিয়ম শিলিক (Sir William Schillich) ১৮৭৫ সালে সেগুন বনটি পরিদর্শন করেন, যা বাংলাদেশে বিজ্ঞানসম্মত বন ব্যবস্থাপনার ইতিহাসে আরেকটি মাইলফলক হয়ে আছে। ১৮৬৫ সালে প্রথম বন আইন প্রবর্তিত এবং ১৮৭৮ সালে সংশোধিত হয়, আর ১৯২৭ সালে পুনঃসংশোধিত বন আইন এখনও বলবৎ রয়েছে।

বন বিভাগের অধীন বনাঞ্চল প্রধানত তিন শ্রেণিতে বিভক্ত: ১. গ্রীষ্মমন্ডলীয় চিরসবুজ ও আধা-চিরসবুজ প্রজাতির পার্বত্য বন; ২. স্থানীয়ভাবে সুন্দরবন নামে পরিচিত বদ্বীপ অঞ্চলের জোয়ারবিধৌত ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য প্রজাতির বন; ৩. নিম্নশ্রেণীর শালগাছ (Shorea robusta) এবং অন্যান্য চিরসবুজ ও পত্রমোচী (deciduous) প্রজাতিসহ দেশের অভ্যন্তরীণ শালবন।

১৮৯২ সালে সুন্দরবনের (জোয়ারবিধৌত বন) জন্য বাংলাদেশে প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণীত হয়। পার্বত্য বনের জন্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রণীত হয় বিশ শতকের শুরুতে, আর শালবনের জন্য আরও অনেক পরে।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পার্বত্য বনের পূর্ব ও উত্তরপূর্ব অংশ এবং বাংলার অশ্রেণীকৃত সরকারি বন, আসামের কিছু অংশ, সমতলের শালবন এবং সুন্দরবনের অধিকাংশ অঞ্চল বাংলাদেশের (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান) ভূখন্ডে পড়ে। মূল্যবান প্রজাতির বৃক্ষরোপণ এবং কাঠ আহরণ ছিল ব্যবস্থাপনার প্রধান দিক। অতিদুর্গম এলাকা থেকে কাঠ আহরণের উদ্দেশ্যে বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের গোড়ার দিকে বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন স্থাপিত হয়। ঐ দশকের মাঝামাঝি বৃক্ষরোপণ নির্ধারিত কয়েকশ হেক্টর থেকে ৪,০০০ হেক্টরে উন্নীত হয়। রাবার, কাজুবাদাম ইত্যাদি বেশ কিছু অর্থকরী ফসলের চাষও শুরু হয়। ষাটের দশকের শেষের দিকে সরকার বঙ্গোপসাগরের নতুন জেগে ওঠা চরাঞ্চলে উপকূলীয় বনায়ন উদ্যোগ গ্রহণ করে। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বননীতি প্রণীত হয়।

বনব্যবস্থাপনা পরিস্থিতি  গাছ কেটে বন পরিষ্কার করে ৬০ বছর (দীর্ঘ পর্যায়) ও ৩০ বছর (স্বল্প পর্যায়) মেয়াদি পর্যায়ে কৃত্রিম বনায়নে মূল্যবান জাতের বৃক্ষরোপণ পদ্ধতিতেই পার্বত্য বন ব্যবস্থাপনা পরিচালিত। বাঁশের চাষ করা হয় এককভাবে বা বনে অন্যান্য বৃক্ষের নিচে।

অভ্যন্তরীণ শালবনের ব্যবস্থাপনা ২৫ বছর মেয়াদি পর্যায়ে গাছের পার্শ্বচারা (coppice) বৃদ্ধি পদ্ধতিতে পরিচালিত। শালগাছ অপেক্ষাকৃত কম এমন স্থানে সব গাছ কেটে শাল ও অন্যান্য উপযোগী বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনায়ন পরিচালিত হয়ে থাকে।

বিশ বছর মেয়াদে নির্বাচিত গাছ কেটে প্রাকৃতিক বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে জোয়ারবিধৌত বনের ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয়। উপকূলীয় ভূমি, তীরবর্তী দ্বীপ ও নতুন জেগে ওঠা স্থলভাগ বনায়নে বিগত ৩ দশক যাবৎ ম্যানগ্রোভ ও অন্যান্য উপযোগী জাতের বৃক্ষরোপণ চলছে।

বনব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা  পার্বত্য বন: ১. আর্থিকভাবে অলাভজনক গাছের বদলে মূল্যবান ও দ্রুতবর্ধনশীল প্রজাতির গাছ লাগিয়ে বিদ্যমান অবিন্যস্ত বনকে সুবিন্যস্ত বনে পরিণত করা; ২. পাহাড়ি বন উজাড়, ভূমিক্ষয় ও নদীতে পলিপাত রোধ; ৩. বনসম্পদ বৃদ্ধির জন্য বিরানভূমিতে বনায়ন; ৪. বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও বৃদ্ধি এবং ৫. টেকসই উৎপাদন নীতি অনুসরণের মাধ্যমে সর্বাধিক আর্থিক সুফল অর্জন।

জোয়ারভাটা অঞ্চলের বন: ১. বনসংরক্ষণ ও বিভিন্ন বয়সের গাছের সমন্বয়ের মাধ্যমে বনকে ক্রমান্বয়ে সুবিন্যস্ত বনে পরিণত করা; ২. ভূমি পুনরুদ্ধারের জন্য নবগঠিত অঞ্চলে বনায়ন; ৩. স্থানীয় জনসাধারণ ও শিল্পগুলিতে কাঠ, জ্বালানিকাঠ, মন্ড, ঘরের চাল ছাউনির সামগ্রী ও অন্যান্য অপ্রধান বনজ দ্রব্যের অব্যাহত সরবরাহ নিশ্চিত করা।

অভ্যন্তরীণ শালবন: ১. বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনাসহ বিভিন্ন বয়সের গাছ লাগিয়ে অবিন্যস্ত বনের ক্রমাগত রূপান্তর সাধন; ২. ঘরের বড় খুঁটি ও জ্বালানিকাঠ সরবরাহ; ৩. বিনোদনের সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলা।  [সৈয়দ সালামত আলী]

বন আইন ও বননীতি (Forest acts and policies)  মুগল আমলে (১২০৩-১৫৩৮) স্থানীয় রাজারা বন ইজারা দিতেন। ১৮৬০ সালে ভারতের বঙ্গপ্রদেশে বন বিভাগ স্থাপিত হওয়ার পর বনসমূহের একটি সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা চালু হয়। বন সম্পর্কিত কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য বহু বছর ধরে বিধিবিধান প্রণয়ন, সংশোধন, পরিবর্তন ও উন্নয়ন করা হয়। এসব বিধিবিধান দীর্ঘকাল প্রচলিত আইন ও নীতির ভিত্তিতে প্রণীত।

বননীতি  ১৮৯৪ সালের জাতীয় বননীতিতে দেশে বনব্যবস্থাপনার জন্য আইন ও বিধিবিধান প্রণয়নের মৌলিক দিকনির্দেশনাসমূহ রয়েছে। ব্রিটিশ ভারত সরকার কর্তৃক ১৮৫৫ সালের ভারতীয় বনসমূহের ওপর জারিকৃত সনদ বনসম্পদ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রথমবারের মতো তুলে ধরে। এই সনদ জারির আগে রাজস্ব সংগ্রহের জন্য গাছকাটার ব্যাপারে যৎসামান্য বিধিবিধান বলবৎ ছিল। ১৮৯৪ সালে ঘোষিত প্রথম বননীতির বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ: ১. নিকটবর্তী জনগণের অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জনকল্যাণার্থে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বনসমূহের পরিচালনা; ২. বনসমূহ যেভাবে শ্রেণিভুক্ত করা হয় পার্বত্য বন/সুরক্ষিত বন; অর্থনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ/ উৎপাদনশীল বন; অপ্রধান বন; পশুচারণভূমি; ৩. ভাটির দিকের সমতলভূমির কৃষিজমি রক্ষার্থে পর্বতের ঢালু অঞ্চলে অবস্থিত বনসংরক্ষণ; ৪. রাষ্ট্রের রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সমৃদ্ধ বনগুলির সুব্যবস্থাপনা; ৫. বনের অভ্যন্তরীণ চাষোপযোগী জমি থাকলে বনের ক্ষতি না করে সেগুলি চাষের ব্যবস্থা করা; ৬. স্বল্প উৎপাদনশীল বনে স্থানীয় জনগণের পশুচারণের অধিকার প্রদান করা।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর নবসৃষ্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের (বাংলাদেশ পাকিস্তানের একটি অংশ ছিল) জন্য এই নীতি সঙ্গতিপূর্ণ ছিল না, কারণ পাকিস্তানভুক্ত বনাঞ্চলের পরিমাণ ছিল দেশের মোট আয়তনের ২ শতাংশেরও কম। বনাঞ্চল বৃদ্ধির পরিকল্পনা বা বিদ্যমান বনসমূহের টেকসই ব্যবহার কোনটাই পূর্বোক্ত বননীতিতে ছিল না। অধিকন্তু ব্যক্তিমালিকানাধীন বনগুলি এই বননীতির আওতামুক্ত ছিল। ১৯৪৯ সালে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান বন সম্মেলনে এসব ত্রুটি স্বীকৃত হয়। এই সম্মেলনের দিকনির্দেশনার আলোকে ১৮৯৪ সালের নীতিগত বিবৃতির উৎকর্ষ সাধিত হয় এবং বননীতি ১৯৫৫ ঘোষণা করা হয়।

১৯৫৫ সালের বননীতি আরও সংশোধন করে ১৯৬২ সালের বননীতি চালু করা হয়। ১৯৫৫ ও ১৯৬২ সালের বননীতিতে বনজ দ্রব্য, বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) বনজ সম্পদ সদ্ব্যবহারের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়। এই নীতিগুলি বাংলাদেশে বনোন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয় নি। তদুপরি, জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে খাদ্য ও অন্যান্য আবশ্যকীয় দ্রব্যাদির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে বনভূমির ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে, ফলে পরিবেশের অবনতি ঘটে। বাংলাদেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করলেও ১৯৭৯ সালের পূর্বে জাতীয় বননীতি ঘোষিত হয় নি।

১৯৭৯ সালের বননীতি খুবই সাধারণ ও অস্পষ্ট। বনভূমির কার্যকর শ্রেণিবিন্যাস ও ব্যবহার, টেকসই জৈবিক উৎপাদনশীলতার বাস্ত্তসংস্থানিক ভিত্তি হিসেবে বনের ব্যবহার, বনায়নে জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলি বননীতিতে উল্লেখ করা হয় নি। ১৯৭৯ সালের বননীতির ত্রুটিসমূহ দূর করতে সরকার উক্ত বননীতি সংশোধনের সিদ্ধান্ত নেয় এবং ১৯৯৪ সালের বননীতি হিসেবে পরিচিত সংশোধিত বননীতি ১৯৯৫ সালের ৩১ মে সরকার কর্তৃক অনুমোদিত হয়। ১৯৯৪ সালের বননীতি সংশোধনকালে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি বিবেচিত হয়: সংবিধানে উল্লিখিত জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত অনুচ্ছেদসমূহ; পরিবেশসহ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে বনের ভূমিকা; কৃষি, শিল্প, কুটিরশিল্প ও অন্যান্য খাত সম্পর্কিত জাতীয় নীতি; পরিবেশ ও বন সম্পর্কিত সংশ্লিষ্ট চুক্তি, প্রটোকল ও সমঝোতা।

আইনসমূহ  বাংলাদেশে বন আইন প্রণয়ন সেই ১৮৬৫ সালের ঘটনা যখন ভারতীয় বন আইন প্রথম প্রণীত হয়। এতে বৃক্ষসংরক্ষণ, অগ্নিসংযোগরোধে বনাঞ্চলে চাষাবাদ ও পশুচারণ নিষিদ্ধ করার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯২৭ সালে একটি পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় বন আইন প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ ভারতে বন প্রশাসন সম্পর্কিত নিম্নবর্ণিত কতিপয় আইন ও সংশোধনী কার্যকর করা হয়: ভারতীয় বন আইন, ১৮৭৩; বন আইন, ১৮৯০; সংশোধনী আইন, ১৮৯১; ভারতীয় বন (সংশোধন) আইন, ১৯০১; ভারতীয় বন (সংশোধন) আইন, ১৯১১; বাতিলকরণ ও সংশোধনী আইন, ১৯১৪; ভারতীয় বন (সংশোধন) আইন, ১৯১৮ এবং বিকেন্দ্রীকরণ আইন, ১৯২০।

বন আইন, ১৯২৭  ১৯২৭ সালের বন আইন সংশোধিত রূপ এবং সংশ্লিষ্ট বিধিবিধানসহ এখনও বাংলাদেশে বন পরিচালনার মৌলিক আইন হিসেবে রয়ে গেছে। সংরক্ষিত বন সুরক্ষার ওপর এই আইনে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। এই আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য নিম্নরূপ: বন আইনের অধীনে বনভূমির ওপর সকল অধিকার ও দাবি সংরক্ষণের সময় নিষ্পত্তি করা হয়েছে। এই আইনে যে-কোন ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠিকে কোন ধরনের নতুন অধিকার প্রদান নিষিদ্ধ; বন বিভাগের অনুমতি ব্যতীত সংরক্ষিত বনের অভ্যন্তরে যে-কোন কর্মকান্ড নিষিদ্ধ; অধিকাংশ আইনের লঙ্ঘনই আদালতে মামলাযোগ্য এবং সর্বনিম্ন শাস্তি ২,০০০ টাকা জরিমানা এবং/অথবা দুই মাসের সশ্রম কারাদন্ড; এই আইন সংরক্ষিত বনের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত জলস্রোতের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বন বিভাগকে প্রদান করেছে।

১৯২৭ সালের বন আইনের একটি সংশোধিত খসড়া ১৯৮৭ সালে প্রণয়ন করা হয় এবং তা ১৯৮৯ সালে বন (সংশোধন) অধ্যাদেশ ১৯৮৯ হিসেবে অনুমোদিত হয়। ২০০০ সালে পুনরায় সংশেধিত বন আইনের নতুন নামকরণ হয় বন (সংশোধন) আইন, ২০০০। সংশোধনের মাধ্যমে এই আইনের কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সাধন করা হয়।

সংরক্ষণের স্বার্থে সরকার কর্তৃক বেসরকারি বন ও পতিত জমির নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের জন্য ১৯৪৫ সালের বেঙ্গল প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাক্ট পাস হয়েছিল, কিন্তু ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির ফলে তা বাধাগ্রস্ত হয় এবং আইনটি কার্যকর করা যায় নি। অতঃপর ১৯৪৯ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বেঙ্গল প্রাইভেট ফরেস্ট অ্যাক্টের বিধিবিধানসমূহ পুনরায় চালু করে। এই একই আইন কতিপয় কৌশলগত কারণে ১৯৫৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান বেসরকারি বন অধ্যাদেশ হিসেবে পাস হয়। সরকারকে অধিগ্রহণকৃত বেসরকারি বন ও পতিতজমি একটি নির্দিষ্ট আইনের আওতায় অর্থাৎ অর্পিত বন হিসেবে পরিচালনা করতে হয়েছিল। অর্পিত বনের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণের বিস্তারিত শর্তাবলীসহ এই অধ্যাদেশে ৬৪টি অনুচ্ছেদ ছিল। অর্পিত বনগুলি সংরক্ষণ ও বনায়নের উদ্দেশ্যে ব্যক্তিমালিকদের কাছ থেকে সরকার একশ বছরের জন্য বন্দোবস্ত নিয়েছিল, কেননা মালিকরা এগুলি দেখাশোনা করতো না।

বনসংক্রান্ত আইনকানুনে বননীতির লক্ষ্যসমূহ পূরণে উদ্বুদ্ধকরণ এবং এক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা নিরুৎসাতি করতে শাস্তি প্রদান দুটি দিকই বর্ণিত হয়েছে। আনুগত্যের জন্য প্রণোদনা এবং অমান্যকরণ প্রশমনের জন্য শাস্তি দান এই দুটিই বর্ণিত আছে। এভাবে বিধিবিধান বননীতির কার্যকর বাস্তবায়নে ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

পুরাকালে ভারত উপমহাদেশের বনগুলি জনগোষ্ঠীর চাহিদা পূরণ, রাজকীয় হস্তিকুল ও সর্বসাধারণের গবাদিপশু চারণের জন্য সংরক্ষণ করা হতো। মধ্যযুগে স্থানীয় শাসকরা বিশেষ কিছু মূল্যবান দারুবৃক্ষ প্রজাতিকে ‘রাজবৃক্ষ’ ঘোষণা করতেন। অবশ্য অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ পর্যন্ত উপমহাদেশের বনসমূহ সবাই অবাধে ব্যবহার করতে পারতো। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে ব্রিটিশ উপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় বন বিভাগ এ অঞ্চলের বনের ওপর একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। বনউজাড় রোধ করতে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা সর্বাধিক কার্যকর পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। উদাহরণ হিসেবে, ১৮৭৮ সালের আইনে বনসমূহকে ৩টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা হয়: (ক) সংরক্ষিত বন (Reserved forests) সরকার নিয়ন্ত্রিত, স্থানীয় জনসাধারণের প্রবেশাধিকার (ভোগাধিকার) নেই; (খ) সুরক্ষিত বন (Protected forest) অকাষ্ঠল বনজ দ্রব্যে জনসাধারণের প্রবেশাধিকার (ভোগাধিকার) সীমিত এবং (গ) গ্রামের বন স্থানীয় চাহিদা পূরণের জন্য। প্রথম উপনিবেশিক বননীতি (১৮৯৪ সাল) বেসরকারি বনসহ সকল বন অধিগ্রহণের ক্ষমতাপ্রদানের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে। প্রায় অর্ধশতাব্দী পর সদ্য-স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তানের সরকার ঐ উপনিবেশিক মডেল অনুসরণের মাধ্যমে বনের ওপর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা অধিকতর জোরদার করে।

স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশে প্রণীত প্রথম বননীতিতে জ্বালানি কাঠের জোগান ও কাঠ-উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। বিশ শতকের নববইর দশকের গোড়ার দিকে দেশের মোট ভূমির ২০% বৃক্ষ আচ্ছাদিত করার লক্ষ্যে একটি ২০-সালা (১৯৯৩-২০১২) বনখাত মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। এই পরিকল্পনার ৩টি প্রধান কর্মসূচি হলো (ক) বন তৈরি ও ব্যবস্থাপনা; (খ) কাঠভিত্তিক শিল্প এবং (গ) অংশগ্রহণমূলক বনায়ন। বনমহাপরিকল্পনার ২টি কর্মসূচির মধ্যে অত্যুচ্চ উন্নয়ন কর্মসূচি হিসেবে বনখাতে প্রায় ২০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।

সর্বশেষ বননীতিতে (১৯৯৪) ৩টি বিভাগ রয়েছে: (১) বন উন্নয়নের বিবেচিত পূর্বশর্তে রয়েছে: (ক) জনগণ, বিশেষত জীবিকার জন্য বননির্ভর লোকদের মধ্যে মুনাফার ন্যায়সঙ্গত বণ্টন; (খ) বনায়ন কর্মসূচিতে জনগণের অংশগ্রহণ এবং পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ। (২) বননীতির জনকেন্দ্রিক লক্ষ্যসমূহ: (ক) গ্রামীণ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি ও বনভিত্তিক পল্লী উন্নয়ন খাতগুলি সম্প্রসারণ এবং (খ) জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বনভূমির অবৈধ দখল ও বন সম্পর্কিত অন্যান্য অপরাধ রোধ। (৩) নীতির লক্ষ্য ঘোষণায় রয়েছে: (ক) স্থানীয় জনগণ ও এনজিও-র সঙ্গে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে প্রান্তিক সরকারি ভূমিতে ব্যাপক বনায়ন; (খ) জনগণ ও এনজিও-র অংশগ্রহণের মাধ্যমে কৃষি বনায়ন মডেলে উজাড়কৃত/দখলকৃত সংরক্ষিত বনসমূহে বনায়ন; (গ) বন বন্দোবস্ত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আদিবাসী জনগণকে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বনভূমির মালিকানা প্রদান; (ঘ) বনবিভাগের শক্তিবৃদ্ধি ও ‘সামাজিক বনায়ন বিভাগ’ নামে একটি নতুন বিভাগ সৃষ্টি; (ঙ) শিক্ষা, প্রশিক্ষণ ও গবেষণা সুবিধা জোরদার করা এবং (চ) বনখাত সম্পর্কিত আইন ও বিধিবিধান সংশোধন এবং প্রয়োজনে নতুন আইন ও বিধি প্রণয়ন। এভাবে কালক্রমে বননীতি সার্বিক রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে কিছু নির্দিষ্ট শ্রেণির বনের ব্যবস্থাপনায় জনগণকে সম্পৃক্তকরণের দিকে অগ্রসর হতে চলেছে। [সৈয়দ সালামত আলী এবং মিজান আর খান]

বন ও বনজসম্পদ অবনতি (Forest and forest resources degradation)  বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে ব্যাপক হারে বন ও বনজ সম্পদ ক্ষয় হচ্ছে। ইউনেস্কো ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক পরিচালিত জরিপে ১৯৭৬ ও ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে বনভূমির পরিমাণ মোট ভুখন্ডের যথাক্রমে ১০.৫ শতাংশ ও ৯.০ শতাংশ ছিল বলে জানা যায়। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের ৬.৯ শতাংশ বা ১০ লাখ হেক্টর এলাকা বন আচ্ছাদিত। অর্থাৎ গত ২০ বছরে এদেশে বন এলাকা সঙ্কুচিত হয়েছে ৫০ শতাংশ। কিন্তু বন বিভাগের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বর্তমানে বন এলাকার পরিমাণ ৮ লাখ ৪০ হাজার একর বা মোট ভূখন্ডের ৫.৮ শতাংশ। খাদ্য ও কৃষি সংস্থা ও ইউএনইপি-এর হিসাব অনুসারে, বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ০.৮৩ শতাংশ হারে বন উজাড় হচ্ছে। এদেশে বর্তমানে মাথাপিছু বন আচ্ছাদিত এলাকার পরিমাণ ০.০২ শতাংশ যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন।

বন ও বনজসম্পদ ক্ষয়ের কারণ বহুবিধ। দ্রুত বন উজাড়ের কারণগুলির মধ্যে রয়েছে জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং দারিদ্র্য। বিভিন্ন উপায়ে বন ধ্বংস হচ্ছে, যথা অনিয়ন্ত্রিত হারে বনউজাড়, নতুন নতুন জনবসতি স্থাপন, অবৈধ বৃক্ষনিধন, গাছের পাতা ও ডালপালা হরণ, জ্বালানির জন্য বনের কাঠের ওপর নির্ভরশীলতা, গবাদি পশু চারণ, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে বন পোড়ানো, জুমচাষ, কতিপয় শস্য ও ফলমূলের বাণিজ্যিক চাষাবাদের জন্য বনভূমিকে কৃষি জমিতে রূপান্তর, অর্থনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ গাছপালা অধিক হারে সংগ্রহ, যেমন, ঔষধি গাছগাছড়া, গবাদি পশুর খাদ্য, রং, ইটের ভাটা ও অন্যান্য ক্ষুদ্রশিল্পের জ্বালানি হিসেবে  কাঠের ব্যাপক ব্যবহার, গৃহস্থালির প্রয়োজনে ভূমিস্থ সবুজ আচ্ছাদনের সম্পূর্ণ বিনাশ এবং বনজ দ্রব্যের অতিরিক্ত ব্যবহার। এছাড়াও ব্যাপক বৃষ্টিপাত, ভূমিধ্বস, ভূমিক্ষয়, বন্যা, সাইক্লোন, টর্নেডো, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কিছু জটিল রোগও (যেমন গাছের আগামরা রোগ) বনভূমি ও বনজ সম্পদ হ্রাসের উল্লেখযোগ্য কারণ। এছাড়া উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণ ও সচেতনতার অভাব, উদ্ভিদ ও জীবজন্তুর স্বাভাবিক লালনক্ষেত্র ও সম্পদ পুনরুৎপাদন সম্পর্কে গবেষণা কর্মকান্ড ও উন্নয়ন কর্মসূচির অপ্রতুলতা, পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয় উদ্যোগের অভাব ইত্যাদিও বাংলাদেশের বন ও বনজ সম্পদ ক্ষয়ের অন্যতম কারণ। কখনও কখনও বনের ধরন ও ভৌগোলিক অবস্থানভেদে বন উজাড়ের মাত্রা ও প্রকৃতির মধ্যে পার্থক্য ঘটে। উদাহরণস্বরূপ, বাংলাদেশের মধ্য ও উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত শালবনগুলি বহুলাংশে শুষ্ক ও সমতল ধরনের। ভৌগোলিক অবস্থান ও পরিবেশগত কারণে সহজে প্রবেশসাধ্য এবং বসতি স্থাপনের যোগ্য বলে এগুলি বিনাশের সুযোগ অপেক্ষাকৃত বেশি।  [মোঃ মাহফুজুর রহমান]

বনজ বৃক্ষের রোগবালাই (Pests and diseases of forest trees) মানুষের ফসল বা সম্পদ বিনষ্টকারী যে-কোন জীব, সাধারণত কীটপতঙ্গ বা অন্য কোন প্রাণীকে বলা হয় বালাই, অন্যদিকে রোগ হলো একটি উদ্ভিদের জৈবিক ক্রিয়া বা গঠনের অস্বাভাবিক পরিবর্তন যা সাধারণত রোগজীবাণু (ছত্রাক, ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস প্রভৃতি) দ্বারা ঘটে থাকে। রোগবালাই একটি বনজ বাস্ত্তসংস্থানের অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাভাবিক বৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বনজ বৃক্ষকে রোগবালাইয়ের ক্ষয়ক্ষতি থেকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে। বাংলাদেশে বনজ বৃক্ষের সাধারণ রোগ বালাই নিম্নে উল্লেখ করা হলো:

বালাই (Pests)  কাটুইপোকা (cutworm) হিসেবে পরিচিত মথের (Agrotis ipsilon) লার্ভা সাধারণ Pinus caribaea, P. oocarpa- এর মতো বেশ কিছু বনজ বৃক্ষের চারা খেয়ে থাকে। দিনের বেলায় এরা ৩-৮ সেমি গভীর মাটির গর্তে লুকিয়ে থাকে এবং রাতে মাটির উপরে উঠে আসে। এরা চারা গাছের কান্ড মাটির সমতলে কেটে দেয়, আবার কোন কোন ক্ষেত্রে কুঁড়ি বা কচি পাতাও কেটে ফেলে। এরা চারার কাটা অংশ গর্তে নিয়ে যায় এবং সেখানে বসে খায়।

কিছু বিটল যেমন Leucopholis, Holotrichia, ও Anomala (Scarabaeidae: Coleoptera) কখনও কখনও সেগুন (Tectona grandis), রাবার (Hevea brasiliensis), বাবলা (Acacia nilotica), জারুল (Lagerstroemia speciosa), মিনজিরি (Cassia siamia) প্রভৃতি গাছের চারার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। লার্ভা ছোট ছোট মূল খায় এবং অনেক ক্ষেত্রে মাটির ৫-১০ সেমি নিচে প্রধানমূল কেটে দেয়। আক্রান্ত চারা নেতিয়ে পড়ে এবং শেষ পর্যায়ে শুকিয়ে যায়। বয়স্ক পোকা অনেক গাছের পাতা-পল্লব খেয়ে থাকে।

কিছু উইপোকা যেমন Odontotermes ও Microcerotermes (Termitidae: Isoptera) নার্সারিতে ছোট চারা, কলমের মাধ্যমে তৈরি গাছ এবং অনেক বনজ বৃক্ষের রোপিত চারা আক্রমণ করে। উইপোকার আক্রমণ দেখা যায় ভূ-পৃষ্ঠের ঠিক নিচে মাটির উপরের স্তরের ১২ সেমি এর মধ্যে। সাধারণত গাছের প্রধানমূলের বাকল চক্রাকারে সম্পূর্ণরূপে খেয়ে ফেলে। আক্রান্ত চারা/ছোট গাছ নেতিয়ে পড়ে ও মারা যায়। গাছের বৃদ্ধি তেজদীপ্ত না হলে গাছ উইপোকা দ্বারা আক্রমণের ঝুঁকি থাকে। কখনও কখনও পিঁপড়া বীজ বা বীজের ভ্রুণ খেয়ে নার্সারির ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

সেগুন (Tectona grandis) দুটি প্রধান পত্রভুক দ্বারা আক্রান্ত হয়, সাধারণভাবে Hyblaea puera (Hyblaeidae: Lepidoptera) ‘টিক ডিফলিয়েটর’ (teak defoliator) এবং Eutectona machaeralis (Pyralidae: Lepidoptera) ‘টিক স্কেলিটোনাইজার’ (teak skeletoniser) হিসেবে পরিচিত। প্রথমটির পরিণত লার্ভা পাতার মধ্যশিরা (mid-rib) ও প্রধান শিরাসমূহ ব্যতীত সম্পূর্ণ পাতা খেয়ে ফেলে। অন্যদিকে ‘টিক স্কেলিটোনাইজার’-এর লার্ভা পাতার সকল শিরা অবিকল রেখে কেবল সবুজ স্তর খেয়ে পাতাকে জালিকায় পরিণত করে যা পরবর্তীতে বাদামি বর্ণ ধারণ করে এবং শুকিয়ে যায়। ‘টিক ডিফলিয়েটর’ শুধু কচি পাতাকে আক্রমণ করে, এপ্রিল-জুলাই মাসে যখন ব্যাপকহারে কচি পাতা গজায় তখন আক্রমণ সবচেয়ে মারাত্মক রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে ‘টিক স্কেলিটোনাইজার’ বয়স্ক ও শক্ত পাতা খেয়ে থাকে, আর তাই আগস্ট-অক্টোবর মাসে পাতা পরিণত অবস্থায় পৌঁছার পর ব্যাপক আক্রমণ দেখা যায়।

‘গামার ডিফলিয়েটর’ (gamar defoliator) Calopepla leayana (Chrysomelidae: Coleoptera)  এর অপরিণত লার্ভা বিশেষকরে গামার (Gmelina arborea) পাতার নিচের দিকে এমনভাবে খায় যে কেবল মধ্যশিরা ও প্রধান শিরাগুলি অবশিষ্ট থাকে। পূর্ণাঙ্গ বিটল বড় গোলাকার ছিদ্র করে পাতা খায় এবং কচি কুঁড়ি ও শাখাও খেয়ে থাকে। এ ধরনের পাতা খাওয়া মৌসুমের প্রথম থেকে শুরু হয় এবং অক্টোবর পর্যন্ত চলতে থাকে। পাতায় ব্যাপক আক্রমণের ফলে বাড়ন্ত শাখা শুকিয়ে যায়, এমনকি পরপর আক্রমণ হতে থাকলে গাছ মারা যেতে পারে। মেহগনির কান্ড ছিদ্রকারী পোকা (Mahogany shoot borer) Hypsipyla robusta (Pyralidae: Lepidoptera) ব্যাপকভাবে আক্রমণ করে Meliaceae পরিবারের বৃক্ষসমূহকে বিশেষকরে মেহগনি (Swietenia macrophylla = S. mahagony), তুন (Toona cilialta) ও চিকরাশি (chickrassy-chukussia tabularis) বৃক্ষকে। এর লার্ভা চারা গাছের কান্ড ছিদ্র করে মজ্জাতে কেন্দ্রীয় সরু পথ তৈরি করে। এক ধরনের রেশমযুক্ত আঠালো পদার্থ এর প্রবেশমুখ নির্দেশ করে। আক্রান্ত শাখা শুকিয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ে বা কুচকাতে থাকে। মারাত্মকভাবে আক্রান্ত গাছে অনেক শাখা প্রশাখা গজায়। কান্ড এঁকেবেঁকে বেড়ে ওঠে এবং বৃদ্ধি স্থায়িভাবে বাধাপ্রাপ্ত হয়।

বাবলা গাছ (Acacia species) ছাতরা পোকার (scale insect-Anomalococcus indicus (Homoptera) আক্রমণে ব্যাপকহারে মারা যায়। এ পোকা কচি কান্ড ও শাখা প্রশাখা থেকে রস চুষে খায়। ব্যাপক আক্রমণের ক্ষেত্রে কান্ড পুরোপুরিভাবে ছাতরা পোকার আস্তরণে ঢাকা পড়ে। নভেম্বর-এপ্রিল মাসে এ আক্রমণ মারাত্মক রূপ ধারণ করে।

সাধারণভাবে বেতের ডগা ছিদ্রকারী পোকা (cane top shoot borer) হিসেবে পরিচিত Ommatolapus haemorrhoidalis (Curculionidae: Coleoptera) বেতের (Calamus tennis) বর্ধনশীল কান্ডকে আক্রমণ করে। লার্ভা কান্ডের অভ্যন্তরীণ নরম কলা খাওয়ার জন্য একটি কেন্দ্রীয় সুড়ঙ্গ তৈরি করে। এর আক্রমণে কান্ডের অভ্যন্তরীণ বলয় হলুদ বর্ণ ধারণ করে, পরে শুকাতে থাকে এবং টানলে বেরিয়ে আসে।

করই (Albizia species) প্রায়ই দুটি প্রধান পত্রভুক Eurema blandaE. hecabe দ্বারা আক্রান্ত হয়। অপরিণত লার্ভা অল্প অল্প করে অনুপত্রক (leaflet) খেতে শুরু করে এবং বেড়ে ওঠার সময় কেবল মধ্যশিরা ছাড়া সব অনুপত্রক খেয়ে ফেলে। ব্যাপক আক্রমণের ক্ষেত্রে বৃক্ষ পুরোপুরি পত্রবিহীন হয়ে পড়ে। বয়স্ক গাছের তুলনায় চারা গাছ অধিক আক্রান্ত হয়।

রোগসমূহ  পাইন ও ইউক্যালিপটাস এর ‘ড্যাম্পিং-অফ’ বাংলাদেশে Pinus ও Eucalyptus প্রজাতিসমূহের অঙ্কুরিত চারার মারাত্মক রোগ। চারাগাছ মূলে বা মাটির সমতলে (collar region) Pythium species, Fusarium species, Phytophthora species বা Rhizoctonia solani দ্বারা আক্রান্ত হলে গোড়ার দিকে ভেঙে পড়ে। এ রোগ অঙ্কুরোদ্গমের পরপরই দেখা দিলে তখন একে বলে ‘পোস্ট-ইমারজেন্স ড্যাম্পিং-অফ’। রোগাক্রান্ত বীজের অঙ্কুরোদগম নাও হতে পারে।

Fusarium solani জনিত রোগের আক্রমণ নার্সারিতে স্থানে স্থানে অনিয়মিতভাবে দেখা যায়। গামার (Gmelina arborea) চারার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান প্রাথমিক রোগলক্ষণসমূহের মধ্যে রয়েছে বৃদ্ধি হ্রাস এবং পাতার ফ্যাকাশে সবুজ বর্ণ ধারণ, পরে কান্ডের শীর্ষভাগ মরে যাওয়া এবং আস্তে আস্তে পাতা শুকাতে থাকা। মাধ্যমিক মূলে ক্ষুদ্র হালকা বাদামি দাগের মধ্য দিয়ে মূলে রোগের সংক্রমণ শুরু হয়। সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিকাংশ পার্শ্বীয় মূলে পচন ধরে। চারার মাটির সমতল থেকে কিছু মূল গজায় কিন্তু পরে এসব মূল আক্রান্ত হয় এবং পরিশেষে মারা যায়।

কেওড়া গাছের মরা রোগ (Dieback of Keora)  এটি কেওড়া (Sonneratia opetala) চারার একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে কান্ডের শীর্ষভাগ, মধ্যভাগ বা নীচের কচি অংশ থেকে পচতে দেখা যায়। আক্রান্ত চারা আগা থেকে শুকাতে থাকে। আক্রান্ত কান্ডে একটি হালকা বাদামি বর্ণের মধ্যবর্তী অঞ্চল লক্ষ্য করা যায়। Chaetomella raphigera ছত্রাকের আক্রমণে এ রোগ দেখা দেয়।

বাঁশের ব্লাইট রোগে  কচি বাঁশের কাম (culm) ব্যাপকহারে মারা যায়। বিগত দু’দশক ধরে দেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে এবং বৃহত্তর জেলা রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ও সিলেটে (এলাকার নাম প্রাদুর্ভাব ক্রম হ্রাস হিসেবে) এর আক্রমণ মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। বাংলাদেশে Bambusa balcooa ও B. vulgaris সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত বাঁশের প্রজাতি। আক্রমণকারী জীবাণু হিসেবে Sarocladium oryzae-কে শনাক্ত করা হয়েছে।

গত কয়েক দশক ধরে মৌলভীবাজার জেলার লোয়াছড়ার কিছু বনে লোহাকাট (Xylia oxlocarpa) বৃক্ষ গোড়া পচার কারণে আগা থেকে মরে আসা রোগে আক্রান্ত হতে দেখা গেছে। এক বা একাধিক প্রধান শাখায় পাতার ফ্যাকাশে সবুজ বর্ণ থেকে এ রোগের প্রাথমিক লক্ষণ প্রকাশ পায়। পরে এসব পাতা হলুদ বর্ণ ধারণ করে ঝরে পড়ে। শেষ দিকে বৃক্ষ সম্পূর্ণভাবে পত্রবিহীন হয়ে পড়ে এবং মারা যায়। এক ধরনের ছত্রাক Ganoderma lucidum মৃত্তিকার সমতলে গাছের গোড়ায় ও প্রধান প্রধান মূলে পচন সৃষ্টি করে।

সম্প্রতি চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও সিলেট বন বিভাগের কিছু বনে ইউক্যালিপটাস গাছে Corticium salmonicolor-এর আক্রমণে গোলাপী রোগ নামে এক ধরনের রোগ লক্ষ্য করা গেছে। এ রোগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রধান প্রধান শাখা মারা যাওয়া, সেই সঙ্গে পাতা ঝরে পড়া। এ রোগের জন্য দায়ী এক ধরনের ছত্রাক যা মারাত্মক আক্রমণের ক্ষেত্রে গাছের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। কান্ড ও শাখায় এক ধরনের আঠালো পদার্থের নিঃসরণে বাকলের উপর সাদা রেশমি সুতার বৃদ্ধি থেকে এ রোগ প্রথম ধরা পড়ে।  [মোঃ ওয়াহিদ বকস]

বনভূমি সংরক্ষণ (Forest conservation) বাংলাদেশের বনাঞ্চল সুষম অর্থনীতির জন্য প্রয়োজনের তুলনায় নিতান্ত অপ্রতুল হলেও এসব বনাঞ্চল দেশের অর্থনীতি ও সার্বিক কল্যাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এজন্যই জনগণের অস্তিত্ব ও টেকসই  উন্নয়নের জন্য বনসম্পদ  সংরক্ষণ অত্যাবশ্যক। বাছাইকৃত বৃক্ষ কর্তন ও স্বাভাবিক বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে ১৮৭০ সালে পার্বত্য বনে সরকারি ব্যবস্থাপনার সূচনা ঘটে। পরবর্তী সময়ে ১৯৩০ সালের দিকে সম্পূর্ণ বনভূমির কর্তন এবং কৃত্রিম বংশবিস্তার বা বৃক্ষরোপণ পদ্ধতি চালু হয় এবং সেসঙ্গে বাছাইকৃত বৃক্ষ কর্তন-বনাম-উন্নয়ন পদ্ধতি অব্যাহত থাকে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এসব বনাঞ্চলের ওপর অত্যধিক চাপ পড়ে এবং বনজ দ্রব্যের বর্ধিত চাহিদা মেটাতে আহরণ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তীতে দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি বনায়ন এবং সেসঙ্গে সংরক্ষণ ব্যাপকহারে চালু করা হয়।

সমভূমির শালবন অতীতে জমিদারদের মালিকানাধীন ছিল। পরবর্তীতে বাংলাদেশ বন বিভাগ এগুলির ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করে।

বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলের মুখ্য উপাদান সুন্দরবন। ১৮৭৯ সালে সংরক্ষিত বনভূমি ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই সুন্দরবনের ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বন বিভাগ। প্রধান প্রজাতির কর্তনযোগ্য গাছের বেড়ের নির্দিষ্ট মাপ ও ৪০ বছর মেয়াদ বন পরিচর্যায় অনুসরণ করা হয়। পরবর্তীকালে সময়সীমা কমিয়ে ২০ বছর পর পর গাছ কাটার ব্যবস্থা চালু করা হয়। পার্শ্ববর্তী জলাভূমিসহ সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন হলো দীর্ঘস্থায়ী বহুমুখী ব্যবহার ও সমন্বিত সংরক্ষণ পদ্ধতির জন্য এক বিপুল সম্ভাবনাময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্ত্তসংস্থান। প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সাল থেকে সকল প্রাকৃতিক বনভূমিতে বৃক্ষ কর্তনের ওপর নিষেধাজ্ঞা কার্যকর রয়েছে।

বাংলাদেশের নিবিড় ভূমি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম হিসেবে কৃত্রিম বনায়ন ক্রমেই বাড়ছে। বর্তমানে বনায়ন প্রকল্পের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে দেশের সামগ্রিক বৃক্ষসম্পদ বৃদ্ধি, বনজ সম্পদ হ্রাস প্রতিরোধ, চিহ্নিত সংরক্ষিত এলাকার বনভূমি সংরক্ষণ জোরদার এবং স্থানীয় জনগণের অংশগ্রহণের মাধ্যমে বনসম্পদের টেকসই ব্যবস্থাপনা। উপকূলীয় অঞ্চলে বনায়ন কার্যক্রম ও ‘উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী’ হিসেবে একটি গাছপালার বেষ্টনী গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা বহু পূর্বেই স্বীকৃত হয়েছে। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্পের অধীনে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন উপকূলীয় বাস্ত্তসংস্থানের সংরক্ষণ ও উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। বাংলাদেশে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে বনায়নকৃত এলাকার মোট আয়তন প্রায় ৩,৮০,৭২১ হেক্টর (পার্বত্য বন ২,১০,০৭৭ হেক্টর, উপকূলীয় অঞ্চল ১,৩৪,৬৪৫ হেক্টর ও শালবন ৩৫,৯৯৯ হেক্টর)।

সংরক্ষণের উপায় হিসেবে বননীতি ১৯৭৯ সালে দেশের প্রথম জাতীয় বননীতি (National Forest Policy) প্রণীত হয়। সময়ের চাহিদা ও বন খাতের বিদ্যমান সার্বিক অবস্থার নিরিখে ১৯৭৯ সালের জাতীয় বননীতি সংশোধন করে। ১৯৯৪ সালে একটি নতুন জাতীয় বননীতি গৃহীত হয়। এ নতুন বননীতি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বাস্ত্তসংস্থানিক ভারসাম্য রক্ষায় বনভূমির সংরক্ষণ ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে। এই বননীতি ২০১৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের বনাঞ্চল ১০% থেকে ২০% বৃদ্ধি, ১০% ‘রিজার্ভ বন’ সংরক্ষণ করা এবং বনায়ন ও কৃষি বনায়নে বিনিয়োগে উৎসাহ প্রদানের মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল সংরক্ষণের প্রস্তাব করা হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ ও এসব সম্পদের অনুকূল বাস্ত্তসংস্থানের সুরক্ষা ও ব্যবস্থাপনার ওপর টেকসই উন্নয়নের নির্ভরতা উপলব্ধি থেকে ১৯৮৬ সালে জাতীয় সংরক্ষণ কৌশল (National Conservation Strategy) গৃহীত হয়।

বনভূমি সংরক্ষণের জন্য আইন প্রণয়ন বাংলাদেশের বনভূমি সংরক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ বিধিবিধান ও আইনসমূহের ভিত্তি হলো ১৯২৭ সালের ব্রিটিশ ভারতের বন আইন। ১৯৭২ সালের বন আইন সংশোধনের মাধ্যমে কিছুটা পরিবর্তিত হয় এবং ১৯৯০ সালে সংশোধিত বন আইন চালু হয়। বনজ উদ্ভিদকুল ও বন্যপ্রাণিকুল সংরক্ষণের বন (সংশোধনী) আইন, ১৯৯০ ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। এছাড়া রয়েছে ব্যক্তিমালিকানাধীন বন অধ্যাদেশ, ১৯৫৯ ও আতিয়া বন (সংরক্ষণ) অধ্যাদেশ, ১৯৮২। ইটের ভাটায় কাঠ পোড়ানো বন্ধের লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ (সংশোধনী) আইন চালু হয়। ১৯৯২ সালে ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধিত হয় এবং সেই বছরই দেশের বনজ সম্পদ সংরক্ষণের কঠোর পদক্ষেপ হিসেবে ইট পোড়ানো নিয়ন্ত্রণ (সংশোধনী) অধ্যাদেশ কার্যকর করা হয়। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন উভয় প্রকার বনভূমি থেকে বনজ সামগ্রী স্থানান্তর নিয়ন্ত্রণের জন্য বন আইনের অধীনে বনজ সম্পদ পরিবহণ বিধি (Forest Transit Rules) প্রণীত হয়। বনজ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি এড়ানোর জন্য বনে কড়া পাহারা এবং বন (সংশোধনী) আইন, ১৯৯০-এর পূর্ণপ্রয়োগ কার্যকর করা হয়।

সংরক্ষণের পর্যায়সমূহ  বন ও বনসম্পদ, অর্থাৎ মাটি, পানি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করা হয় কার্যত বাস্ত্তসংস্থান ও প্রজাতি পর্যায়ে। বাস্ত্তসংস্থানিক পর্যায়ে বনভূমি সংরক্ষণের কৌশল নিম্নরূপ: ১. সংরক্ষিত অঞ্চলের ব্যবস্থাপনা, ২. বনভূমি থেকে বৃক্ষ কর্তনের জন্য সংরক্ষণধর্মী পদ্ধতি গ্রহণ বা বনাঞ্চল থেকে পরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বনজসম্পদ আহরণ।

বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারের জন্য নির্ধারিত বনাঞ্চল সংরক্ষিত অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধনী), ১৯৭৪ আইনের ২৩নং অনুচ্ছেদে সংরক্ষিত অঞ্চল ঘোষণার শর্তসমূহ ও আইনগত অবস্থান উল্লিখিত হয়েছে। সরকার উক্ত অনুচ্ছেদের শর্তানুসারে সরকারি গেজেটে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য, জাতীয় পার্ক ও শিকারভূমি ঘোষণা করতে পারে।

বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ) (সংশোধনী) আইন, ১৯৭৪-এর আইনগত শর্তসমূহ  অভয়ারণ্যে কোন ব্যক্তির প্রবেশ বা বসবাস, উদ্ভিদের ক্ষতি বা ধ্বংস সাধন, বন্যপ্রাণী শিকার, বহিরাগত প্রাণী প্রবর্তন, গৃহপালিত পশুচারণ, অগ্নিসংযোগ ও পানিদূষণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ২৩ (৩) অনুচ্ছেদে জাতীয় পার্ক ঘোষণা ও সংরক্ষণের জন্যও অনুরূপ শর্ত রয়েছে। বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও জাতীয় পার্কগুলির সীমানার এক মাইলের মধ্যে প্রাণী শিকার, হত্যা বা ধরা নিষিদ্ধ। অবশ্য সরকার বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রয়োজনে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি কিংবা  সংরক্ষিত অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য এসব বিধিনিষেধ আংশিক বা সম্পূর্ণ শিথিল করতে পারে এবং সংরক্ষিত অঞ্চলে রাস্তাঘাট, বিশ্রামাগার ইত্যাদি নির্মাণের অনুমতি প্রদান করতে পারে। অনুচ্ছেদ ২৩ (৫) অনুযায়ী সরকার কিছু শিকারভূমিতে বন্যপ্রাণীর সর্বোচ্চ সংখ্যা, শিকারের নিদির্ষ্ট স্থান ও সময় উল্লেখপূর্বক বন্যপ্রাণী শিকারের বিশেষ অনুমতি দিতে পারে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ (সংশোধনী) আইনের ২৪ নং অনুচ্ছেদে ব্যক্তিমালিকানাধীন শিকারভূমি গড়ে তোলার সুযোগও রয়েছে।

বাংলাদেশ বিশ্বের বিপন্ন বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতির আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংক্রান্ত কনভেনশন (Convention on International Trade in Endangered Species of Wild Fauna and Flora/CITES), আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি, বিশেষত জলচর পাখিদের আবাস সম্পর্কিত কনভেনশন/রামসর কনভেনশন (Convention on wetlands of international importance especially waterfowl habitats/Ramsar Convention), বিশ্ব সংস্কৃতি ও প্রাক…ৃতক ঐতিহ্য সংরক্ষণ সম্পর্কিত কনভেনশন/বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশন (Convention concerning the Protection of the World Cultural and Natural Heritage/World Heritage Convention), জীববৈচিত্র্য সম্পর্কিত কনভেনশন (Convention on Biological Diversity/CBD), মরুকরণ প্রতিরোধ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন (International Convention to Combat Desertification) এবং বিশ্ব ব্যাঘ্র ফোরাম (Global Tiger Forum) ইত্যাদির মতো কয়েকটি পরিবেশ সংক্রান্ত কনভেনশনের সঙ্গে যুক্ত। এসব কনভেনশন বাস্ত্তসংস্থানিক ও প্রজাতিগত উভয় পর্যায়ে বনাঞ্চল সংরক্ষণে সহায়তা করে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ও এ বনাঞ্চলের বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য যথাক্রমে কনভেনশনের বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমির তালিকায় এবং বিশ্ব ঐতিহ্য কনভেনশনের বিশ্ব ঐতিহ্যের (World Heritage) তালিকায় অন্তর্ভু&ক্ত হয়েছে। এসব কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী হিসেবে বাংলাদেশ কনভেনশনের অন্তর্ভুক্ত স্থানসমূহের প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণে অঙ্গীকারবদ্ধ।  [মোঃ গোলাম হাবীব]

বন বিভাগ বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি বিভাগ, সদর দপ্তর ঢাকার মহাখালীতে অবস্থিত। সর্বোচ্চ প্রশাসনিক দায়িত্বে আছেন প্রধান বন সংরক্ষক (Chief Conservator of Forests) এবং তিনজন উপ-প্রধান বন সংরক্ষক (Deputy Chief Conservator)। বনসমূহের উন্নয়ন, ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনা ও সম্প্রসারণ এই বিভাগের দায়িত্ব। এছাড়া এর প্রশাসন ও তত্ত্বাবধানে রয়েছে চট্টগ্রাম বন গবেষণা ইনস্টিটিউট, বন মহাবিদ্যালয়, কাপ্তাই বন উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং সিলেট ও রাজশাহীতে একটি করে বন বিদ্যালয়। ঢাকার মীরপুরে অবস্থিত জাতীয় বোটানিক্যাল গার্ডেনও বন বিভাগের অধীনে। এই বিভাগ বেশ কয়েকটি প্রকল্পও বাস্তবায়ন করছে। ১৯৯০ সাল থেকে নিম্নোক্ত প্রকল্পসমূহে কাজ চলছে: বনসম্পদ উন্নয়ন প্রকল্প, বনখাত প্রকল্প, উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী প্রকল্প এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ প্রকল্প। বন বিভাগ ৬টি সার্কেল এবং প্রতিটি সার্কেলের অধীনস্থ কয়েকটি ডিভিশনসহ দেশে সর্বমোট ৩৭টি ডিভিশনের মাধ্যমে মাঠপর্যায়ে কর্মকান্ড পরিচালনা করে। ডিভিশন কয়েকটি রেঞ্জে ও রেঞ্জগুলি বিটে বিভক্ত, যেগুলি যথাক্রমে রেঞ্জ-অফিসার ও বিট-অফিসাররা (ফরেস্টার/ডেপুটি রেঞ্জার পদমর্যাদার) পরিচালনা করেন। উজাড় হয়ে যাওয়া বন ও প্রান্তিক ভূমি পুনর্বাসনের জন্য বন বিভাগ সর্বসাধারণকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক বনায়ন কার্যক্রম চালু করেছে। এই কার্যক্রমে রয়েছে বনাঞ্চল ও কৃষি খামারে বৃক্ষরোপণ, জুম পুনর্বাসন, গ্রামীণ বনায়ন, চারা বিতরণ, নার্সারি উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ। বন বিভাগ গৃহীত সম্পদ তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি (Resource Information Management System/RIMS), বন উন্নয়ন পরিকল্পনা এবং সকল নিয়মিত কর্মসূচি ও প্রকল্প কর্মকান্ডে যথেষ্ট সহায়তা করছে। ভৌগোলিক তথ্য পদ্ধতির (Geographical Information System) সঙ্গে একীভূত বিধায় সম্পদ তথ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি বাংলাদেশের বনসম্পদ ও সেগুলি ব্যবস্থাপনার উপাত্ত (data) ও তথ্যের সমন্বিত কেন্দ্র হিসেবে বন বিভাগের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। বন বিভাগে নিয়োজিত কর্মকর্তা ও কর্মচারীর সংখ্যা প্রায় ৭৩০০; অধিকন্তু, বিভাগ মাঠপর্যায়ের কাজে বহুসংখ্যক ঠিকা-মজুর নিয়োগ করে থাকে।  [মোঃ গোলাম হাবীব]

বন শিক্ষা ও গবেষণা (Forest education and research)  এ উপমহাদেশে ১৮৭০ সাল পর্যন্ত বন বিভাগে কর্মরত ব্যক্তিদের কোন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ছিল না। বন ব্যবস্থাপনায় দক্ষ কারিগরি জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকার ১৮৭৮ সাল থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত ফরেস্টারদের প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করে।

শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ  ফরেস্ট রেঞ্জারদের জন্য একই সঙ্গে একই বছর দেরাদুনে একাডেমিক ও ফিল্ড ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা শুরু হয়। অবিভক্ত ভারতে বন বিভাগ স্থাপিত হবার প্রায় ৩০ বছর পর ১৮৯৪ সালে একটি বননীতি প্রণীত হয়। বিশাল বনসম্পদকে ব্রিটিশ সরকারের নিজস্ব স্বার্থে কাজে লাগাবার উদ্দেশ্যে এই উপমহাদেশে তখন থেকেই বনবিদ্যা একটি বিজ্ঞান হিসেবে ধীরে ধীরে বিকাশ লাভ করেন। এই পটভূমিতে ব্রিটিশ সরকার দেশের এই অংশে বন সম্পর্কিত শিক্ষার উন্নতি সাধন ও গবেষণা সুবিধা গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করে। ১৯২৬ থেকে ১৯৩২ সাল পর্যন্ত ভারতীয় ফরেস্ট সার্ভিসের গেজেটেড কর্মকর্তারা দেরাদুনে প্রশিক্ষণ লাভ করে। ১৯৩৭ সালে ফরেস্ট সার্ভিস প্রাদেশিকীকরণ হওয়ার পর গেজেটেড কর্মকর্তারা ১৯৩৮ সাল থেকে প্রাদেশিক ফরেস্ট সার্ভিসের জন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে শুরু করেন। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পাবলিক সার্ভিস কমিশন কর্তৃক নিয়োগকৃত গেজেটেড ও নন-গেজেটেড ফরেস্ট কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য পেশোয়ারে একটি ফরেস্ট কলেজ স্থাপিত হয়।

বন বিষয়ে দুই বছরের ডিপ্লোমা কোর্স প্রদানের জন্য চট্টগ্রামের ষোলশহরে ১৯৬৪ সালে একটি ফরেস্ট কলেজ স্থাপিত হয়। বর্তমানে সেখানে চারটি ভাগে বিভক্ত ১৭টি বিষয়ের ওপর কোর্স প্রদানের ব্যবস্থা রয়েছে। উপপ্রধান বনসংরক্ষক পদের সমমর্যাদার একজন পরিচালকের নেতৃত্বাধীন সরকারের ফরেস্ট সার্ভিসে কর্মরত সিনিয়র ও জুনিয়র কর্মকর্তা ও খন্ডকালীন শিক্ষকবৃন্দ প্রশাসন ও একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনায় নিয়োজিত রয়েছেন।

১৯৮৬ সাল থেকে ভূতপূর্ব চট্টগ্রাম বন মহাবিদ্যালয় (বর্তমানে বন একাডেমি) বনবিদ্যায় দুইবছর মেয়াদি এম.এসসি কোর্স এবং সিনিয়র ফরেস্ট সার্ভিসের (বি.সি.এস ক্যাডার) কর্মকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালু করে। এই কলেজ একই সাথে ফরেস্ট রেঞ্জারদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি অথবা বি.এসসি (বনবিদ্যা) কোর্স চালু করে। ফরেস্ট সার্ভিসের সিনিয়র কর্মকর্তা, বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা কর্মকর্তা এবং বিষয়ের সাথে সম্পর্কযুক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে খন্ডকালীন শিক্ষকবৃন্দ সাধারণত এই কোর্স পরিচালনা করেন।

১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি স্থাপিত হয়। এ ইনস্টিটিউট চার বছর মেয়াদি স্নাতক ও এক বছর মেয়াদি স্নাতকোত্তর কোর্স প্রদান করছে।

গবেষণা  বন সেক্টরকে অধিকতর ব্যবহার উপযোগী এবং এ খাতে নতুন উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রামে ‘ফরেস্ট প্রোডাক্ট ল্যাবরেটরিজ’ নামে একটি বন গবেষণা পরীক্ষাগার স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে এটিকে একটি পূর্ণাঙ্গ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে রূপান্তর করা হয়।

এই প্রতিষ্ঠানের বিধিবদ্ধ দায়িত্ব হলো বন বিভাগ, বাংলাদেশ বনশিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কর্মসূচি এবং এসব কর্মসূচি পরিচালনা করতে গিয়ে যেসব সমস্যার সম্মুখীন হয় সেগুলির ওপর গবেষণা করা।

বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রশাসনিক প্রধান একজন পরিচালক। এর দুটি গবেষণা শাখার প্রতিটি একজন চীফ সায়েন্টিফিক অফিসারের নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। বন ব্যবস্থাপনা শাখা ১১টি বিভাগ এবং বন উৎপাদন শাখা ৬টি বিভাগ নিয়ে গঠিত। বর্তমানে প্রায় একশত বৈজ্ঞানিক ও গবেষক বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটে কাজ করছেন।  [আবুল খায়ের]

আরও দেখুন বনউজাড়; বনায়ন; বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট; বাংলাদেশ বন শিল্প উন্নয়ন কর্পোরেশন; পর্ণমোচী বন; সামাজিক বনায়ন